শেখ আনোয়ার
Advertisement
চা-কফি খাওয়া শরীরের পক্ষে কতোটা ক্ষতিকর? একবাক্যে এর জবাব হচ্ছে-না, ক্ষতির কোনো আশঙ্কাই নেই। বরং সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, শরীরের পক্ষে চা আর কফি দু’টোই খুব উপকারী। এতোটাই উপকারী যে, প্রতিদিন এক থেকে তিন কাপ চা অথবা কফি খেতে পারলে দূরে সরিয়ে রাখা যায় হার্টের অসুখ এবং স্ট্রোক। কিছুদিন আগেও আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, চা-কফি খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো নয়। কিন্তু গত বিশ বছর ধরে সাতাশ হাজার বয়স্ক নারীর ওপর গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন তাদের মত পাল্টে ফেলেছেন। এ গবেষণায় তারা প্রমাণ পেয়েছেন, নিয়মিত বেশ কয়েক কাপ কফি খেলে ‘কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ’র আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়।
আইওয়া উইমেন্স হেলথের করা বিশেষ গবেষণা জানাচ্ছে, নিয়মিত যে খাবার আমরা খাই, তার প্রায় ষাট শতাংশ জ্বালানি আমরা স্বাচ্ছন্দে পেয়ে যেতে পারি এ পানীয় দুটো থেকে। আমাদের শরীরের ধমনীর ক্ষতি করে যে সমস্ত সেল, সেই সেলগুলোকে রক্ষা করে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। চা কফিতে রয়েছে ক্যাফেইন আর পলিফেনল। কার্ডিওভাসকুলার অসুখের ঝুঁকি কমাতে এ পলিফেনলেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ‘রয়্যাল কলেজ অব জেনারেল প্র্যাকটিশনার্স’র ড. সারা জার্ভিস বলেছেন, ‘অত্যধিক ব্যায়াম করা, অত্যধিক মাত্রায় কফি খাওয়া শরীরের পক্ষে অবশ্যই ক্ষতিকর। কিন্তু এগুলোর পরিমিত মাত্রা স্বাস্থ্যের উন্নতিই করে।’
কেমন চা খাবেন? চা সাধারণত তিন রকম হয়। ব্ল্যাক টি, গ্রিন টি এবং ওলং টি। চা পাতা রোস্ট করলে হয় ব্ল্যাক টি, ভাঁপানো হলে হয় গ্রিন টি, আর চায়ের পাতা পুরোপুরি ফার্মেন্টেড করা না হলে সেটা হয় ওলং টি। প্রত্যেকটি চায়ের নিজস্ব গুণাবলী রয়েছে। চা খেলে গায়ের রং কালো হয়ে যাবে। লিভার খারাপ হবে। খাওয়ার পর ভালো করে মুখ পরিষ্কার না করলে নষ্ট হয়ে যাবে দাঁত। আর গরমকালে চা বেশি খেলে ঘুম হবে না- এরকম আরও কত কথা শোনা যায় চা নিয়ে। এসব একদম বাজে কথা। পরীক্ষার আগে রাত জাগার জন্য ফ্লাস্কে ভরে নিয়ে যখন পড়তে বসেছেন, মনে করে দেখুন তো, এরকম কত কথাই না শুনতে হয়েছে বড়দের কাছ থেকে। বেশি চা খেয়ে শরীরের ক্ষতি হতে পারে, খালি পেটে হলে তো কথাই নেই ইত্যাদি। কিন্তু চা নিয়ে অত-শত কথা চায়ের ধোঁয়ার মতো উড়িয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক গবেষণা।
Advertisement
আমেরিকান হেলথ ফাউন্ডেশন এক প্রতিবেদনে জানায়, চা আমাদের শরীরের পক্ষে বিশেষ উপযোগী। গবেষকরা বলেছেন, চায়ে থাকে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। কিন্তু প্রশ্ন হলো- অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আসলে কী জিনিস? মূলত এর আসল নাম অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট পলিফেনল। আমরা রোজ যা খাই, সেই তালিকায় থাকে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। এই যেমন- বিট, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, আলু, টমেটো আর শসায় প্রচুর পরিমাণে থাকে যৌগটি। তবে সমস্যা হলো, সাধারণ অন্য শাক-সবজিতে এর পরিমাণ বেশ-কম থাকে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে যতোটা প্রয়োজন, তা মেটে না এতে। চায়ে কিন্তু এটি অনেক বেশি মাত্রায় পাওয়া যায়। বাইশটি ফল খেলে যে পরিমাণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট পাওয়া যায়, তার চেয়ে বেশি শরীরে ঢোকে চার-পাঁচ কাপ চা খেলে। চায়ে এ যৌগের পরিমাণ নয়শ সাতাশ মিউমোল ট্রোলেক্স। তাই অন্য ফল বা শাক-সবজির চেয়ে শরীরে চায়ের প্রয়োজন অনেক বেশি। আর কে না জানে, গ্রিন টিতে এ অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি। তবে সাধারণ কালো চা-ও খুব পিছিয়ে নেই। প্রশ্ন হলো, অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের কাজটা কী?
