২০০৬ সালের আইনেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনালের বিধান ছিল। এরপর ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও আপিল ট্রাইব্যুনালের বিধান রাখা হয়।
Advertisement
এরই মাঝে ২০১৩ সালে সাইবার ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরু হয়। যাত্রা শুরুর বছরে একাধিক মামলার রায়ও আসে। তবে, সাত বছর অতিবাহিত হলেও এখনও গঠিত হয়নি আপিল ট্রাইব্যুনাল। ফলে, সাইবার ট্রাইব্যুনালের রায় বা আদেশে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারছেন না বিচারপ্রার্থীরা।
যেখানে এ ধরনের অন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে আপিল ট্রাইব্যুনাল আছে। সাইবার ট্রাইব্যুনালের মামলায় আপিল ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় ভরসা করতে হয় হাইকোর্টের ওপর। সেখানেও রয়েছে বিপত্তি। কারণ ফৌজদারি অপরাধের এখতিয়ারভুক্ত হাইকোর্ট বেঞ্চ সাইবার মামলার বিষয়ে শুনানি করতে চান না। যদিও হাইকোর্টের যেকোনো ক্রিমিনাল কোর্টে সাইবার আইন সংক্রান্ত মামলার শুনানির এখতিয়ার রয়েছে।
২০১৭ সালে ফরিদপুরের একটি মামলায় পুলিশের দেয়া ফাইনাল রিপোর্টে (চূড়ান্ত প্রতিবেদন) বাদীপক্ষ সংক্ষুব্ধ হন। তাদের নারাজি আবেদন খারিজ হয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে। আপিল ট্রাইব্যুনাল না থাকায় ন্যায় বিচার পেতে একমাত্র হাইকোর্টে যাওয়ার পথই তাদের জন্য খোলা ছিল। পরে তারা হাইকোর্টে ফৌজদারি রিভিশন আবেদন করেন।
Advertisement
একইভাবে ট্রাইব্যুনালে মামলা নিষ্পত্তি, রায়ে সাজা বা জরিমানা বৃদ্ধি করতে এবং খালাসের বিরুদ্ধে বাদী-বিবাদী পক্ষের আপিল বা রিভিশনের সুযোগ না থাকায় দারুণ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে অনেককে। আইসিটি আইনে এখন পর্যন্ত ৭৫২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, ১৫টি মামলার রায়ে সাজা হয়েছে ১৯ জনের। ৯১ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। এসবের বিরুদ্ধে একমাত্র হাইকোর্টে যাওয়ার সুযোগ ছিল উভয়পক্ষের। যেখানে আপিল ট্রাইব্যুনাল থাকলে হাইকোর্টে যাওয়ার দরকার ছিল না।
আইনে সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনালের বিধান থাকার পরও তা গঠন না করায় বিষয়টিকে ‘ন্যায় বিচারের পরিপন্থী’ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন না করা আইনের বরখেলাপ। আইনের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য আইন— এ বিবেচনায় দ্রুত সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের পক্ষে মত দেন তারা।
আইসিটি আইনের তৃতীয় অংশে সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। ৮২ (১) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকার প্রজ্ঞাপন দ্বারা এক বা একাধিক সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। দফা (২)-এ বলা হয়েছে, আপিল ট্রাইব্যুনালে সরকার নিযুক্ত একজন চেয়ারম্যান এবং দুজন সদস্যকে নিয়ে গঠিত হবে। (৩) দফায় বলা হয়েছে, আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এমন একজন ব্যক্তি হবেন যিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ছিলেন বা বিচারক নিযুক্তের যোগ্য এবং সদস্য হবেন যিনি বিচার বিভাগের কর্মকর্তা অথবা অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ বা অন্যজন হবেন আইসিটি বিষয়ে নির্ধারিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ। তাদের মেয়াদ হবে অন্যূন তিন বছর এবং অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর।
