‘আগে কোন অসুগ (রোগ) অইলেই ওষুধ কিনবার জইন্য বাজারে যাওন লাগতো। এহন এই কমিনিটি কিনিক (কমিউনিটি ক্লিনিক) অায়নে বালাই অইছে। এন আইলে অসুগের কতা কইলেই ওষুধপত্র দেয়। পেশার পরীক্ষা (রক্তচাপ পরীক্ষা) কইরা দেয়। ওষুধ পাই, কিন্তু ডাক্তরতো পাইনা। সপ্তাহে না অইলেই মাসে যুদি একদিন কইরা বড় ডাক্তর আইতো, রোগীগরে দেকতো, তাইলে খুব বালা (ভালো) অইতো।’ কথাগুলো বলছিলেন কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা শেরপুর সদর উপজেলার বলাইরচর ইউনিয়নের জঙ্গলদী দক্ষিণপাড়া গ্রামের লাল মাহমুদ (৫০)। লাঠিতে ভর দিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা বৃদ্ধা ফুলেছা বেওয়া (৬৭) বলছিলেন, সারা রাত তিনি কোমর-হাঁটুর ব্যাথায় চিৎকার করেছেন। এখন দুই টাকা হাতে নিয়ে ওষুধ নেয়ার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকে এসেছেন। ক্লিনিক থেকে দু’টি ওষুধ পেয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, বাবারে এই ডিেপেনসারিডা হওনে খুব বালা অইছে। দিনের বেলায় খোলা থাকে। আইয়া অসুগের কতা কইয়া দুই ট্যাকা দিলে ওষুধ দেয়। ওষুধ খাইয়া আরাম পাইতাছি। সালেহা বেগম (৪৮) নামে এক কৃষাণী কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) মো. হাবিবুল্লাহ মিস্টারের কাছে এসে বললেন, তার রক্তচাপটা মেপে দেখতে। তার চোখে কিছু সমস্যা আছে বলেও জানালেন। সিএইচসিপি রক্তচাপ পরীক্ষা করে বললেন, প্রেশার কিছুটা কম আছে, ১১০ বাই ৭০। ডিম-সবজি পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। সেই সঙ্গে তার হাতে কিছু আয়রন ও ক্যালসিয়াম বড়ি দিলেন। চোখের সমস্যার জন্য দিলেন ড্রপ। সেবা পেয়ে খুশি হয়ে বাড়ির পথ ধরেন সালেহা বেগম। এ সময় তার কাছে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারের তরফে ওষুধতো কম দেয় নাই। ওষুধ পাই, কিন্তু ডাক্তর নাই। ১৫/২০ দিন পরেও যুদি একজন পাস করা ডাক্তর বইতো, তাইলে তো ভালো হতো। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত জঙ্গলদী কমিউনিটি ক্লিনিকে অবস্থান করে দেখা যায়, কখনও দল বেধে, কখনোবা এক-দু’জন করে লোকজন চিকিৎসাসেবা নেয়ার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকে আসছেন। এ তিন ঘণ্টায় ৪৯ জন রোগীকে ওই কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা ও নানা ধরনের ওষুধ দেয়া হয়। চিকিৎসা সেবা নিতে আসা সবারই এক কথা, কোনো দিন এখানে তারা কোনা ডাক্তারকে পাননি। মাঝে মাঝে এমবিবিএস পাস করা ডাক্তাররা এলে তারা আরও উপকৃত হতেন। বেলা পৌনে ১১টার দিকে ওই এলাকার এফডাব্লিওএ (পরিবার কল্যাণ সহকারী) শেফালী আক্তার ক্লিনিকে আসেন। তাকে দেখেই কয়েকজন নারী রোগী ক্লিনিকে প্রবেশ করেন। চিকিৎসা নিতে আসা গর্ভবতী নারীদের টিকা প্রদান ও আয়রণ ট্যাবলেট প্রদান করেন। তিনি তাদের পুষ্টিকার্ড ও টিকা কার্ড পরীক্ষা করেন। কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনা ম্যানুয়েল অনুসারে, প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে একজন করে সিএইচসিপি রয়েছে। এরা প্রকল্পের আওতায় নিয়োগকৃত ছিল। প্রকল্পের মেয়াদ কাছাকাছি চলে আসায় বর্তমানে তাদের মাঝে চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তারা কমিউনিটি ক্লিনিক সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সরকারের কাছে চাকরি স্থায়ীকরণের দাবি জানিয়ে আসছে। এছাড়া একজন করে আয়া থাকলেও তারা এখনও কোনো প্রকার সম্মানি পান না। শনি থেকে