ডেঙ্গুজ্বর হলো ডেঙ্গু ভাইরাস ঘটিত ও এডিস মশা বাহিত একটি বিশেষ ধরনের সংক্রামক রোগ। ডেঙ্গু ভাইরাস ফ্ল্যাভিভাইরাস গণভুক্ত একটি একক সূত্রবিশিষ্ট পজিটিভ স্ট্র্যান্ডেড ক্ষুদ্রাকার আরএনএ ভাইরাস, যার প্রধানত চারটি সেরোটাইপ বিদ্যমান। ডেঙ্গু ভাইরাসের এই বিভিন্ন সেরোটাইপ ডেঙ্গুজ্বরের বিভিন্ন ধরনের প্রকাশের জন্য দায়ী। আমাদের দেশে ২০০০ সালে ডেঙ্গুজ্বর প্রথম মহামারীর রূপ নিয়েছিল। ২০১৯ সালেও ডেঙ্গুজ্বরের ভয়াবহ রূপ আমরা দেখেছি। ইতোপূর্বে ডেন-১ ও ডেন-২ এই দুইটি ডেঙ্গু সেরোটাইপ আমাদের দেশে ব্যাপকহারে রোগ সংক্রমণের জন্য দায়ী থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেন-৩ ও ডেন-৪ দুইটি ডেঙ্গু সেরোটাইপের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যাচ্ছে।
Advertisement
আশঙ্কার কথা হলো এই, ডেন-৩ ও ডেন-৪ ডেঙ্গু সেরোটাইপ ডেঙ্গুজ্বরের জটিল ও ভয়াবহতম রূপ প্রকাশের জন্য দায়ী। বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ বিশ্বব্যাপী ট্রপিক্যাল অঞ্চলে ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব লক্ষণীয়। আমাদের দেশে সাধারণত জুন থেকে অক্টোবর মাসে হঠাৎ ডেঙ্গুজ্বরের বিস্তার ঘটে। যথাযথ সচেতনতা সৃষ্টি হওয়ার আগেই অনেক রোগী এতে মৃত্যুবরণ করেন। সে কারণে জনমনে জ্বর সম্পর্কিত আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। ধারণা করা হয়, বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৩৯০ মিলিয়ন ব্যক্তি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও আধুনিক নাগরিক সমাজে অসচেতনতার কারণে এডিস মশার জন্ম, বংশ বিস্তার ও বিস্তরণক্ষেত্র দিনদিনই পরিবর্তিত হয়ে বাড়ছে। ডেঙ্গুজ্বর থেকে বাঁচতে তাই আমাদের সতর্কতা ও সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
এডিস মশা বদ্ধ তথা জমা হওয়া স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে। ময়লা–দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি কিন্তু এদের পছন্দ নয়। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতন নাগরিক হিসাবে আপনার চারপাশের এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী জায়গাগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে। আপনার ঘরে সাজানো ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, যেকোনো পাত্র বা জায়গায় জমে থাকা পানি তিন থেকে পাঁচ দিন পরপর ফেলে দিতে হবে। এতে এডিস মশার লার্ভা মারা যাবে। পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ভালোভাবে ঘঁষে পরিষ্কার করে নিতে হবে। সেইসাথে আপনার টয়লেটে কোথাও জমানো পানি যেন পাঁচ দিনের বেশি না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। ঘরের অ্যাকুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনের নিচে এবং মুখ খোলা পানির ট্যাংকে যেন পানি জমে না থাকে, সে ব্যবস্থাও নিতে হবে।
শহুরে জীবনে অনেকেই বাড়ির ছাদে বাগান করে থাকেন। সেখানে টবে বা পাত্রে যেন কোনো ধরনের পানি পাঁচ দিনের বেশি না জমে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। অনেক সময়ই বৃষ্টি হলে ঘরের বাইরে আশেপাশে ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, টিনের কৌটা, ডাবের পরিত্যক্ত খোসা, কন্টেইনার, মটকা, ব্যাটারির শেল, পলিথিন, চিপসের প্যাকেট কিংবা নির্মাণাধীন ভবনের বিভিন্ন অংশে বৃষ্টির পানি জমতে পারে। এসব জায়গায় জমে থাকা পানিতেও এডিস মশা বংশবিস্তারের সুযোগ পেয়ে যায়। তাই এ জমে থাকা বৃষ্টির পানি ফেলে দেওয়ার পাশাপাশি আশেপাশে যেন এ ধরনের পরিত্যক্ত জিনিসে বৃষ্টির পানি জমা হওয়ার সুযোগ না পায়, সেজন্য বাড়ির চারপাশ, ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
Advertisement
