সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বিভাগ হলো মাঠ প্রশাসন। মাঠপর্যায়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। তবে মাঠ প্রশাসনে পুরুষের তুলনায় নারীর চ্যালেঞ্জ বেশি, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন।
Advertisement
সাম্প্রতিক সময়ে মাঠ প্রশাসনের কয়েকজন নারী কর্মকর্তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে নারীদের চ্যালেঞ্জের বিষয়টি ফের সামনে এসেছে।
বর্তমানে ৬৪ জেলা প্রশাসকের (ডিসি) মধ্যে নারী সাতজন। এছাড়া ৪০ জন নারী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি), ১৩৭ জন নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং দেড়শজনের মতো নারী সহকারী কমিশনার (ভূমি) রয়েছেন বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে।
আনজুমান আরা নড়াইলের ডিসি, সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন নরসিংদীর ডিসি, শাহিদা সুলতানা গোপালগঞ্জের ডিসি, সাবিনা ইয়াসমিন পঞ্চগড়ের ডিসি, রহিমা খাতুন মাদারীপুরের ডিসি, আনার কলি মাহবুব শেরপুরের ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
Advertisement
গত ২ সেপ্টেম্বর দিবাগত গভীর রাতে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের সরকারি বাসভবনে সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর আহত হন ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা ওমর আলী। ওয়াহিদা খানমের মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়। তাকে প্রথমে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে রংপুরের একটি ক্লিনিকের আইসিইউতে নেয়া হয়। সেখান থেকে ৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে হেলিকপ্টারে করে অচেতন ওয়হিদা খানমকে ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালে ভর্তি করা হয়।
৩ সেপ্টেম্বর রাতে তার মাথায় অস্ত্রোপচার হয়। ধীরে ধীরে তার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে
অপরদিকে সম্প্রতি দুজন ঠিকাদারের মাটি ভরাটের কাজে ব্যবহৃত চারটি ড্রেজার মেশিন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা এবং আটটি অন্য মেশিন ভাঙচুর করে ক্ষতিসাধনের অভিযোগে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুনসহ ছয় সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দুটি মামলা হয়। পরে সমালোচনার মুখে মাদারীপুরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলা দুটি খারিজ করে দেন।
Advertisement
এছাড়া কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে অসৌজন্যমূলক আচরণের পাশাপাশি হুমকি দেয়ার অভিযোগ আনেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌসুমী জেরীন কান্তা। গত ৩ মে তিনি প্রতিকার চেয়ে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেনের কাছে একটি চিঠি দেন। কিন্তু জেলা প্রশাসক ওই চিঠির বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় এক মাস পরই তিনি বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান।
উপরোক্ত ঘটনাগুলোর পর নারী কর্মকর্তাদের মাঠ প্রশাসনে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের বিষয়টি আলোচিত হয়। মাঠপর্যায়ে নারীদের চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের মহাসচিব ও স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব সায়লা ফারজানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাঠ প্রশাসনে নারী কর্মকর্তাদের চ্যালেঞ্জ পুরুষের তুলনায় ডেফিনেটলি বেশি। চ্যালেঞ্জ বেশি থাকার পরও নারীরা পিছপা হন না।’
তিনি বলেন, ‘কেউ যদি নারীদের আঘাত করতে চায়, হেয় করতে চায়, তবে এক্ষেত্রে সুযোগ বেশি। সমাজে এমন মানুষ এখনও আছে যারা নারীকে কটাক্ষ করে কথা বলে। এটা পুরুষতান্ত্রিকতা নয়। এরা নির্বোধ ও অসামাজিক। সামাজের দুষ্টু লোকেরাই এটা করে। তাদের দুষ্টুমি অন্যদের ক্ষেত্রে সহজ হয় না, নারীদের ক্ষেত্রে সহজ হয়।’
ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা ও ধিক্কার জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এর বিচার চাই। একই সঙ্গে এখন থেকে যাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় সেই দাবিও জানাচ্ছি। যারা সেখানে গেছে তারা চুরি করতে যায়নি। আমাদের পারসেপশন বলে না এটা চুরির ঘটনা। চুরি করতে গেলে চুরি করবে। কিন্তু একটা জিনিসও তো তারা সরায়নি।’
সায়লা ফারজানা আরও বলেন, ‘মাদারীপুরের ডিসির বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি দুঃখজনক। যিনি বিচার করবেন তিনি যদি বিচার না বোঝেন, তাহলে কীভাবে হবে! যিনি মামলাটি নিয়েছেন তাকে বুঝতে হবে যে, যার বিরুদ্ধে মামলাটি নিচ্ছেন তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে মামলা হয় না।’
বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের মহাসচিব বলেন, ‘যারা মামলা করেছেন তাদের কেউ না কেউ ইন্ধন দিয়েছেন, কারও না কারও দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তারা এটি করেছেন। এগুলো আমাদের জন্য খারাপ সংকেত, সমাজের জন্য খারাপ বার্তা।’
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হেলালুদ্দীন আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে নারী কর্মকর্তাদের চ্যালেঞ্জ একটু বেশি, এটা ঠিক। এর কারণ হলো, দায়িত্ব পালনের সঙ্গে তাদের সংসারও সামলাতে হয়। এছাড়া আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন যে, এখনও অনেকে নারীদের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারেন না। এই দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে নারীদের চ্যালেঞ্জ থেকেই যাবে। তবে আগের তুলনায় পরিস্থিতি অনেক উন্নতি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অনেকে মনে করেন, নারীরা দুর্বল, তাই তাদের ওপর একটু প্রভাব খাটানো সহজ। সেই সুযোগটা অনেকে নিতে চায়।’
‘ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলাকে আমরা কোনোভাবেই চুরির ঘটনা হিসেবে মানতে পারছি না। তারা সেখানে তিন ঘণ্টা অবস্থান করেছে। একবার বের হয়েছে, আবার ঢুকেছে। তাদের সঙ্গে হাতুড়ি ছিল, তালা ভেঙে চাইলে জিনিসপত্র নিয়ে যেতে পারত। তারা হয়তো কাউকে আড়াল করতে এই ধরনের কথা বলতে পারে।’
হেলালুদ্দীন আহমদ আরও বলেন, ‘আমরা কয়েকজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছি মামলার বিষয়টি দেখাশোনার জন্য। মামলার গতিপ্রকৃতি ফলো করার জন্য।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাঠ প্রশাসনে কাজ করার চ্যালেঞ্জ নারী-পুরুষ সবার জন্যই আছে। বিষয়টি চলমান। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জ আসে। আমরা যখন সার্ভিসে ছিলাম তখন একরকম চ্যালেঞ্জ ছিল। দিন যত যায় বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসে। নতুন নতুন পদ্ধতিতে সেগুলো মোকাবিলা করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’
জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে নারী কর্মকর্তাদের চ্যালেঞ্জ অবশ্যই বেশি। সেটা আমরা অ্যাড্রেসও করি। তাদের পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা যত্নশীল থাকি, যাতে দূরবর্তী বা দুর্গম এলাকায় তাদের পোস্টিং না দেয়া হয়।’
আরএমএম/এমএআর/এমএস