বৃহস্পতিবার এই ছয়দিন সকাল ৯নয়টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিক খোলা থাকার কথা। তবে সেবা দেয়ার কার্যক্রম চলে দুপুর ১টা পর্যন্ত। সপ্তাহের ছয়দিনের মধ্যে তিনদিন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের স্বাস্থ্য সহকারী এবং অন্য তিনদিন পরিবার-পরিকল্পনা বিভাগে এফডাব্লিওএ নিয়মিত বসে রোগীদের সেবা দিবেন। এছাড়া মাসে অন্তত একবার ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সরকারী এমবিবিএস চিকিৎসক রোগী দেখার জন্য বসবেন। কিন্তু জঙ্গলদী গ্রামের স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১২ সালের শুরু থেকে সিএইচসিপিদের নিয়োগ দিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকটি চালুর পর থেকে আজ পর্যন্ত একদিনের জন্য কোনো এমবিবিএস চিকিৎসক বসেননি। সপ্তাহে তিনদিনের মধ্যে এক-দুই সপ্তাহ পর পর একবার করে স্বাস্থ্য সহকারী আসেন। আর এফডাব্লিওএ ও সপ্তাহে এক/দুই দিন আসেন। কোনো কোনো সপ্তাহে আবার আসেনও না। তবে ইপিআই ও টিকা দিবসের দিন তারা ক্লিনিকে বসে থাকেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বলাইর চর ইউনিয়নের নব সৃষ্ট ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তারকে ডেপুটেশনে শেরপুর জেলা হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। তিন নং ওয়ার্ডের স্বাস্থ্য সহকারীর পদটিও প্রায় এক বছর ধরে শুন্য। নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। নয় নং ওয়ার্ডের স্বাস্থ্য সহকারীকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়ায় তার পক্ষে নিয়মিত ওই ক্লিনিকে বসা হয়ে ওঠে না। এমন অবস্থা কেবল জঙ্গলদী কমিউনিটি ক্লিনিকেই নয়। জেলার প্রায় সবকটি কমিউনিটি ক্লিনিকের। যেখানে স্বাস্থ্য সহকারীরা রয়েছেন, তারা কমিউনিটি ক্লিনিকে বসে সেবা দেয়াকে অতিরিক্ত ঝামেলা বলে মনে করেন। এজন্য তারা ইপিআই ও টিকা দিবসের দিন ছাড়া অন্য সময় আসতে চান না। জঙ্গলদী কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি মো. হাবীবুল্লাহ মিস্টার জানান, আমরা কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা দিয়ে থাকি। সেই সঙ্গে ওষুধও দেয়া হয়। জটিল রোগী হলে আমরা এখান থেকে হাসপাতালে রেফার করে থাকি। রেফার করা রোগীকে রেফারাল স্লিপ দেয়া হয়। সেই স্লিপ নিয়ে হাসপাতালে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করা হয়। প্রায় ৩০ ধরনের ওষুধ এখান থেকে রোগীদের দেয়া হয়। তিনি জানান, অক্টোবর মাসে ৬১৪ জন মানুষ এ ক্লিনিক থেকে সেবা ও ওষুধ নিয়েছেন। তার মধ্যে ১৬৮ জন পুরুষ, ৩৬৪ জন নারী, ৪৮ জন শিশু ও ৩৪ জন গর্ভবতী-প্রসূতি মা সেবা পেয়েছেন। এক সময় বিনামূল্যে সেবা ও ওষুধ দেয়া হলেও এক বছর যাবত দুই টাকা করে নেয়া হচ্ছে। সেই টাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনা ও দরিদ্র রোগীদের কল্যাণে ব্যয় করা হয়। ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে সেই টাকা জমা-উত্তোলন হয়। আমরা গত এক বছরে সাড়ে সাত হাজার টাকা জমা করে আরও দুই হাজার টাকা যোগ করে সাড়ে নয় হাজার টাকায় ক্লিনিকটির জলছাদ করেছি। ক্লিনিকটির ছাদ চুইয়ে পানি পড়তো এখন সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে দুই টাকা করে নেয়ার জন্য রোগী আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে বলে তিনি জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান, ক্লিনিকটি পরিচালনার জন্য