এখানে এখতিয়ার ও পদ্ধতি রয়েছে ৮৩ ধারায়। এ ধারার (১) দফায় বলা হয়েছে, সাইবার ট্রাইব্যুনাল এবং ক্ষেত্র মতে দায়রা আদালতের রায় ও আদেশের বিরুদ্ধে আপিল শোনা ও নিষ্পত্তির এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালের থাকবে। আপিল শোনা ও নিষ্পত্তিতে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করবে আপিল ট্রাইব্যুনাল। বিধি না থাকলে হাইকোর্ট বিভাগের ফৌজদারি আপিল শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য যে পদ্ধতি অনুসৃত হয়ে থাকে তা অনুসৃত হবে। সাইবার ট্রাইব্যুনালের রায় বা আদেশ বহাল, বাতিল, পরিবর্তন বা সংশোধনের ক্ষমতা থাকবে আপিল ট্রাইব্যুনালের।
Advertisement
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘আইসিটি আইন ও ডিজিটাল আইনের অপপ্রয়োগ হয়ে আসছে। এজন্য বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি কমাতে আইনের বিধান অনুসরণ করে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত। তাহলে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে সেখানে ন্যায় বিচারের আশায় যেতে পারবেন।’
হাইকোর্টে আপিল করতে হচ্ছে সংক্ষুব্ধদের
সাইবার ট্রাইব্যুনাল আইনের ৮৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই অংশের অধীন কোনো সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠিত না হলে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, দায়রা আদালত বা ক্ষেত্র মতে সাইবার ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত রায় ও আদেশের বিরুদ্ধে আপিল হাইকোর্ট বিভাগেই করতে হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাইকোর্টে ফৌজদারি আপিল বা রিভিশনের তিনটি বেঞ্চ রয়েছে। সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে বেঞ্চের পক্ষ থেকে শুনানি গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করা হয়েছে শুধুমাত্র ডিজিটাল মাধ্যমের সক্ষমতা না থাকায়। হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ এবং হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের নেতৃত্বে অপর একটি দ্বৈত বেঞ্চসহ আরও বেশ কয়েকটি বেঞ্চে সাইবার ট্রাইব্যুনালের রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বা দরখাস্তের শুনানি গ্রহণ করে থাকেন।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাইবার ট্রাইব্যুনালের আদেশ বা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ পক্ষগুলো সংক্ষুব্ধ হবেই। আইনেও আপিল ট্রাইব্যুনালের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেন আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়নি, তা বোধগম্য নয়। দ্রুত এর সমাধান হওয়া উচিত।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘সাইবার ট্রাইব্যুনাল যে আইনে কাজ করছে সে আইনেই আপিল ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। একটি গঠন হলেও অপরটি করা হয়নি। অথচ আপিল ট্রাইব্যুনাল না থাকা নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে না।’
‘কেউ ট্রাইব্যুনালের আদেশ বা রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে তারা যাবেন কোথায়? উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক বেঞ্চ এ বিষয়ে অভিজ্ঞ নয় বলে শুনানিতে আগ্রহী হন না। অনেক আগেই আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত ছিল। এটা না করা প্রতারণার শামিল।’
সুপ্রিম কোর্টের অপর আইনজীবী মুহাম্মদ শিশির মনির জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন না হওয়ায় ঢাকায় অবস্থিত একটি ট্রাইব্যুনালের ওপর মামলার ব্যাপক চাপ পড়ছে। একই সঙ্গে বিচারের গতিশীল প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন না হওয়ায় সেই সাতক্ষীরায় যদি একটি মামলা হয়, সেই মামলার আসামিকেও ঢাকার ট্রাইব্যুনালে এসে হাজিরা বা মামলার শুনানি করতে হয়। এতে জনগণের অর্থ ও সময়ের অপচয় হচ্ছে, বাড়ছে নাগরিক দুর্ভোগ। নাগরিক দুর্ভোগ দূর করতে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিভাগগুলোতে সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা দরকার।’
এফএইচ/এমএআর/জেআইএম