দেশজুড়ে

টাকার জন্য ৫ ঘণ্টা লাশ আটকে রাখল হাসপাতাল!

সিলেটে রোগীর করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ থাকার পরও দরিদ্র এক রোগীকে করোনা ইউনিটে রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়। দু’দিনের মাথায় ওই রোগী শুক্রবার রাত তিনটার দিকে মারা গেলে ৭৬ হাজার টাকা বিল ধরিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এত রাতে এত টাকা তাৎক্ষণিকভাবে না দিতে পারায় প্রায় ৫ ঘণ্টা লাশ আটকে রেখে বিলের টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

Advertisement

গুরুতর এ অভিযোগ উঠেছে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বেসরকারি নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দেন দরিদ্র ওই ব্যক্তির লাশ টাকা দিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে আনা সমাজসেবি ও ব্যবসায়ী নেতা আব্দুল জব্বার জলিল। তার এ স্ট্যাটাস দেখে নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এমন আচরণে সমালোচনা, নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান অনেকেই। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লাশ আটকে রেখে টাকা আদায়ের কথা অস্বীকার করেছে।

শনিবার বিকেলে সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বারের সিনিয়র সহসভাপতি ও আটাব সিলেটের সাবেক সভাপতি মো. আবদুল জব্বার জলিল নিজের ফেসবুক আইডিতে ‘একটা লাশের করুন কাহিনী’ শিরোনামে দেয়া স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘হাসপাতালের অমানবিকতা আর সহ্য করার মতো নয়, রাত ৩টায় একজন গরিব রোগী মারা গেছেন। হাসপাতালে দুই রাত থেকেছেন বিল ৭৬ হাজার ৪০০ টাকা। ওসমানীর ল্যাবের রিপোর্ট নেগেটিভ, তারপরও ওই হাসপাতালে করোনা রোগী হিসেবে বিল ৩৯ হাজার টাকা। সব মিলে বিল ৭৬ হাজার টাকা। গরিব ওই রোগীর স্বজন সাহায্যের জন্য আমাকে কল করলেন। আমার পরিচয় দিয়ে অনেক অনুরোধ করলাম, লাশ দিয়ে দেন। আমি রাত পোহালে টাকা পাঠিয়ে দেব। তা আর হলো না, টাকা দিয়েই নিতে হবে। শেষ মেশ সকাল ৭টায় আমি বের হয়ে কার্ড দিয়ে টাকা তুলে লাশ বিদায় দিলাম। হে মানব সন্তান করোনা টাকা রোজির জন্য আসে নাই। তোমাদের মতো অমানুষের জন্য এসেছে। আল্লাহর নিকট লাশের পক্ষে আমি বিচার দিয়ে রাখলাম।’

তৌফিক পাশা রাসেল নামে একজন নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় অবস্থিত নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এক ‘কসাইখানা’! করোনা পরবর্তী সময়ে তাদের বিলের অত্যাচারে রোগীদের হতে হয়েছে ধরাশায়ী। করোনা যেন তাদের জন্য আশির্বাদ হয়ে ধরা দিয়েছে। সরকারের সঙ্গে দেন দরবার করে করোনা কেয়ার ইউনিটের জন্য প্রায় ৭.৫০ কোটি টাকা আদায় করার পরও প্রতিদিনই রোগী প্রতি ১৫-২০ হাজার টাকা বিল আদায় করছে প্রতিনিয়ত! এদের লালসার আগুন দিন দিন বেড়েই চলেছে।’

Advertisement

তিনি আরও লিখেন, ‘গতকাল (শুক্রবার) রাতে ৭৬ হাজার টাকার জন্য লাশ পর্যন্ত আটকে রাখে এই অমানুষেরা। জানতে ইচ্ছে করে ডা. আফজাল, ডা. শাহরিয়ার কত টাকা সঙ্গে করে নিয়ে কবরে যাবেন?’

