দেশজুড়ে

মাস্কের ফিতা দিয়ে নবজাতকের নাভি বাঁধার গল্প

‘রাত আনুমানিক ১১টা। ডিউটি ডাক্তারসহ আমি ফিমেল (মহিলা) ওয়ার্ডে রাউন্ডে যাচ্ছিলাম। ওয়ার্ডে ঢুকতেই চোখ পড়ল কর্নারের বেডে থাকা সেই অন্তঃসত্ত্বা রোগীর দিকে। দেখতে একটু অস্বাভাবিক লাগছে। আমি ছুটে যাই রোগীর কাছে এবং জিজ্ঞাসা করি, আপনার কী কোনো সমস্যা হচ্ছে? তিনি জানালেন, তার পেট ও কোমরে ব্যথা হচ্ছে, থেমে থেমে একটু একটু করে।

Advertisement

তখন ডিউটি ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কি লেবার ওয়ার্ডে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা আছে। আমি বললাম, আছে। তারপর ডিউটি ডাক্তারের অনুমতিক্রমে রোগীকে ইনজেকশন পুশ করালাম লেবারের ব্যথা কিনা তা দেখার জন্য। কিন্তু ইনজেকশন দেয়ার পর রোগী বলছে, ব্যথা আরও বাড়ছে। এরপর আমি দেখলাম রোগীর লেবার আছে এবং একটু পরই ডেলিভারি হয়ে যাবে। তখন ডিউটি ডাক্তার এবং আমিসহ আমার সহকর্মী নার্সরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম এটা ভেবে যে, আমরা যে হাসপাতলে আছি এখানে ডেলিভারি ও ডেলিভারি পরবর্তী কোনো ব্যবস্থাই নেই। কারণ এটি ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হসপিটাল। আমরা আরও চিন্তিত হয়ে পড়লাম, কারণ রোগীর আগেও একটি ছেলে সন্তান আছে এবং সেটা সিজার করা।

মা ও শিশু যেন উভয়ই ভালো থাকেন এবং ভালোভাবে ডেলিভারি সম্পন্ন হয় সেজন্য ডিউটি ডাক্তার, ইএমও, আরএমও, নার্সিং সুপারভাইজার ও তত্ত্বাবধায়ক স্যারকে জানিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করেছে, আমরা রোগীকে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে নেয়ার জন্য ট্রলিতে নিয়েছি। কিন্তু রোগীর ব্যথা আরও বাড়তে থাকে এবং নবজাতকের মাথা সামনের দিকে চলে এসেছে। এ অবস্থায় তাকে আর অ্যাম্বুলেন্সে নেয়া সম্ভব হয়নি। শুধুই সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করে পাশে থাকা ডিউটি ডাক্তার ও সহকর্মী নার্সদের সহযোগিতায় হাতের কাছে যা ছিল তাই নিয়ে খুব সাবধানতার সঙ্গে বড় কোনো সমস্যা ছাড়াই রোগীর নরমাল ডেলিভারি সম্পন্ন করি। মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।

কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই গর্ভফুল বের হয় এবং নবজাতকের নাভি কাটা হয় হাতের কাছে থাকা মেডিসিন কাটার সিজার দিয়ে। তারপর নাভি বাঁধলাম হাতের কাছে থাকা সার্জিক্যাল মাস্কের ফিতা দিয়ে। এরপর এয়ারওয়ে ক্লিয়ারের জন্য সাকশন দিলাম এক অভিনব বুদ্ধি খাটিয়ে। বাটারফ্লাই নিডিল কেটে সেই বাটারফ্লাইয়ের সঙ্গে ১০ সিসি সিরিঞ্জ সংযুক্ত করে। ততক্ষণে মা ও মেয়ে দু’জনেই সুস্থ ছিলেন। মেয়ের নামও দিলাম সিদরাতুল মুনতাহা। সকল প্রশংসা সেই মহান রাব্বুল আলামিনের যিনি আমাদেরকে এ কাজে সফল হওয়ার জন্য সাহায্য করেছেন। সেইসঙ্গে ধন্যবাদ জানাই সেই ডিউটি ডক্টরকে, যিনি পাশে না থাকলে এত বড় সাহসিকতার কাজ কখনোই করতে পারতাম না। ধন্যবাদ জানাই আমার সহকর্মী সকল নার্স, ডিউটিতে থাকা সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের। সত্যিই এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি, যা কোনো ভাষা দিয়েই প্রকাশ করার মতো না।’

Advertisement

জাগো নিউজের কাছে এভাবেই এক প্রসূতি ও নবজাতকের জন্ম ঘিরে অন্য রকম অনুভূতির কথা বলছিলেন ওই রাতে রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে কর্মরত সিনিয়র স্টাফ নার্স লিতুন জেরা।

