গোপালগঞ্জের রাজিব বিশ্বাস। ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন রাজধানীর শ্যামলী আইডিয়াল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে। করোনায় চাকরির সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করতে থাকেন। এ সময় ফেসবুকে পেয়ে যান ‘চমকপ্রদ চাকরির বিজ্ঞপ্তিও’। বিমানবন্দরে নির্মাণাধীন থার্ড টার্মিনালের সাইট ইঞ্জিনিয়ার পদে, উল্লেখিত পদে বেতনও আকর্ষণীয়। মাসিক ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। আবেদনও করেন চাকরির সন্ধানে থাকা রাজিব। এতেই পা দেন প্রতারণার ফাঁদে।
Advertisement
চাকরিটি পেতে রাজিব যোগাযোগ করেন এশিয়ান ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। চাকরি দেয়ার নামে প্রতিষ্ঠানটি তার বাবার কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ৭০ হাজার টাকা। আরও ৩০ হাজার টাকা দিতে হবে চাকরিতে যোগদানের পর। এ জন্য নিয়োগপত্রও দেয়া হয়।
গতকাল রোববার (৬ সেপ্টেম্বর) রাজিব বিশ্বাস বিমানবন্দরে চাকরিতে যোগদান করতে যান। সেখানে গিয়ে তার মতো শুভাংশু বিশ্বাস, নাহিদ মন্ডল ও মধু নামে আরও চারজন জানতে পারেন প্রতারণার বিষয়টি।
বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের কাজ পাওয়া কোরিয়ান কোম্পানি জানায়, ‘ভুয়া নিয়োগপত্রের’ মাধ্যমে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এশিয়ান ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস নামক কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের কোনো চুক্তি বা যোগাযোগ নেই।
Advertisement
এরপর তারা ‘ভুয়া নিয়োগদাতা’ প্রতিষ্ঠান এশিয়ান ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের বনানী কার্যালয়ে গিয়ে জানতে পারেন পুলিশি অভিযানের কথা। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা জানতে পারেন- ওই প্রতিষ্ঠানের মোট পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি।
সিআইডি জানিয়েছে, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে কাজের জন্য নিয়োগ দেয়ার কথা বলে স্যামসাং কোম্পানির নাম ব্যবহার করে ‘ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট’ দেখিয়ে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগে সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রোববার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বনানী ২৭নং রোডের এ ব্লকের হাউজ নং-৪৫ এর ৬ষ্ঠ তলা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতাররা হলেন- এশিয়ান ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের কর্মচারী গোলাম মাজেদ (৫০), অফিস সহকারী নারায়ণ সরকার (৩৫), মো. মেহেদী (১৯), ইমতিয়াজ (৩১) ও এনায়েত উল্লাহ (৪০)।
সিআইডি বলছে, প্রতিষ্ঠানটি প্রতারণার মাধ্যমে সাড়ে ৩০০ চাকরিপ্রত্যাশীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে তিন কোটিরও বেশি টাকা। চাকরি দেয়ার নাম করে ক্ষেত্র বিশেষে একজনের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে চক্রটি। পলাতক রয়েছেন প্রতারণার মূলহোতা প্রতিষ্ঠানটির সত্ত্বাধিকারী আশরাফ খান ওরফে সুলতান মাহমুদ।
Advertisement
এ ঘটনায় আজ সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) বনানী থানায় তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়েছে। মামলাটি করেছেন সিআইডির ঢাকা মেট্রো পশ্চিমের উপ-পুলিশ পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর আলম। মামলা নং-৮। গ্রেফতারদের পাঠানো হয়েছে আদালতে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে সোমবার দুপুরে সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি মিডিয়া) জিসানুল হক বলেন, ‘বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনালের কাজের জন্য লোক নিয়োগের বিষয়ে স্যামসাং কোম্পানির ‘ভুয়া ওয়ার্ক অর্ডার’ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি দেখিয়ে নিরীহ অসহায় মানুষদেরকে লোভনীয় চাকরির কথা বলে অনলাইনে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রার্থীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে আত্মসাৎ করেছে।’