জানা গেছে, সিলেট দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সিলাম ইউনিয়নের উলালমহল গ্রামের নাসির উদ্দিন (৬০) গত ৩ সেপ্টেম্বর রাত ২টায় শ্বাসকষ্ট নিয়ে নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। ভর্তির পর রোগীকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা ইউনিটে নিয়ে যেতে চাইলে তার স্বজনরা গত ১ সেপ্টেম্বরের ‘করোনা নেগেটিভ’ রিপোর্ট দেখান। তবু স্বজনদের কথা উপেক্ষা করে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা নাসির উদ্দিনকে সাধারণ ওয়ার্ডে না রেখে করোনা ইউনিটে নিয়ে যান। এরপর গত ৪ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দিনগত রাত তিনটায় তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

মৃত নাসির উদ্দিনের ভাতিজা আব্দুল বারী জানান, গত ৩১ আগস্ট তার চাচার শরীরের নমুনা পরীক্ষার জন্য দেয়া হয় এবং সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে করোনা পরীক্ষা শেষে পরদিন রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।

এদিকে রোগীকে করোনা ইউনিটে নিয়ে পজিটিভ রোগীর মতোই চিকিৎসা প্রদান করা হয়। শুক্রবার রাতে রোগীর শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে গেলে তাকে করোনায় মুমূর্ষু রোগীর মতো রক্তের প্লাজমা দেয়ার কথা বলেন কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। তবে স্বজনরা সম্মত না হলে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার দিনগত রাত ৩টার দিকে নাসির উদ্দিন মারা যান। রোগীর মৃত্যুর পর স্বজনদের হাতে ৭৭ হাজার ৪৭২ টাকার বিল ধরিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিলে শুধু পিপিই এবং সুরক্ষাসামগ্রী বাবদ প্রতিদিন ধরা হয় ৪ হাজার ২৫০ টাকা।

Advertisement

এই বড় অংকের বিল এবং গভীর রাত হওয়ার কারণে স্বজনরা টাকা বকেয়া রেখে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলে কর্তৃপক্ষ লাশ দেয়নি। ওই সময় সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল জব্বার জলিল হাসপাতালে কর্তব্যরতদের ফোনে সুপারিশ করে বলেন, ‘আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- সকালে ব্যাংক খুললেই আপনাদের টাকা নিজে এসে পরিশোধ করে যাব। এখন দয়া করে মৃতদেহ নিয়ে গিয়ে তাদের দাফন-কাফনের সুযোগ দিন।’

কিন্তু আব্দুল জব্বার জলিলের সেই অনুরোধও রাখেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে সকালে আব্দুল জব্বার জলিল হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে বিলের টাকা পরিশোধ করার পরই লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

গুরুতর এ অভিযোগের বিষয়ে নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, টাকার জন্য লাশ আটকে রাখা হয়েছে অভিযোগটি সঠিক নয়। বরং আমরা মৃতদেহ দিয়ে দিতে চেয়েছি, কিন্তু ওই সময় লাশ হস্তান্তর করার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি।

এক প্রশ্নের জবাবে ডা. নাজমুল বলেন, করোনা ইউনিটে বিল বেশি আসাটাই স্বাভাবিক। এক রোগীর বিপরীতে একদিনে ৩টি পিপিই ব্যবহার করতে হয়। গ্লোভস, মাস্কসহ অন্য আনুষাঙ্গিক ব্যয়বহুল বিষয়।

ডা. নাজমুল বলেন, অনেক সময় রোগীর করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ হলেও করোনা ইউনিটে রেখেই চিকিৎসা প্রদান করতে হয়। কারণ হয়তো পরে দেখা গেল দ্বিতীয়বারের টেস্টে রোগী করোনা পজিটিভ। মাঝে-মধ্যে করোনার রিপোর্ট ভুলও আসে। তাই সাবধানতাবশত করোনার উপসর্গ আছে, এমন রোগীকে করোনা ইউনিটে রেখেই চিকিৎসা দেয়া হয়। এটা দোষের কিছু নয়।

এফএ/পিআর