স্থানীয়ভাবে ১৭ সদস্যের একটি পরিচালনা কমিটি ও সহায়তার জন্য ১৫ জন করে ৪৫ সদস্য বিশিষ্ট তিনটি সাপোর্ট গ্রুপ রয়েছে। তাদের সরকার প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই এলাকার মানুষ খুব অসহায়, দরিদ্র। মাঝে মাঝে একজন ডাক্তার আসলে ভালো হতো। টেকনিক্যাল বিষয়ে তারা ভালো পরামর্শ ও সেবা দিতে পারতেন। ভালোভাবে চেকআপ করাতে পারতেন। বিশেষ করে গর্ভবর্তী নারী ও শিশুদের চিকিৎসায় আরও সুফল পাওয়া যেতো। তিনি বলেন, এতদিন উৎসাহ নিয়ে কাজ করলেও আমরা এখন হতাশ। চাকরিটা স্থায়ীকরণ না হলে আমার মতো সিএইচসিপিরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। তাতে করে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো আবার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারের যে যুগান্তকারী সাফল্য সেটা ম্লান হয়ে যাবে। কমিউনিটি ক্লিনিকে দায়িত্ব পালনকারী এফডব্লিওএ শেফালী আক্তার বলেন, আমি রোববার-মঙ্গল-বৃহস্পতিবার এই তিনদিন আর স্বাস্থ্য সহকারী সপ্তাহের অন্য তিনদিন বসার কথা। অনেক সময় দেখা যায়, ক্লিনিকে বসে আছি, নারীরা আসছে না। তখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাদের সেবা দেই। তাছাড়া উঠোন বৈঠক করে কমিউনিটি ক্লিনিকে কী কী সেবা দেয়া হয় সে সম্পর্কে সবাইকে জানাই। অনেক সময় বিভাগীয় কাজের চাপে হয়তো নিয়মিত বসা হয় না, তবে চেষ্টা করি এবং সময় পেলেই ক্লিনিকে বসে সেবা দিয়ে থাকি। জঙ্গলদী কমিউনিটি ক্লিনিকের জমিদাতা মো. ফরহাদ আলী বলেন, আমি ক্লিনিকটির জন্য ৫ শতক জমি সরকারের নামে লিখে দিয়েছি। মানুষ যাতে সেবা পায়, চিকিৎসা পায় সেজন্য জমি দান করেছি। কিন্তু মাঝখানে এটি বন্ধ ছিল, দরজা-জানালা কিছুই ছিল না। মাকড়সা আর ইঁদুর-বেড়ালের বাসা হয়ে গিয়েছিল। তখন মনে খুব কষ্ট লাগতো। দুঃখ হতো, জমিটা দিয়ে তো কোনো লাভ হলো না। আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় আইসা এইটা চালু করনে এহন মনে শান্তি লাগে। যে উদ্দেশ্যে জমিটা দিছিলাম সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে। এখন লোকজন আসে, ওষুধ পায়, চিকিৎসা নেয়, খুব ভালো লাগে। তবে মাসে একবার করে হলেও নিয়মিত একজন বড় ডাক্তার বসলে আরো ভালো হতো।এ ব্যাপারে শেরপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো এখানে তুলনামূলক ভালোই চলছে। গ্রামের মানুষ কিছুটা হলেও স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে, ওষুধ পাচ্ছে। জেলায় বর্তমানে ১৬৩টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে ১৫৯টি সচল আছে। অন্য চারটির মধ্যে কোনটির ভবন নির্মাণাধীন কিংবা পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। সদর উপজেলায় ৫২টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। তিনি আরো বলেন, নিয়ম থাকলেও কমিউনিটি ক্লিনিকে ডাক্তারদের বসা সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসক সংকটের কারণেই এমন হচ্ছে। যেখানে জেলা হাসপাতালে এখনও ১৪ জন ডাক্তারের পদ শুন্য রয়েছে। ইউনিয়নের নবসৃষ্ট পদের চিকিৎসকদের জেলা হাসপাতালে ডেপুটেশনে নিয়ে হাসপাতাল চালাতে হচ্ছে, সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিকে ডাক্তার দেব কিভাবে। তবে ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ডাক্তার রয়েছে। তিনি বলেন, যখন ডাক্তার সংকট থাকবে না, তখন কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ডাক্তার দেয়া হবে। এসএস/এমএস
Advertisement