মতামত

করোনাকালে কী সুযোগ সৃষ্টি হলো?

কোভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাসের অভিঘাত আমাদের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে, আমাদের অনেক এগিয়ে যাওয়াকে থামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই রোগের বিস্তার কিংবা এই সময়টায় আমরা যে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, তা কি কোনো সুযোগও সৃষ্টি করেছে? সেই আলোচনাটাও করতে পারেন অর্থনীতিবিদসহ বিদ্বজনেরা।

Advertisement

গত ৬ আগস্ট বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) গভর্নিং বডির সভার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আজকে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ থাকলেও করোনাভাইরাসের কারণে সব দেশেরই সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু এই সমস্যার মধ্যে দিয়েই কীভাবে আমাদের দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের কাজ করতে হবে। আমাদের বিনিয়োগ পরিবেশটাকে আকর্ষণীয় করতে হবে।’ অর্থাৎ অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে সুযোগ কি আছে তা খতিয়ে দেখতে বলছেন প্রধানমন্ত্রী।

যখন বিদেশি বিনিয়োগের প্রসঙ্গ আসে, তখন একটা কথা সরবে উচ্চারিত হয় যে, বাংলাদেশ বিনিয়োগের উৎকৃষ্ট স্থান। কিন্তু বহুদিন ধরেই দেশীয় বিনিয়োগের যেমন মন্দাবস্থা, তেমনি বিদেশি বিনিয়োগেরও। বিনিয়োগ টানার দৌড়ে বহুদিন ধরেই পেছনের সারিতেই পড়ে আছে বাংলাদেশ। সারাবিশ্বে যে বিনিয়োগ হচ্ছে, তার অতিসামান্য অংশই এসে পড়ছে বাংলাদেশের ঝুলিতে। বাংলাদেশ না হয়ে কেন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বা থাইল্যান্ড বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের কাছে বড় বিকল্প সেটা ভাবনায় আনা প্রয়োজন নীতিনির্ধারকদের। গ্ল্যাক্সো চলে গেছে, স্যানোফি এভেন্তিস যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিসমূহকে আমরা টানতে পারছি না, বরং যারা আছে তারা কেন চলে যাচ্ছে সেটা জানা দরকার, তবেই সুযোগ কীভাবে সৃষ্টি করা যাবে সেই ভাবনা মাথায় আসবে।

বিদেশি বিনিয়োগ টানতে কয়েকটি বিষয় বড় ভূমিকা রাখে। প্রথম কাজ যৌক্তিক অবকাঠামো, যেটির দিকে শেখ হাসিনার সরকার প্রথম থেকেই নজর আছে। বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বেড়েছে অনেক। দ্বিতীয় দিকটি হলে আর্থিক খাত। একটা সুশাসিত স্থিতিশীল আর্থিক খাত আমাদের বড় বেশি প্রয়োজন। কর কাঠামো, কর ব্যবস্থাপনা এবং কর আদায় পদ্ধতি কেন অতি মাত্রায় নিবর্তনমূলক সেটা ভেবে সংস্কারের পদক্ষেপ নেয়া একটা বড় সুযোগ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রযুক্তি ও মেধাভিত্তিক কর্মসংস্কৃতি বিদেশি বিনিয়োগ টানায় বড় ভূমিকা রাখে।

Advertisement

স্থিতিশীল নীতিসহায়তা আর শক্তিশালী বিচারব্যবস্থার প্রয়োজনকেও খাটো করে দেখা যায় না। বাংলাদেশে দ্রুততম সময়ে নীতি বদলে যায়। ফলে বিনিয়োগকারীরা একপ্রকার সংশয়ে দিনানিপাত করে। জুন মাসে বাজেট আসে, আসে নতুন নীতি ও পুরোনো নীতির পরিবর্তন। নীতির স্থায়িত্ব কেন ধরে রাখা বা বজায় রাখা যায় না, তার কোনো সদুত্তর নেই। শুধু কাস্টমসের এইচ এস কোডের বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা যে ব্যবসায়ীদের কত হয়রানি করে, সেগুলো নিয়ে হয়তো মহাকাব্য লেখা যাবে। বাংলাদেশ নিজেকে যদি বিশ্ব বাণিজ্যের সক্রিয় অংশীদার হিসেবে দেখতে চায় তাহলে হঠাৎ হঠাৎ নীতির পরিবর্তনের এই খেলা থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ এই একটি কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শুধু বিভ্রান্তিতেই পড়ে না, বিরক্ত হতেও তাদের সময় লাগে না।