মশার প্রজননক্ষেত্র বিনাশের পাশাপাশি নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিতে হবে। এডিস মশা মূলত দিনের বেলা, সূর্যোদয়ের আধা ঘণ্টার মাঝে, সকাল ও সন্ধ্যায় এবং সূর্যাস্তের আধা ঘণ্টা আগে কামড়ায়। তাই এ সময়ে মশার কামড় থেকে সাবধান থাকুন। এ ছাড়া রাত্রে ঘরের টিউবলাইট বা ইলেক্ট্রিক বাল্বের উজ্জ্বল আলোতেও কিন্তু এডিস মশা কামড়াতে পারে। মশার কামড় থেকে বাঁচতে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে। এটা ডেঙ্গু প্রতিরোধের সর্বোত্তম পন্থা। এডিস মশা যেহেতু দিনের বেলায়ও কামড়ায়, তাই দিনের বেলা ঘুমালেও মশারি ব্যবহার করুন। সম্ভব হলে ঘরের দরজা ও জানালায় নেট লাগানো যেতে পারে।
প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট, স্প্রে, লোশন, ক্রিম, কয়েল বা ম্যাট ব্যবহার করা যেতে পারে। সম্ভব হলে শুধু দিনে নয়, রাতের বেলাও সারা শরীরে মশা নিরোধক ক্রিম ব্যবহার করা দরকার। মশা তাড়াতে অনেকে তেলও ব্যবহার করে থাকেন। শিশুদের হাফপ্যান্টের বদলে পুরো পা ঢাকা ফুলপ্যান্ট বা পাজামা পরানো উচিত। সপ্তাহে অন্তত দুই দিন মশা নিধনের জন্য স্প্রে বা ফগিং করা যেতে পারে। বাসা-বাড়ি, হাসপাতাল, অফিস-আদালতের আনাচে-কানাচে মশার স্প্রে বা ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করুন। বিভিন্ন রাস্তার আইল্যান্ডে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ফুলের টব, গাছপালা, জলাধার ইত্যাদি দেখা যায়। এখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকতে পারে। সেগুলোয় যেন পানি জমে না থাকে, সচেতন নাগরিক হিসাবে সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা মশা নিধন কর্তৃপক্ষকে এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।
এ ছাড়াও কতগুলো বিষয়ে খেয়াল রাখা যেতে পারে, যেমন- ১. মশা নিধনে নতুন সৈন্যবাহিনী হলো গাপ্পি মাছ। সব ধরনের আবহাওয়ায় গাপ্পি মাছ দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে। এরা পানির ওপরের অংশে ঘোরাফেরা করে। এ মাছ মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে বলে বিভিন্ন দেশে মশা নিয়ন্ত্রণে গাপ্পির ব্যবহার রয়েছে। একটি গাপ্পি মাছ দিনে গড়ে ৫০টি লার্ভা ধ্বংস করতে পারে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ মাছের সাহায্যে মশার লার্ভা ধ্বংস করা হচ্ছে।
২. প্রাকৃতিক উপায়ে মশা তাড়াতে কর্পূর ব্যবহারের বিকল্প নেই। দরজা-জানালা বন্ধ করে কর্পূর জ্বালিয়ে রুমের ভেতর রাখুন। ২০ মিনিট পর দেখা যাবে মশা একেবারেই চলে গেছে। মশার হাত থেকে বাঁচতে তাই প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যায় কর্পূর জ্বালিয়ে রাখা যেতে পারে।
Advertisement
৩. জানালার পাশে তুলসিগাছ লাগানো যেতে পারে। এই গাছে এমন কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে যা মশা তাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
৪. ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীকেও মশারির মধ্যে রাখা শ্রেয়। কারণ এসব রোগীকে কোনো স্বাভাবিক এডিস মশা কামড় দিলে সেই মশাটিও ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক হয়ে পড়বে। এ নতুন বাহক মশাটি আবার সুস্থ কোনো ব্যক্তিকে কামড় দিলে সুস্থ ব্যক্তিও ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়বেন।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, ডেঙ্গুজ্বরের কোনো কার্যকর ভ্যাকসিন এখনো উদ্ভাবিত হয়নি, এমনকি তেমন কোনো কার্যকরী ওষুধও আবিষ্কার হয়নি। ডেঙ্গুজ্বরের বাহক এডিস মশা আমাদের দেশে আগেও ছিল এবং এখনো আছে। তাছাড়া মশা প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধির উপযুক্ত পরিবেশও বিদ্যমান রয়েছে। তাই এখনই ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ সহসা একেবারে নির্মূল হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব।
এসইউ/এএ/এমকেএইচ