এ বিষয়ে মামলার বাদী ও অভিযানে অংশগ্রহণকারী সিআইডি ঢাকা মেট্রো পশ্চিমের এসআই জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, ৫/৬ জন ভুক্তভোগী সিআইডিকে অভিযোগ করেন যে, বনানী ২৭নং রোডের এ ব্লকের হাউজ নং-৪৫ এর ৬ষ্ঠ তলায় অবস্থিত এশিয়ান ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস নামক প্রতিষ্ঠানের মালিক আশরাফ খান এবং তার সহযোগীরা চাকরি দেয়ার কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে নগদ টাকা গ্রহণ করে ‘ভুয়া চাকরির’ নিয়োগপত্র প্রদান করেছেন। চাকরিতে যোগদান করতে গিয়ে তারা জানতে পারেন ‘ভুয়া নিয়োগপত্র’ সরবরাহ করা হয়েছে।
আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বিষয়টি নিয়ে অফিসে কথা বলতে গেলে প্রতিষ্ঠানটির মালিক আশরাফ খান ও তার লোকজন তাদের হুমকি-ধমকি দিয়ে বের করে দেয়। অভিযোগ পেয়ে উল্লেখিত ঠিকানায় গিয়ে সিআইডির একটি দল আরও অনেক লোকজনের সমাগম দেখতে পায়। তাদের সবাই অভিযোগকারীদের মতোই প্রতারণার শিকার। সবার কাছ থেকে ৫০ থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত গ্রহণ করা হলেও চাকরি মেলেনি। অভিযানকালে অফিসে অনুপস্থিত ছিলেন মালিক আশরাফ খান। তবে অফিসে উপস্থিত বাকি পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা জানায়, ঢাকা শহরে তাদের মালিকের এই ধরনের আরও অফিস ও মেডিকেল চেক-আপ সেন্টার রয়েছে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত কুমিল্লার নোমান হোসেন (২০) নামে এক ভুক্তভোগী অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে এশিয়ান ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মালিক আশরাফ খানের মায়ের অ্যাকাউন্টে ৮০ হাজার টাকা প্রদান করেছেন। সে চেকটি অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয়।
এসআই জাহাঙ্গীর বলেন, ‘একই অফিস থেকে আল ফাইহান মেডিকেল সেন্টারের চেক, রিক্যুইজিশন স্লিপ ১২০টি, তাদের মনোনীত আল ফাইহান মেডিকেল সেন্টারের ভুয়া এবং স্বাক্ষরবিহীন মেডিকেল পরীক্ষার রিপোর্ট ২৪টি, ভুয়া ডাক্তার ও বিভিন্ন নামের সিলমোহর ১০টি, পাসপোর্ট ৩৭টি, বিভিন্ন ব্যক্তির নামে বায়োডাটা ৫৮টি, বিভিন্ন লেনদেন সংক্রান্ত রেজিস্টার ৪টি, মানি রিসিট বই দুটি, সোনালী চাকমার নামে ট্রেড লাইসেন্স একটি এবং ৫টি ভুয়া চাকরির কনফারমেশন লেটার জব্দ করা হয়।’
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এ এম মেরাজ আল মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা বিমানবন্দর থার্ড টার্মিনালের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান স্যামসাংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা জানিয়েছে, এশিয়ান ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস নামক কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের কোনো চুক্তি বা যোগাযোগ নেই। মূলত, স্যামসাংকে সামনে রেখে সুপারভাইজার, সাইট ইঞ্জিনিয়ার, ইঞ্জিনিয়ার ছাড়াও বিভিন্ন পদে চাকরি দেয়ার কথা বলে প্রতারণা করেছে তারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটিতে অভিযানকালে আমরা একটি তালিকা পেয়েছি। সেখানে ৫৩০ জনের নাম পাওয়া গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা জানিয়েছে, কমপক্ষে ৩৫০ জনের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা করে নিয়েছেন তারা।’
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পেরেছি, প্রতিষ্ঠানটির মালিক একজন নারী। আর এসবের দেখভাল করেন মূলহোতা পলাতক সুলতান মাহমুদ। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে বলেও জানান সিআইডির এ কর্মকর্তা।
জেইউ/এফআর/জেআইএম