জানা যায়, গাইবান্ধা পৌর এলাকার ব্রিজ রোডের নজরুল হক মঞ্জুর ছেলে মাহমুদুল হক সিয়ামের সঙ্গে ২০১৩ সালে বিয়ে হয় একই পৌরসভার পশ্চিমপাড়া মহল্লার মৃত সামসুল আলমের মেয়ে আজমেরী বেগম আশার। ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর গাইবান্ধা শহরের একটি ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারের (সিজার) মাধ্যমে প্রথম ছেলে সন্তানের জন্ম হয় আজমেরি বেগমের। স্বভাবতই দ্বিতীয় সন্তানেরও জন্ম হওয়ার কথা ছিল সেভাবেই। সব ঠিক থাকলে হয়ত সেটাই হত। কিন্তু ‘মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ’ হয়ে দেখা দেয় করোনাভাইরাস। আর এতেই ঘটে বিপত্তি। যেখানে কোনো ব্যবস্থাই ছিল না, সেখানেই করোনা আক্রান্ত এক প্রসূতির অস্ত্রোপচার ছাড়াই জন্ম হয়েছে কন্যা সন্তানের। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও নার্সদের আন্তরিকতা এবং সাহসিকতায় গত বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) রাতে রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে জন্ম নেয় এই দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান সিদরাতুল মুনতাহা। শনিবার বিকেলে (৫ সেপ্টেম্বর) হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন তারা।

মাহমুদুল হক সিয়াম জাগো নিউজকে জানান, গত আগস্টের শেষ দিকে বাড়িতে থাকা অবস্থায় শ্বাসকষ্টসহ করোনা উপসর্গ দেখা দেয় তার ৩৬ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর। ২৪ আগস্ট গাইবান্ধায় করোনার নমুনা দেয়া হয়। ২৫ আগস্ট অবস্থার অবনতি হলে রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাকে নিয়ে আসা হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে প্রথমে প্রসূতি ওয়ার্ডে এবং শ্বাসকষ্ট থাকায় পরে মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে অবস্থানকালীন ৩০ আগস্ট আজমেরীর করোনা পজিটিভ রেজাল্ট আসে।

তিনি বলেন, রমেক হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত প্রসূতিদের চিকিৎসায় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা থাকলেও মঙ্গলবার (১ সেপ্টম্বর) তাকে রেফার্ড করা হয় ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকলেও ছিল না প্রসূতি রোগীদের জন্য কোনো ব্যবস্থা। একদিন অবস্থানের পর করোনা হাসপাতাল থেকে তাকে (প্রসূতি) রংপুর মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হলেও সেখানকার কেউই তা আমলে নেয়নি। এরইমধ্যে বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) বিকেল থেকে প্রসবব্যাথা ওঠে তার স্ত্রীর। মাহমুদুল হক সিয়াম বলেন, কঠিন একটা দুঃসময় পার করেছি। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে এবং করোনা হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের আন্তরিকায় আমি কন্যা সন্তানের মুখ দেখতে পেরেছি। শনিবার ছাড়পত্র নিয়ে বাড়িতে ফিরে গেছেন এবং মা ও মেয়ে দু’জনেই সুস্থ আছে বলেও তিনি জানান।

Advertisement

রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এসএম নুরুন নবী জাগো নিউজকে বলেন, রংপুর বিভাগীয় করোনাভাইরাস প্রতিরোধ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী করোনা পজিটিভ প্রসূতি রোগীদের প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারসহ অন্যান্য সেবার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নির্দিষ্ট স্থান (মডেল ক্লিনিক) নির্ধারণ করা আছে। ওইদিন তাৎক্ষণিক প্রস্তুতি না থাকায় আজমেরী বেগম আশাকে মেডিসিন বিভাগ থেকে রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে প্রেরণ করা হয় একদিন থাকার অনুরোধ জানিয়ে। মানবিক কারণে রোগীকে করোনা হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এর আগে তার সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করানো হয়। সুতরাং এবারও তাকে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করানো হবে এটাই নিয়ম। পরে বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) রোগীকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর উদ্যোগ নিলে গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের প্রধান বিলম্ব করাতে থাকেন। ইতোমধ্যে বিকেলের দিকে রোগীর প্রসব ব্যথা শুরু হয় এবং রাত ঘনিয়ে আসে।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু আমাদের এখানে সিজারতো দূরের কথা নরমাল ডেলিভারি করারও কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই রোগীর অবস্থার কথা ভেবে শঙ্কিত ছিলাম। ভয় এবং উদ্বেগ বাড়ছিল। সেইসাথে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম নরমাল ডেলিভারির জন্য। কালক্ষেপণ করতে করতে রাত ১১টার দিকে অ্যাম্বুলেন্স আনা হয়। ইতোমধ্যে রোগীর অবস্থা এমন হয় যে, তাকে আর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর মতো অবস্থা ছিল না। করোনা হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক এবং নার্সদের উপস্থিত বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও সাহসিকতায় রাত সাড়ে ১১টার দিকে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। পরবর্তীতে ফলোআপ করোনা টেস্ট নেগেটিভ হওয়ায় শনিবার আশাকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে।

এফএ/পিআর