১৯৬১ সালের ডিসেম্বরে পৃথিবীর সব দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করতে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো দিবসটি প্রথম উদযাপন করে। তবে বাংলাদেশে পালিত হয়ে আসছে ১৯৭২ সাল থেকে।
Advertisement
দিনটি উদযাপনের লক্ষ্যে প্রতি বছরই একটি থিম নির্ধারণ করে থাকে ইউনেস্কো। এ বছরে থিম নির্ধারণ করা হয়, ‘করোনা মোকাবিলায় ও পরবর্তীতে সাক্ষরতা শিখন ও শিক্ষণে শিক্ষাবিদের ভূমিকা এবং শিক্ষানীতির পরিবর্তন’ এই থিম বাস্তবায়নে বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ কিংবা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে বিশ্লেষণ করার আগে একটু সাক্ষরতার আদ্যপান্তো নিয়ে জেনে আসি। সাক্ষরতা বলতে সাধারণত অক্ষর জ্ঞানসম্পন্নতাকেই বোঝায়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিসরে ‘সাক্ষরতা’ শব্দের প্রথম উল্লেখ দেখা যায় ১৯০১ সালে লোক গণনার অফিসিয়াল ডকুমেন্টে। শুরুতে স্ব অক্ষরের সঙ্গে অর্থাৎ নিজের নাম লিখতে যে কয়টি বর্ণমালা প্রয়োজন তা জানলেই তাকে স্বাক্ষর বলা হতো।
১৯৪০ এর দিকে পড়ালেখার দক্ষতাকে সাক্ষরতা বলে অভিহিত করা হত। ষাটের দশকে পড়া ও লেখার দক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে সহজ হিসাব-নিকাশের যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষই স্বাক্ষর মানুষ হিসেবে পরিগণিত হতো। আশির দশকে লেখাপড়া ও হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি সচেতনতা ও দৃশ্যমান বস্তুসামগ্রী পঠনের ক্ষমতা সাক্ষরতার দক্ষতা হিসেবে ধরা হয়। দিনেদিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে এর পরিধি।
১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো একে পুনঃসংজ্ঞায়িত করে। এখন শুধু স্বাক্ষর জ্ঞান থাকলেই সাক্ষরতা বলা চলে না। অক্ষরজ্ঞান সম্পন্নদের সাক্ষর বলা হয় না এর সঙ্গে জীবনধারণ, যোগাযোগ দক্ষতা ও ক্ষমতায়নের দক্ষতাও যুক্ত হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন কেউ নাম লিখতে পারলেই তাকে সাক্ষর বলা হত।
Advertisement
বর্তমানে যিনি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারবেন, সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারবেন এবং দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ হিসাব-নিকাশ করতে পারবেন তাকে আমরা সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন বলব। বর্তমানে এ সাক্ষরতার সঙ্গে যোগাযোগের দক্ষতা, ক্ষমতায়নের দক্ষতা, জীবন নির্বাহী দক্ষতা, প্রতিরক্ষায় দক্ষতা এবং সাংগঠনিক দক্ষতাও সংযোজিত হয়েছে। সাক্ষরতা একটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার সঙ্গে সাক্ষরতার আর সাক্ষরতার সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে দেশের সাক্ষরতার হার যত বেশি সে দেশ তত উন্নত। বাংলাদেশের বর্তমান সাক্ষরতার হার ৭৩.৯ শতাংশ। এ হিসাব বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত। উইকোপিডিয়া এবং ইউনেস্কোর তথ্য মতে, বাংলাদেশের বর্তমান সাক্ষরতার হার ৭৩.৯ শতাংশ। বিশ্বে র্যাংকিংয়ে এর অবস্থান ১২৯তম। প্রথমে রয়েছে এন্ত্রোয়া, গ্রিনল্যান্ড, কোরিয়া, উজবেকিস্তান যৌথভাবে। সাক্ষরতার হার ১০০ ভাগ। আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতের সাক্ষরতার হার আমাদের থেকে কিছুটা বেশি। সাক্ষরতার হার ৭৪.৪ শতাংশ। বিশ্বে অবস্থান ১২৮তম। মিয়ানমারের সাক্ষরতার হার ৭৫.