আরেকটি হলো বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা। কোনো মামলা হলে সেটা কর-সংক্রান্ত হোক বা অন্য কোনো বিষয় হোক, লম্বা সময় লাগায় বিনিয়োগ ছেড়ে পালাতে চায় উদ্যোক্তারা। শিল্পের জন্য এক বড় সমস্যা জমি। সহজে নির্বিরোধ বড় জমি তেমন মেলে না। জমি পেলেও উপযোগী অবকাঠামো ও ইউটিলিটি সুবিধা থাকে না। জমি মানেই বিরোধ, সাথে আইনের গেরো। সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টির যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে সেটি জমির সংকট দূর করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে সেসবের বিতরণ ও ব্যবস্থাপনা কতটা দক্ষতার সাথে হচ্ছে বা হবে সেটা দেখার বিষয়। ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, অনেক অন্তরায়ের এক বড় অন্তরায় দেশের ভাবমূর্তি আর আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার ফাঁস।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের উপস্থিতি শক্তিশালী হচ্ছে। করোনার সময়ে, আমেরিকার সাথে বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চীন থেকে সরছে বহু কোম্পানি। চীন নিজেই স্থানান্তর করছে তাদের অনেক শিল্পকারখানা। সম্প্রতি পোশাক রফতানিতে ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে পেছেনে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। পোশাক খাতের অনেকেই মনে করেন ভিয়েতনামে চীনের বিনিয়োগ এই ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছে। চীন বাংলাদেশে এসেছে ঠিকাদারি করতে, আর ভিয়েতনামে গেছে বিনিয়োগ নিয়ে।

প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক আকাঙ্ক্ষা থাকার পরও কেন বিনিয়োগে গতি আসে না সে প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ করলে তাদের অনেকে বলেন, সমস্যা হলো যথাস্থানে উদ্যমের অভাব। জমি, জমির দাম, আইন ও বিধির গ্যাঁড়াকল, আমলাতন্ত্রের জটিলতার বাইরেও দেশজুড়ে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, বাণিজ্য-আঙিনায় চাঁদাবাজি, আইনশৃঙ্খলা এবং সার্বিকভাবে দেশের শিল্প-প্রতিকূল ভাবমূর্তির সুবাদে বিশেষ বড় বিনিয়োগ বাড়ছে না।

Advertisement

এই সমস্যার সমাধান বড় সুযোগ সৃষ্টি করবে বলেই বিশ্বাস ব্যবসায়ীদের। ব্যাংক থেকে টাকা মেরে, প্রকল্পের টাকা নয়ছয় করে বিদেশে টাকা পাচার করা, বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার হিড়িক বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তলানিতে নিয়ে গেছে। এসব কাণ্ডও সৎ ব্যবসায়ীকে হতোদ্যম করে।

নীতির স্থায়িত্ব না থাকা, আইনি জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা, আমলাতন্ত্রের লাল ফিতা, জমির সংকট, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রশাসনে বল্গাহীন দুর্নীতির কারণে সৃষ্ট নেতিবাচক ভাবমূর্তি দেখে এখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীতো দূরের কথা, অনাবাসী বাংলাদেশিরাও টাকা ঢালতে সাহস করছেন না। বিনিয়োগ আকর্ষণে দেশ আন্তরিক কিনা, হলে কতটা আন্তরিক, তা নিয়ে ঘোর সংশয় সর্বত্র। বাংলাদেশের এই ভাবমূর্তি পুনরুজ্জীবন কোন পথে সম্ভব, পুনরুজ্জীবিত দেশের ছবি বিশ্বের দরবারে কীভাবে তুলে ধরা যাবে সেই ভাবনার বাস্তবায়নই করোনাকালের সবচেয়ে বড় সুযোগ বলে মনে করছি।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস