>> বিনিয়োগকারীদের অন্ধকারে রাখতে চায় অনেক ব্রোকারেজ হাউজ>> চার বছরে এক শতাংশ বিনিয়োগকারী টেনেছে ডিএসই মোবাইল অ্যাপ>> অ্যাপ ব্যবহার না করার প্রধান কারণ ‘শিক্ষিত বিনিয়োগকারীর অভাব’
Advertisement
বেশ ঘটা করেই ২০১৬ সালের ৯ মার্চ ‘ডিএসই মোবাইল’ নামে একটি অ্যান্ড্রয়েডভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন চালু করে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এরপর একে একে চার বছর কেটে গেলেও অ্যাপটি ব্যবহারে বিনিয়োগকারীদের তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। মাত্র এক শতাংশের মতো বিনিয়োগকারী বর্তমানে অ্যাপটি ব্যবহার করছেন।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের লক্ষ্যে ডিএসই মোবাইল অ্যাপ চালু করা হয়। অ্যাপটি ব্যবহারে বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন। এটি ব্যবহারে বাড়তি ফি দিতে হয় না। যখন খুশি তখন নিজের পোর্টফোলিও দেখা যায়। শেয়ার ক্রয় বা বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে ম্যাসেজ পাওয়া যায়।
নানা সুবিধার পরও সচেতনতার অভাবে অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুবই সামান্য বলে অভিমত তাদের। এছাড়া কিছু ব্রোকারেজ হাউজ ইচ্ছা করেই বিনিয়োগকারীদের অ্যাপ ব্যবহারে আগ্রহী করেন না। বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য আড়ালের জন্য তারা এমনটি করেন বলে একাধিক ব্রোকারেজ হাউজের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
Advertisement
এ বিষয়ে ডিএসই’র এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, কোনো কোনো ব্রোকারেজ হাউজ গোপনে গ্রাহকের বিও অ্যাকাউন্টের শেয়ার বিক্রি করে দেন। বিনিয়োগকারীরা মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করলে হাউজগুলো এই সুযোগ পাবে না। কারণ তখন লেনদেনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকের মোবাইলে ম্যাসেজ চলে যাবে। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করুক— এ ধরনের হাউজগুলো চায় না।
তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হোক, এটা অনেক ব্রোকারেজ হাউজ চায় না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, অনেক ব্রোকারেজ হাউজের সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ঘাটতি রয়েছে। তার মানে, এসব হাউজ গ্রাহকের অজান্তে টাকা তুলে নিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের সচেতনতার অভাব থাকায় হাউজগুলো এমন অনৈতিক কাজ করছে। বিনিয়োগের আগে অন্তত বিনিয়োগকারীর কী কী অধিকার আছে সেগুলো জানা উচিত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএসই মোবাইল অ্যাপে তিনটি সংস্করণ রয়েছে। এর মধ্যে দুটি বিনিয়োগকারীদের জন্য। একটি ব্রোকারেজ হাউজের জন্য। বিনিয়োগকারীদের জন্য থাকা দুটি সংস্করণ হলো- ‘ডিএসই মোবাইল ভিআইপি’ ও ‘ডিএসই মোবাইল ট্রেডার’।
গত ৭ সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, এই দুই সংস্করণে বর্তমানে নিবন্ধিত বিনিয়োগকারী আছেন ২১ হাজার ৯৮৩ জন। এর মধ্যে ডিএসই মোবাইল ভিআইপি-তে নিবন্ধিত ৩৫৭ জন এবং ডিএসই মোবাইল ট্রেডারে নিবন্ধিত ২১ হাজার ৬২৬ জন।
Advertisement
অপরদিকে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর জন্য থাকা সংস্করণ ‘ডিএসই ইনভেস্টর’-এ নিবন্ধিত ১০ হাজার সাতজন। এ হিসাবে ডিএসই’র মোবাইল অ্যাপে নিবন্ধিতের সংখ্যা ৩১ হাজার ৯৯০ জন। অথচ সিডিবিএল’র তথ্য অনুযায়ী, বিও হিসাব সচল রয়েছে ২৩ লাখ ২৩ হাজার ৫১৫টি। অর্থাৎ মাত্র ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ বিনিয়োগকারী ডিএসই’র মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করছেন।
এদিকে ডিএসই’র মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে মাসিকভিত্তিতে ১৫০ টাকা ফি নেয়ার পরিকল্পনা করে ডিএসই কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ডিএসই’র পর্ষদ। ফলে অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন করা বিনিয়োগকারীদের বাড়তি কোনো ফি দিতে হচ্ছে না। অবশ্য নিবন্ধনের পরও যারা নিয়মিত অ্যাপ ব্যবহার করেন না তাদের নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২২ হাজার ৯৪৬ বিনিয়োগকারী মোবাইল অ্যাপ থেকে বাদ পড়েছেন।
গত ১৭ আগস্ট ডিএসই’র পর্ষদ সভায় নিবন্ধন নেয়ার পরও অ্যাপ ব্যবহার করেন না— এমন বিনিয়োগকারীদের বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় অ্যাপে নিবন্ধিত বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ৫৪ হাজার ৯৩৬ জন। এর মধ্যে ডিএসই মোবাইল ভিআইপি-তে এক হাজার ৫৬৪ জন, ডিএসই মোবাইল ট্রেডারে ৩৫ হাজার ৫৩৬ জন এবং ডিএসই ইনভেস্টরে ১৭ হাজার ৮৩৬ জন নিবন্ধিত ছিলেন।
যোগাযোগ করা হলে মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আশিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। যে কারণে ডিএসই’র মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুবই কম। অথচ এটি ব্যবহার করলে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিও হিসাবের সব তথ্য যখন খুশি জানতে পারতেন। হাউজ বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে কোনো তথ্য গোপনের সুযোগ পেত না।
“আমাদের বিনিয়োগকারীদের কী অধিকার, অধিকাংশ বিনিয়োগকারী তা জানেন না। মেইলে বিনিয়োগকারীদের নিয়মিত স্টেটমেন্ট পাওয়ার অধিকার আছে। অথচ আমার কাছে কিছুদিন আগে এক ব্রোকারেজ হাউজের বিনিয়োগকারী এসে বললেন, ‘এক মাসেরও বেশি সময় হয়েছে ব্রোকারেজ হাউজ থেকে তাকে কোনো স্টেটমেন্ট দেয়া হয় না।’ ওই বিনিয়োগকারী কেন এক মাস অপেক্ষা করলেন? তার তো উচিত ছিল আরও আগেই বিএসইসি, সিডিবিএল ও ডিএসই’র কাছে যাওয়া।”
শেয়ারবাজারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত বিনিয়োগকারী ইব্রাহিম হোসেন। মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার না করা এই বিনিয়োগকারী বলেন, ব্রোকারেজ হাউজের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ হয়। ফোন করে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের আদেশ দেই। শেয়ার বিক্রির টাকা হাউজ সরাসরি অনলাইন মাধ্যমে আমার ব্যাংকের হিসাবে পাঠিয়ে দেয়। তবে শেয়ার কেনার টাকা জমা দিতে যাওয়া লাগে। এতে কোনো সমস্যা হয় না। এ কারণে অ্যাপ ব্যবহার করি না।
ডিএসই’র মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করেন রহিম শেখ। বলেন, অ্যাপে লেনদেন খুবই সহজ। আমার পোর্টফোলিও দেখতে হাউজে যাওয়া লাগে না। বাসায় বসে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে যখন খুশি পোর্টফোলিও দেখতে পারি। কোনো লেনদেন করলে সঙ্গে সঙ্গে ম্যাসেজ পাই।
সার্বিক বিষয়ে ডিএসই’র পরিচালক মো. রকিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বিনিয়োগকারীদের ডিএসই মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে আমরা এর মাধ্যমে লেনদেনের ফি মওকুফ করে দিয়েছি। মোবাইল অ্যাপ দিয়ে লেনদেন করলে বিনিয়োগকারীদের কোনো বাড়তি ফি দেয়া লাগে না। আসলে আমাদের শিক্ষিত বিনিয়োগকারীর অভাব। যে কারণে অ্যাপে নানা সুবিধা থাকার পারও বিনিয়োগকারীরা সেটা ব্যবহার করছেন না।
কীভাবে ব্যবহার করতে হয় ডিএসই মোবাইল অ্যাপ
যেকোনো বিনিয়োগকারী ডিএসই মোবাইল অ্যাপটি গুগল প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে পারবেন। ডাউনলোডের পর এটি ব্যবহারের জন্য বিনিয়োগকারীকে ব্রোকারেজ হাউজ থেকে একটি ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড নিতে হয়। ওই ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড নেয়ার পর অ্যাপটির মাধ্যমে শেয়ার কেনা-বেচার আদেশ দিতে পারেন বিনিয়োগকারী। আদেশ কার্যকর হলে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে তার মোবাইলে একটি এসএমএস যায়।
কোন সংস্করণে কী
ডিএসই ইনভেস্টর সংস্করণ দিয়ে হাউজগুলো ডিলার হিসেবে শেয়ারের সর্বশেষ তথ্য জানার পাশাপাশি শেয়ার কেনা-বেচার আদেশ দিতে পারেন। অপরদিকে ডিএসই মোবাইল ভিআইপি দিয়ে সরাসরি লেনদেন করা যায় না। এটি দিয়ে মোবাইলে পোর্টফোলিও দেখা যায়। ডিএসই মোবাইল ট্রেডার দিয়ে বিনিয়োগকারী নিজেই লেনদেন সম্পন্ন করতে পারেন। তবে বাজারদরের চেয়ে বেশি দরে লেনদেনের অফার বা অর্ডার করলে সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউজ তা বাতিল করতে পারে।
এমএএস/এমএআর/জেআইএম