দেশজুড়ে

ইটভাটায় কাজ করে কলেজে ভর্তি হলেন রিপন

রাজশাহী কলেজে ভর্তির টাকা জোগাতে টানা এক বছর ইটভাটায় কাজ করেছেন রিপন হোসেন। রাতদিন খেটে ৩০ হাজার টাকা জমালেন। কিন্তু প্রচণ্ড শীতে কাজ করতে গিয়ে হয়ে যায় তার টনসিল। পরে অপারেশন করতে চলে যায় ১৫ হাজার টাকা।

Advertisement

এরপর মায়ের সংসারের খাবার জোগাতে পাঁচ হাজার টাকার ধান কেনেন। অপারেশনের পর দীর্ঘ বিশ্রাম। কাজে যেতে না পেরে বাকি ১০ হাজার টাকা সংসার খরচ হয়ে যায়। শেষে বন্ধুর সহায়তায় গ্রামের একটি কলেজে ভর্তি হন রিপন। কিন্তু বইপত্র কেনার পয়সা ছিল না তার। ফলে নিজে থেকেই বাদ দেন কলেজে যাওয়া।

স্বপ্ন ছিল রাজশাহী কলেজে ভর্তি হবেন। দ্বিতীয় দফায় রাজশাহী কলেজে ভর্তি হওয়ার চিন্তা মাথায় নিয়ে নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধে। নানা প্রচেষ্টায় এক বছরেও কলেজে ভর্তির টাকা জোগাড় হয়নি তার। কিন্তু কিছুতেই হাল ছাড়েননি। দ্বিতীয় দফায় ভর্তির সুযোগ পেয়ে মঙ্গলবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বন্ধু ফিরোজ আহম্মেদের সহায়তায় হাজির হন রাজশাহী কলেজে। দেখা করেন কলেজের অধ্যক্ষ মহা. হবিবুর রহমানের সঙ্গে। এরপর বদলে যায় তার জীবনের গল্প। রিপনের ভর্তি ও যাবতীয় খরচের দায়িত্ব নেন অধ্যক্ষ। আগামীতে সাধ্যমতো তাকে সহায়তার আশ্বাসও দেন অধ্যক্ষ হবিবুর রহমান।

অধ্যক্ষের দফতর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কথা হয় রিপন হোসেনের সঙ্গে। শরীরের পাতলা গড়ন, পরনে পুরোনো শার্ট ও হালকা নীল রঙের ট্রাউজার। পায়ে স্যান্ডেল, মলিন মুখে হাসির ঝিলিক; দুই চোখে সীমাহীন আনন্দ তার।

Advertisement

হাসিমুখে রিপন হোসেন বলেন, ২০১৯ সালে নওগাঁর মান্দা উপজেলার চকউলী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে এসএসসি পাস করি। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছি। শুধু ইংরেজিতে পাঁচ নম্বর কম পাওয়ায় ছুটে যায় গোল্ডেন এ-প্লাস। অষ্টম শ্রেণিতে একই বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পেয়েছি।

রিপনের গ্রামের বাড়ি মান্দা উপজেলার কাঁশোপাড়া ইউনিয়নের আন্দারিয়াপাড়ায়। বাবা জয়বুল হোসেন বাদশা দ্বিতীয় বিয়ে করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় বাস করছেন। তার যখন বয়স তিন বছর, তখনই ছেড়ে যান বাবা। বাবাহারা হয়ে বেড়ে উঠেছেন রিপন।

দাদা কলিম উদ্দিন প্রামাণিকের আশ্রয়ে থেকে যান রিপনের মা। বসতভিটা ছাড়া কোনো সম্পত্তি নেই তাদের। বৃদ্ধ বয়সে কাজ করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেন তার দাদা। শেষে অন্যের সহযোগিতায় সংসার চলতো তার। অষ্টম শ্রেণি পাস মা জুলেখা খাতুন ছোটখাটো কাজ করে রিপনকেও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত টেনে নিয়ে যান। বছর দুয়েক আগে বিড়ি শ্রমিকের কাজ শুরু করেন রিপন। মায়ের হাড়ভাঙা শ্রম এবং শিক্ষকদের সহায়তা শেষে এসএসসির বাধা পেরিয়ে যান তিনি।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি দাদাকে হারান রিপন। সবমিলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার এইচএসসিতে ভর্তি। গত বছর অনলাইন আবেদন করে রাজশাহী কলেজে ভর্তির সুযোগ হয়। কলেজে এসে ভর্তির প্রাথমিক কাজও শেষ করেন রিপন। কিন্তু ফি জমা দিতে গিয়ে ঘটে বিপত্তি। হাতে টাকা না থাকায় ভর্তি না হয়ে ফিরে যেতে হয় বাড়ি। এরপর শুরু হয় ভর্তি এবং রাজশাহীতে থাকা-খাওয়ার টাকা জোগাড়ের মিশন।

Advertisement

রিপন আরও বলেন, তৃতীয় শ্রণিতে পড়ার সময় ইটভাটায় কাজ শুরু করি। শুরুর দিকে কেবল ইট উল্টাতে হতো। এরপর হাত লাগাই ইট বানানোর কাজে। টানা ছয় বছর কাজ করেছি ইটভাটায়। এই ভাটায় কাজ করে কলেজে ভর্তির টাকা জমিয়েছি। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই টাকা চিকিৎসায় ও এবং সংসারে খরচ হয়ে যায়।

রাজশাহী কলেজে ভর্তির স্বপ্ন পূরণে পাশে এসে দাঁড়ান বন্ধু ও ঢাকা আইএইচটির শিক্ষার্থী ফিরোজ আহম্মেদ ফাইন। দ্বিতীয় দফায় রাজশাহী কলেজে একাদশ শ্রেণিতে তার ভর্তির আবেদন করে দেন ফাইন। এবার রাজশাহী কলেজে তার বাণিজ্য বিভাগে ভর্তির সুযোগ হয়।

কিন্তু এবারও বাধ হয়ে দাঁড়ায় আর্থিক সমস্যা। শেষে একই উপজেলার কয়লাবাড়ির বাসিন্দা ও রাজশাহী কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ হয় রিপনের। ওই শিক্ষকই তাকে অধ্যক্ষের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

রিপনের স্বপ্ন ভালো ফলাফল করে ব্যাংকার হওয়া। এর পেছনে একটা গল্প আছে রিপনের। এসএসসি পাস করার পর ডাচবাংলা ব্যাংকের শিক্ষাবৃত্তির জন্য বিবেচিত হন রিপন। পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নথিপত্রসহ বাবাকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হতে বলেন। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও বাবাকে হাজির করাতে পারেননি রিপন।

শেষে ব্যাংক কর্তাদের পরামর্শে মাকে নিয়ে যান। এতে ক্ষিপ্ত হন ব্যাংকের লোকজন। শেষে নথিপত্র জমা না নিয়ে তাদের অপমান করে বের করে দেয়া হয়। সেই দিনই রিপন প্রতিজ্ঞা করেন, ব্যাংক কর্মকর্তা হয়ে মায়ের সম্মান ফিরিয়ে দেবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ মহা. হবিবুর রহমান বলেন, জীবন থেকে ছেলেটি তার মূল্যবান একটি বছর হারিয়ে ফেলেছে। এবারও সাহস করে কলেজে না এলে হয়তো তার ভর্তি হওয়া হতো না। তার দুরবস্থার কথা শুনে ভর্তির ব্যবস্থা করেছি। তাকে কাছে টেনে নিয়েছি। আগামীতে তার পাশে থাকবে রাজশাহী কলেজ।

অধ্যক্ষ বলেন, অর্থের অভাবে হয়তো অনেকে এই কলেজে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। সেই খবর আমাদের অগোচরে থেকে যাচ্ছে। সরাসরি তারা অধ্যক্ষের কাছে এলে ভর্তির সুযোগ পেতে পারে। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি ফি তিন হাজার টাকা, এই ফি না নিলেও রাজশাহী কলেজ চলবে। রাজশাহী কলেজের মতো অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচিত এমন শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করা। এটি সবার দায়িত্ব, সমাজের দায়িত্ব। অর্থের অভাবে কেউ যেন সমাজ ও দেশের বোঝা না হয়ে যায় সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।

এএম/এমকেএইচ