৬ শতাংশ বিশ্বের ১২৬তম। পাকিস্তানের সাক্ষরতার হার ৫৯.১ শতাংশ যা বিশ্বের ১৪৭ তম। করোনাকালীন সারাদেশের সাক্ষরতা দক্ষতাগুলো অর্জনের পাশাপাশি একুশ শতকের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে এক চমৎকার ও সময়োপযোগী পদ্ধতি হতে পারে ‘খেলায় খেলায় শিখন’। শিশু শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে যে কোনো বয়সের শিক্ষার্থীদের জন্য এই খেলায় খেলায় পদ্ধতি শ্রেণিতে বা শ্রেণির বাইরে মজা করে করে ব্যবহার খেলাতে পারেন।
খেলায় খেলায় শিখন পদ্ধতিটির ডিজাইন করেছে বাংলাদেশের অন্যতম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘আলোকিত হৃদয় ফাউন্ডেশন’। আলোকিত মানুষ গড়ার প্রত্যয়ে পথচলা শুরু আলোকিত হৃদয় ফাউন্ডেশনের। এই পদ্ধতির মূলনীতি চারটি যথাক্রমে (১) উদ্দেশ্য (২) নিয়ম (৩) মূল্যায়ন এবং (৪) পুরস্কার। শিক্ষার্থীদের সাক্ষরতা দক্ষতাগুলো যেমন পড়তে পারা, লিখতে পারা এবং গণনা করতে পারার দক্ষতাগুলো খেলায় খেলায় অর্জন করতে পারে। অনেক খেলার মধ্যে একটা মজার খেলা নিয়ে লিখব। খেলাটির নাম হলো, ‘থ্রো দ্য বল’ বা বল ছুঁড়ে দেওয়ার খেলা। এই খেলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অথবা অক্ষর শেখানো যায়। সংখ্যা বা অক্ষর বলতে পারার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা যেন লিখতে পারে ও বলতে পারে এই উদ্দেশ্যকেই সামনে রাখতে হবে।
তারপর নিয়মটা বলে দিতে হবে। বলটি প্রথমে যার হাতে থাকবে সে গণনা শুরু করবে বা প্রথম অক্ষরটি বলবে তারপর বলটি অন্য যে কাউকে ছুঁড়ে দেবে। যে শিক্ষার্থী বলটি পাবে সে পরবর্তী বর্ণ বা সংখ্যা টি বলবে এবং একইভাবে বলটি ছুঁড়ে দেবে অন্য কাউকে। এভাবে বলটি ঘুরতেই থাকবে যতক্ষণ সংখ্যা বা অক্ষর বলা শেষ না হয়। খেলাটি শেষ হলে শিক্ষার্থীদের বলবেন খাতায় সংখ্যা বা অক্ষর লিখতে এভাবে লেখার অভ্যাসটিও হয়ে যাবে।
খেলাটি অনলাইনেও সম্ভব। অনলাইনে একটি কাগজ ছুঁড়ে দিয়ে নাম বলবে যে কাকে ছুঁড়ে দিল। সে সংখ্যা বা অক্ষরটি বলে অন্য জনকে ছুঁড়ে দেবে। সেও পরবর্তী সংখ্যা বা অক্ষরটি বলবে। এভাবে অনলাইনে থাকা সবাই খেলতে পারে। খেলা শেষে খেলা এবং খাতায় লেখা দেখে মূল্যায়ন করা যায়। মূল্যায়ন শেষে তো পুরস্কার দিতেই পারেন। তবে হ্যাঁ পুরস্কার কোনো খাবার যেমন চকলেট না দেওয়াই ভালো। শিক্ষা পদ্ধতির তিনটি ধাপ আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক বা উপানুষ্ঠানিকের মধ্যে সাক্ষরতা অর্জনের কার্যকরী উপানুষ্ঠানিক উপায়ে খেলা খেলায় শিখন পদ্ধতিটি ব্যবহার করে সাক্ষরতা অর্জনে সফল হওয়া যাবে। এই খেলায় খেলায় পদ্ধতি ব্যবহার করে খুব সহজেই আনন্দের মাধ্যমে সাক্ষরতার দক্ষতাগুলো অর্জন করতে পারবে। শিক্ষাবিদরা কিংবা শিক্ষা অনুসন্ধানীরা চাইলেই করোনার এই সময়ে খেলায় খেলায় শিখন পদ্ধতিটি নিয়ে ভাবতে পারেন। জানতে পারেন বিস্তারিত আলোকিত হৃদয় ফাউন্ডেশন ওয়েবসাইটে। শিক্ষানীতির পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখতে পারে খেলায় খেলায় শিখন পদ্ধতিটি। সময়পযোগী ভাবনায় শিক্ষানীতি পরিবর্তন, পরিমার্জন করে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হারকে বৃদ্ধি করতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। আসুন আমরা সবাই সচেতন হই। আলোকিত মানুষ গড়ার আন্দোলনে একসঙ্গে কাজ করি আলোকিত হৃদয় ফাউন্ডেশনের সাথে। এমআরএম
Advertisement