দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বন্দুকযুদ্ধের নামে ক্রসফায়ারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপির দুই সংসদ সদস্য। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি ন্যায়বিচার দাবি করেছেন তারা। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতিও দাবি জানিয়েছেন এই দুই সংসদ সদস্য।
Advertisement
সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ ও রুমিন ফারহানা এই দাবি জানান।
প্রথমে হারুনুর রশীদ তার নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ দিয়ে জানান, এসব হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সংবিধান লঙ্ঘন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি গত বছর ২৪ এপ্রিল জাতীয় সংসদে এমপি হিসেবে শপথ নেই। তার মাত্র দুদিন পর ৩০ এপ্রিল আমার নির্বাচনী এলাকায় প্রকাশ্যে আরেকটি বিচারবহির্ভূত দিনের বেলায় অমানবিকভাবে হত্যাকাণ্ড হয়। একটি পেশাদারি প্রতিষ্ঠান বিকেল ৩টার সময় একজন সাধারণ নাগরিককে ধরে নিয়ে এসে তাকে গুলি করে হত্যা করে এবং পুলিশি এজাহার দাখিল করে। এ ঘটনা ঘটে থানা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে। সেই এজাহারে বলা হয়, পুলিশের ওপর বেপরোয়া আক্রমণ চালানো হয়েছে। কিন্তু অস্ত্র দেখানো হয়েছে হাতে তৈরি অস্ত্র।
স্পিকারকে উদ্দেশ করে তিনি আরও বলেন, ‘সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এ ঘটনায় দুজন ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। তাদের একজন আমাদের এলাকার ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন তার বড় ভাই। অথচ ঘটনার দিন তারা সংসদে এসে সংসদ গ্যালারি থেকে আমাদের অধিবেশন দেখেছেন। সংসদে ঢুকতে হলে সবার অনুমতি নিতে হয়। এই সংসদের কাছে এ ধরনের ডকুমেন্টস আছে। তাদের নামে আমি পাস ইস্যু করেছিলাম। ৩০ তারিখ তারা দর্শক গ্যালারি থেকে এই সংসদে উপস্থিত ছিল। তাদের সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিল উল্লেখ করে মামলার আসামি করা হয়েছে। এ ধরনের পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে মানুষকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, উপর্যুপরি উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হচ্ছে এবং নাটক বানাচ্ছে।’
Advertisement
এমপি হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আমি যা বলছি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি। এগুলো ১০০ ভাগ সত্য। কিঞ্চিৎ পরিমাণ মিথ্যা নেই। আমাদের এলাকার এক ছাত্রকে ঢাকার শেওড়াপাড়া থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে এলাকায় ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। ঢাকা থেকে তুলে নেয়ার চারদিন পর তাকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়। এ ধরনের উপর্যুপরি ঘটনা ঘটেই চলছে। মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের আজকে বিচার হচ্ছে। আদালত তাদের পরিবারের মামলা গ্রহণ করেছে তদন্তকাজ চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে আরও প্রায় তিন হাজারের অধিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তারা কি বিচার পাবে না? তাদের পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াবে না? তাদের কি রাষ্ট্র এই অধিকার দেবে না?’
এমপি হারুনের বক্তব্য শেষে সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা সংবিধানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আইন অনুযায়ী ব্যতীত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার কারও নেই। সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে আইন অনুযায়ী সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এই সরকার ২০১৩ একটি আইন করেছিল হেফাজতে নির্যাতন মৃত্যু নিবারণ আইন। আনফরচুনেটলি এই আইনটি করা হলেও, চমৎকার সব ধারা থাকা সত্ত্বেও এই আইনে কিন্তু খুব বেশি মামলা হয়নি এবং গুটিকতক মামলা হয়েছে। সেই মামলাগুলো এখন কী অবস্থায় আছে, কতটুকু অগ্রগতি আছে, সে ব্যাপারে কিন্তু আমরা বেশিকিছু জানি না। শুধু কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখেছিলাম, একটি মামলা রায়ের কাছাকাছি গেছে এবং ডেট ফিক্সট হয়েছে। অথচ এই সাত বছরে অসংখ্য মানুষ পুলিশ হেফাজতে মারা গেছে। কিন্তু তাদের মামলাগুলোর কি হলো? কেন পরিবারগুলো মামলা করার সাহস পায় না? হলে কয়টি মামলা হয়? সেই সব মামলার কী অবস্থা তার কিছুই আমরা জানি না।’
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সবারই দৃষ্টি কেড়েছে। অথচ প্রতিদিনই একটির বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়। আমি যদি পরিসংখ্যান দিয়ে বলি, ২০১৮ সালে ৪৬৬ জন, ২০১৯ সালে ৩৮৮ আর ২০২০ সালে করোনাকালে প্রথম ছয় মাসে ১৫৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আমরা যদি পার্টিগণিতের হিসাব অনুযায়ী বলি, তাহলে প্রতিদিন একজনের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।’
এসব হত্যাকাণ্ডের একটিও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই যে বারবার বলা হচ্ছে, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এগুলোর একটিও কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কারণ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে গত এক যুগে অর্থাৎ ১২ বছরে তিন হাজারের ওপরে মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এই যে, টেকনাফে কুখ্যাত ওসি প্রদীপ…২০১৯ পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বিপিএম পাওয়ার ক্ষেত্রে যে ছয়টি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়, তার প্রত্যেকটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পুরস্কারস্বরূপ কোনো পুলিশ অফিসার যদি সর্বোচ্চ পুলিশ পদক পেয়ে থাকেন তাহলে সেটি তো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত করবে সেটাই স্বাভাবিক। শুধু যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তা নয়; এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে অর্থ লেনদেনের বিষয়ও জড়িত আছে। দেখা যায়, সাধারণ পরিবার থেকে মানুষ ধরে নিয়ে যাওয়া হয় অর্থ দাবি করা হয় এবং অর্থ না পেলে ক্রসফায়ারে ভয় দেখানো হয় অথচ আমরা শুনেছি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে ‘গুম’ বলে কোনো শব্দ নেই। একই লাইন ধরে পুলিশের আইজি কিছুদিন আগে বলেছেন, ‘ক্রসফায়ার’ বলে কিছু নেই। এটি এনজিওগুলোর শব্দ।”
Advertisement
‘যে রাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা হয়, সেটা ইঙ্গিত করে যে, সেখানে বিচার বিভাগ ধ্বংস হয়েছে। সেখানে আইনের শাসন ধ্বংস হয়েছে। সেখানে মানুষ বিচারের প্রতি আস্থা হারিয়েছে এবং সেই রাষ্ট্র অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে’- যোগ করেন বিএনপির এই সংসদ সদস্য।
এইচএস/এসআর/পিআর