গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্য সেবা দিতে ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো চলছে দায়সারাভাবে। নিয়ম অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ক্লিনিকে অবস্থান করার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। সময়মতো ক্লিনিক না খোলা, পর্যাপ্ত ওষুধ না থাকা, রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, টাকার বিনিময়ে ওষুধ বিক্রিসহ বিস্তর অভিযোগ উঠেছে রংপুরের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর বিরুদ্ধে। আশানুরূপ সেবা না পাওয়ায় অনেকেই কমিউনিটি ক্লিনিকের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি ও স্থানীয় পরিচালনা পর্ষদ সক্রিয় ভূমিকা না রাখায় ভেস্তে যেতে বসেছে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার মান। সরেজমিনে রোববার সকাল সাড়ে ৯টায় সদর উপজেলার চন্দনপাট ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের চন্দনপাট কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে ক্লিনিকটি। সকাল সোয়া দশটায় আসেন ওই ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) অজয় কুমার রায়। তিনি জাগো নিউজকে জানান, একজন স্থাস্থ্য সহকারী ও একজন পরিবার পরিকল্পনা সহকারী সপ্তাহে তিন দিন করে আসার কথা থাকলেও তারা নিয়মিত আসেন না। এছাড়াও রয়েছে পর্যাপ্ত ওষুধ সঙ্কট। সরকারিভাবে ৩০ প্রকার ওষুধ সরবরাহ করা হলেও গত দেড় মাস ধরে পর্যাপ্ত ওষুধ না থাকায় রোগীরা ফিরে যাচ্ছেন। বর্তমানে পাঁচ প্রকার ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।ওই ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসা জলকরিয়া এলাকার মোসলেমা বেগম (৩০) ও মোহসেনা বেগম (৩৫) জাগো নিউজকে জানান, ওষুধ নিতে তিন থেকে পাঁচ টাকা করে দিতে হয়। তবে টাকা নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও তা বাধ্যতামূলক নয় বলে জানান সিএইচসিপি অজয় কুমার দাস।এদিকে, বেলা সাড়ে ১২টায় নগরীর ১১নং ওয়ার্ডের রাজেন্দ্রপুর কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে ক্লিনিকটি। স্থানীয় বিরু ও মিন্টু বর্মন জাগো নিউজকে জানান, সিএইচসিপি লিটন মিয়া সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এসেছিলেন। তবে কিছুক্ষণ আগেই তিনি চলে গেছেন।এছাড়াও একই ওয়ার্ডের কামদেব কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে জানা যায়, গত চার ছয় দিন ধরে তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে ক্লিনিকটি। সিএইচসিপি মুন্নী আক্তার মাতৃত্বজনিত কারণে ছুটিতে থাকায় স্বাস্থ্য সহকারী আবুল কালাম আজাদ দায়িত্বে রয়েছেন। স্থানীয় মুদি দোকানদার আবু বক্কর সিদ্দিক, রিকশাচালক আমজাদ, কৃষক শাহাদত অভিযোগ করে জাগো নিউজকে বলেন, মুন্নী ছুটিতে আছেন। কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি টাকা ছাড়া কাউকে ওষুধ দিতেন না। স্বাস্থ্য সহকারী আবুল কালাম আজাদ দ্বায়িত্বে থাকলেও তিনি নিয়মিত আসেন না। ফলে গত ছয় দিন ধরে বন্ধ অবস্থায় রয়েছে ক্লিনিকটি। বিভিন্ন এলাকা থেকে রোগী এসে ফিরেও যাচ্ছেন বলে তারা জানান।এ বিষয়ে মুঠোফোনে ওই ক্লিনিকের সভাপতি ময়নুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে গত ছয় দিন ধরে ক্লিনিক বন্ধ থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, সিএইচসিপি মুন্নী আক্তার ছুটিতে থাকায় স্বাস্থ্য সহকারী সপ্তাহে দুুদিন আসেন। এদিকে, নগরীর ১২নং ওয়ার্ডের চক ইসবপুর গ্রামের নুরুন্নাহার বেগম জাগো নিউজকে জানান, ছেলের পায়ে ঘা হয়েছে। এর আগে ওষুধ নিতে চক ইসবপুর কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়েছিলাম। ওষুধ না পেয়ে রংপুর মেডিকেলে গিয়ে ছেলের চিকিৎসা করান তিনি। নুরুন্নাহার অভিযোগ করে বলেন, ওই ক্লিনিকের সিএইচসিপি আশরাফুল ইসলাম পাঁচ টাকা করে না দিলে ওষুধ দেন না। টাকা না দিলে রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন তিনি। বেলা দেড়টায় চক ইসবপুর ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, তলাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে সেটি।ওই ক্লিনিকের পরিচালনা কমিটির সদস্য আনজিরা বেগম জাগো নিউজকে জানান, বেলা একটার দিকে সিএইচসিপি তার কক্ষের তালা বন্ধ করে চলে গেছেন। বাইরের বারান্দার গেটের তালা খোলা কেন? জানতে চাইলে তিনি জানান, ওই তালা তিনিই লাগিয়ে দেবেন।মুঠোফোনে সিএইচসিপি আশরাফুল টাকা নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে জাগো নিউজকে বলেন, রোগী ও তার স্বজনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের বিষয়টি সঠিক না। কমিটির সদস্যদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পাঁচ টাকা করে নেয়া হয়। তবে সেটা বাধ্যতামূলক নয়। এত তাড়াতাড়ি অফিস বন্ধ করে চলে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রিপোর্ট জমা দিতে সদর উপজেলা হাসপাতালে গিয়েছেন তিনি।এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি মাসের রিপোর্ট প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ক্লিনিকে একটি করে ল্যাপটপ ও মডেম প্রদান করা হয়েছে। যার মাধ্যমে সরাসরি মাসিক রিপোর্ট প্রদান করা হয়।রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার ৮ উপজেলা ও সিটি কর্পোরেশনের আওতাভূক্ত এলাকায় প্রায় ২৯ লাখ জনগোষ্ঠির বিপরীতে কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে ৩১০টি। এসব ক্লিনিকে গড়ে প্রতিদিন এক থেকে দেড়শো রোগী সেবা নিয়ে থাকেন। তবে ওষুধ সঙ্কট থাকায় গত মাসে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। রংপুর সিভিল সার্জন ডা. মোজাম্মেল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, টাকা নেয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ক্লিনিক পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত। তারা ক্লিনিকের উন্নয়নের জন্য যদি টাকা নিয়ে থাকেন তাহলে আমাদের করার কিছুই নেই। অফিস স্টাফরা আসেন দেরিতে এবং চলে যান তাড়াতাড়ি এ বিষয়টি স্বীকার করে সিভিল সার্জন বলেন, ক্লিনিক পরিচালনা কমিটির সদস্যরা সক্রিয় না থাকার কারণে এ সমস্যাটা দেখা দিচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।এমজেড/এমএস
Advertisement