হ্যাঁ। এককথায় এর কাজ হচ্ছে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো। তবে এখানেই শেষ নয়, আরও রয়েছে। প্রতিদিন আমরা নানা সমস্যার মুখোমুখি হই। গ্রীষ্মকালের চড়া রোদ মাথায় করে বেরোতে হয়। সময়মতো পুষ্টিকর খাবার-দাবার খাওয়া হয় না। তার ওপর দূষণ তো বেড়েই চলেছে। পরীক্ষা বা অফিসের চাপও সামলাতে কম বেগ পেতে হয় না। অনেক সময়ই দেখা যায়, সারারাত ঘুমানোর পরও ভোরে উঠে মাথাটা ভার ভার লাগছে। কাজে মন বসাতে অসুবিধা হচ্ছে। এসবের কারণ ফ্রি র্যাডিকেলসের দৌরাত্ম্য। অতিরিক্ত স্ট্রেস বা মানসিক চাপ থেকে ফ্রি র্যাডিকেলস জন্মায়। এর কাজ স্নায়ুকে দুর্বল করে দেওয়া। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এর বিরুদ্ধে লড়াই করে সতেজ রাখে শরীরকে। শরীরের কোষের ওপর এমন এক আস্তরণ তৈরি করে যে, কোনো ক্ষতিই করতে পারে না ফ্রি র্যাডিকেলস। রক্ত চলাচল থাকে স্বাভাবিক। হার্ট, প্রেসার বা পেটের রোগ ভালো হয়ে যায়। ক্যান্সার প্রতিরোধেও সাহায্য করে এই চা। এর পলিফেনলিক নির্যাস ক্যান্সার জীবাণুর আক্রমণের আশঙ্কা কমায়।
আর হ্যাঁ। এখন থেকে মনে রাখবেন, চায়ের উপকারিতা শুধু সকালের ভাঙা ঘুমের জড়তা কাটানোতেই সীমাবদ্ধ নয়। চায়ে রয়েছে বহু জাদুকরী গুণ। যা আপনাকে সুন্দর ও সুস্থ রাখতে সহায়ক। প্রচুর ক্যালসিয়াম রয়েছে চায়ে। শরীরের, বিশেষ করে দাঁতের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্যালসিয়াম খুব উপকারী। আগে মনে করা হতো, চা খেয়ে ভালো করে দাঁত না ধুলে মুখের অসুখ হতে পারে। আধুনিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বলছে, চায়ে চিনি না খেতে। কারণ, চিনি আর দুধ ছাড়া চা খেলে মাড়ি শক্ত হয়। চায়ের গুণাগুণ অক্ষুণ্ন থাকে। এ ছাড়া চা’য়ে পলিফেনল রয়েছে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ অ্যান্ডি-অক্সিডেন্ট। যারা ধূমপান করেন, তাদের ধূমপানের ফলে শরীরে সৃষ্ট ফ্রি র্যাডিক্যালস নষ্ট হয় চায়ের গুণে। গ্রিন টি’তে রয়েছে থিয়ানিন, ক্যাফিন, ভিটামিন এ, বি, সি, ই, এফ, ফ্লোরোফিলস এবং মিনারেলস। ভিটামিন ‘এ’ দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে, ভিটামিন ‘বি’ জড়তা কাটাতে সাহায্য করে, ত্বক ভালো রাখে, কোলেস্টরল কমাতে ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
অ্যালকোহলের ফলে অনেক সময় লিভারে টক্সিন তৈরি হয়। চায়ের ভেষজ গুণ ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এ সম্ভাবনাকে রোধ করে। হার্টে রক্ত সঞ্চালন ভালো রাখতে চা বিশেষ কার্যকরী। চায়ে রয়েছে কিছু ভিটামিন, দুটি খনিজ পদার্থ ও পনেরোটিরও বেশি অ্যামাইনো অ্যাসিড। রয়েছে থায়ামিন (ভিটামিন বি) কার্বহাইড্রেট, মেটাবলিজমের জন্য যা দরকার। চায়ে রয়েছে ভিটামিন সি (অ্যাসকরবিক অ্যাসিড) যা শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাছাড়া চায়ে রয়েছে ভিটামিন বি, ফোলিক অ্যাসিড প্রভৃতি। আমাদের শরীরে দিনে দুই থেকে পাঁচ মিলিগ্রাম ম্যাঙ্গানিজের দরকার হয়। পাঁচ থেকে ছয় কাপ চা দুধ ছাড়া পান করলে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ম্যাঙ্গানিজের অর্ধেক বা পঞ্চাশ শতাংশ পূরণ হয়। শরীরের স্বাভাবিক কাজ-কর্মের জন্য প্রয়োজন পটাশিয়ামের। পটাশিয়াম আলস্য কাটায়, ক্লান্তি, অবসাদ, প্রভৃতিকে কাটিয়ে শরীরকে চাঙা করে রাখে। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ কাপ গ্রিন লিফের লিকার শরীরের প্রয়োজনীয় পটাশিয়ামের তিন চতুর্থাংশ পূরণ করে দেয়। চায়ে সামান্য পরিমাণে জিঙ্ক রয়েছে। যা শরীরের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। অতএব হয়ে যাক প্রতিদিন চা-কফি।
Advertisement
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/এএ/এমএস