দেশজুড়ে

জোয়ার-ভাটার বৃত্তে বন্দী লাখো জীবন

টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় প্রতি জোয়ারে ডুবছে দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার কয়েকটি ইউনিয়নের একাধিক গ্রামের কয়েকশ ঘরবাড়ি। ফলে জোয়ার-ভাটার বৃত্তে চলছে লাখো মানুষের জীবন। প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য ১৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অর্ধেক কাজও আড়াই বছরেও শেষ করতে না পারায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা। প্রকল্পের প্রথম মেয়াদ শেষ হলেও কাজ শেষ না হওয়ায় আতংক ভর করে আছে দ্বীপবাসীদের।

Advertisement

দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেতে দ্রুত সময়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করার দাবিতে কক্সবাজারের তরুণদের সংগঠন ‘উই ক্যান’ এর উদ্যোগে সম্প্রতি দ্বীপের উত্তর ধুরুংয়ের কায়ছারপাড়া ভাঙন এলাকায় মানববন্ধন করেছেন ঘরবাড়ি হারানো ক্ষতিগ্রস্তরা।

উই ক্যানের প্রতিষ্ঠাতা ওমর ফারুক জয়ের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বলা হয়, বিগত ২০১২ সালে ঘূর্ণিঝড় আয়লা ও পরবর্তী ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু,মোরা এবং সাম্প্রতিক আম্ফানের আঘাতে কুতুবদিয়া উপকূলের কাইছারপাড়া, নয়াকাটা, পশ্চিম চরধুরুং, পূর্ব চরধুরুং, পূর্ব তারলেরচর, আনিচের ডেইলসহ আরো কয়েকটি এলাকায় প্রায় ১৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্বীপের ৪০ কিলোমিটার বাঁধের মাঝে ২০কিলোমিটার বাঁধ অরক্ষিত। অমাবস্যা আর পূর্ণিমার জোয়ারে সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেলেই ভাঙাবাঁধ এলাকার গ্রামগুলোতে জোয়ার-ভাটা চলে। এ সময় লাখো দরিদ্র মানুষের ঘরে থাকা দায় হয়ে পড়ে। এতে অনাবাদি থাকছে হাজারো একর ফসলি জমি। পানি উন্নয়ন বোর্ড মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ১৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মেরামতে ৯২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও গত আড়াই বছরে এক-তৃতীয়াংশ কাজও শেষ করতে পারেনি ঠিকাদার। ফলে ৭ বছর ধরে ঝুঁকিতে বসবাস করছে লক্ষাধিক মানুষ।

উত্তর ধুরুং এলাকার ভুক্তভোগীদের একজন হাসান মাহমুদ সুজন বলেন, জোয়ারে ঘর-আঙিনা, পুকুর পানিতে একাকার হচ্ছে। এলাকার সিংহভাগ লোক দরিদ্র। ফলে অন্যত্র মাথা গোজার ঠাঁইও করতে পারছে না। জোয়ার-ভাটার বৃত্ত চলতে থাকায় পানি আর বায়ুবাহিত রোগে ভুগছে প্রতিনিয়ত। বর্ষায় হাজারো একর জমিতে চাষাবাদ ছেড়ে দিতে হয় কৃষকদের। শুষ্ক মৌসুমেও হাজার একর লবণ মাঠ অনাবাদি পড়ে থাকে। এসব এলাকার প্রান্তিক চাষিদের গেল সাত বছরে কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সরকার রাজস্ব হারিয়েছে কয়েক কোটি টাকা।

Advertisement

উত্তর ধুরুং ইউপির চেয়ারম্যান আ স ম শাহরিয়ার চৌধুরী জানান, চরধুরুং, আকবরবলীপাড়া, ফয়জানিরবাপের পাড়া, সতরউদ্দিন, কাইছারপাড়া এলাকায় ৭ কিলোমিটার বাঁধ না থাকায় এসব এলাকা দিয়ে সাগরের পানি ঢুকে প্লাবিত হয়। জন্মস্থান রক্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন এলাকা ভিত্তিক নিজ শ্রমে মাটি কেটে জোয়ার ঠেকানোর জন্য রিং বাঁধ দিলেও তা অল্প দিনে বিলীন হয়ে যায়।

কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকট ফরিদুল ইসলাম চৌধূরী বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে জোয়ারে পানি উপচে পড়ায় বেড়িবাঁধ ক্ষতবিক্ষত হয়। জোয়ার-ভাটার দোলাচলে দুলছে উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা। এতে চরম ঝুঁকিতে পড়েছেন উপজেলার প্রায় দুই লাখ মানুষ। সরকার বরাদ্দ দিলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তা সময় মতো শেষ না হওয়ায় জোয়ার-ভাটার দুঃখ যেন দ্বীপবাসীর পিছু ছাড়ছে না।

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী জানান, কুতুবদিয়ায় প্রায় ১৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালে প্রায় ৯২ কোটি টাকার বরাদ্দ হয়। এতে ৯ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার মাটির কাজ, বাকিটা ব্লক বসানো। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে চলমান কাজটির ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর কার্যাদেশ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। গত জুন মাসে কাজটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় মাটিসহ নানা উপকরণ তৈরির পর্যাপ্ত স্থান স্বল্পতার কারণে কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে। ডিপিপি পরিবর্তন হয়েছে, অক্টোবরে শুষ্ক মৌসুম শুরু হলে পুরোদমে কাজ চলবে। স্বল্প সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো তৈরি সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যায়।

কুতুবদিয়া-মহেশখালী আসনের সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, কুতুবদিয়ায় বাঁধভাঙন সমস্যা কয়েক যুগের। শুষ্ক মৌসুমে মেরামত হওয়া বাঁধ বর্ষায় বিলীন হয়ে ভোগান্তি বাড়ায়। ফলে টেকসই বাঁধ নির্মাণের যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করিয়ে এখন কাজ চলমান রয়েছে। এটি বাস্তবায়নে নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। এদিকে বিভিন্ন সমীক্ষায় বলা হয় প্রতি ২ সেন্টিমিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে উপকূলীয় তটরেখা গড় ২-৩ মিটার স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হলে ২০৩০ সাল নাগাদ মূল ভূ-খণ্ডের ৮০ থেকে ১২০ মিটার পর্যন্ত অতিক্রম করবে এবং কালক্রমে দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া ও কক্সবাজার সৈকততীর সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এমনটি হলে হারিয়ে যাবে পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার।

Advertisement

এফএ/এমএস