ছোট মাছের শুঁটকি ও কচুর ডাটা দিয়ে তৈরি করা এক প্রকারের খাবারের নাম ‘সিদল’। রংপুর অঞ্চলের (রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়) গ্রামবাংলার মুখরোচক খাবার হিসেবে এর কদর রয়েছে যথেষ্ট। সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্য ও স্বাদের কারণে এ অঞ্চলের মানুষের এটি অতিপ্রিয় একটি খাবার।
Advertisement
পারিবারিক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে পাঠানো সওদা হিসেবে কিংবা নিজ বাড়িতে আপ্যায়নের ক্ষেত্রে একসময় সিদল ছিল অন্যতম একটি উপকরণ। শুধু তা-ই নয়, হাটে-বাজারে বিক্রিও হতো গ্রামীণ পরিবারের নারীদের হাতের তৈরি এই মুখরোচক খাবার।
দিন বদলের ধারায় আর দেশীয় ছোট মাছের বিলুপ্তিতে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবারটি। এখন আর চোখে পড়ে না সিদল তৈরি করতে বাড়ির নারীদের কর্মব্যস্ততা। হাটে-বাজারে বিক্রির ধুম নেই। তবে সচরাচর না হলেও মাঝেমধ্যে দেখা মেলে। শখের বশে অনেকেই ঐতিহ্যবাহী খাবারটি এখনো তৈরি করেন। সিদল মূলত তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছ, যেমন- মলা, ডারকা বা পুঁটিসহ বিভিন্ন ছোট জাতের মাছ দিয়ে।
প্রথমে মাছগুলো ভালো করে ধুয়ে কড়া রোদে ৫-৬ দিন শুকিয়ে নিতে হয়। মচমচে হলে মাছের শুঁটকিগুলো উরুনগান (কাঠের বড় হামানদিস্তা) বা শিল-পাটায় গুঁড়া করে নিতে হয়। এরপর সাদা মানকচু ও কালো কচুর শুধু ডাঁটা ধুয়ে নিয়ে কাঁচা অবস্থায়ই বাটতে হয়। কচুবাটার সঙ্গে মলা, ডারকা বা পুঁটি মাছের আধাভাঙা গুঁড়া, প্রয়োজনমতো শুকনা মরিচ, লবণ, রসুন, আদা বাটা সবকিছুর সঙ্গে মেশাতে হয়। সব মেশানো হয়ে গেলে একদিন পর মণ্ডগুলো হলুদ ও সরিষার তেল দিয়ে মেখে হাত দিয়ে গোল বা চ্যাপটা করে ৫-৬ দিন রোদে শুকাতে হয়। ডালা বা কুলায় ঢেকে (যাতে পাখি খেতে না পারে) শুকিয়ে একটু শক্ত হলে তৈরি হয় সিদল।
Advertisement
পরে শুকনো পাতিলে সংরক্ষণ করতে হয়। পাতিলে কিছু ছাই দিয়ে রাখলে বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট পোকার আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। শুকনো সিদল প্লাস্টিকের কাগজে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের বক্সে রেফ্রিজারেটরে রাখলে ৩ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। এ ক্ষেত্রে মাঝেমাঝে রোদে শুকানোর প্রয়োজন রয়েছে।
রান্না করার সময় সিদল থেকে ছাই ফু দিয়ে তুলে পরিষ্কার করার পর ভালো করে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হয়। বিভিন্নভাবে সিদল রান্না করা যায়। কাতলা বা বোয়াল মাছের সাথে সিদল মিশিয়ে একটু বেশি ঝাল দিয়ে রান্না করা হয়। শাক দিয়ে সিদল রান্নার প্রচলন সুপরিচিত হলেও জনপ্রিয় রান্নার পদ্ধতি হচ্ছে সিদল ভর্তা। এক্ষেত্রে ভাত নামানোর ৫ মিনিট আগে সিদল ভাতে দিয়ে সিদ্ধ করে নিতে হয়। পরবর্তীতে সেটি হালকা তেলে ভেজে ভাজা মরিচ, পিঁয়াজ, রসুন, লবণ, সরিষার তেল দিয়ে ভালো করে হাত দিয়ে বা পাটায় পিষে ভর্তা করতে হয়।
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বেতগাড়ি ইউনিয়নের বাড়াইপাড়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব হাসনা বেগম বলেন, ‘একসময় এ অঞ্চলের খাল-বিল, নদী-নালাসহ ছোট-বড় সব ধরনের পুকুরে দেশি ছোট মাছে ভরপুর ছিল। তখন সিদল তৈরি করাটা অনেকের কাছে শখের পাশাপাশি পেশাও ছিল। কালের বিবর্তনে মাছের সংকট এবং নানা ব্যস্ততার কারণে এখন ইচ্ছে থাকলেও সিদল তৈরি করা হয়ে ওঠে না।’
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার মদাতী ইউনিয়নের কৈটারী গ্রামের গৃহবধূ সাবিনা বেগম বলেন, ‘একটা সময় বছরজুড়েই বাড়িতে সিদল থাকতো। এখন শখের বশে মাঝেমধ্যে সিদল তৈরি করি। বিশেষ করে শহর থেকে ছেলে-মেয়ে বা জামাই বেড়াতে এলে বছরে এক-দুইবার তাদের জন্য সিদল বানাতে হয়।’
Advertisement
রংপুর বিভাগীয় লেখক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জাকির আহমদ জানান, সিদল একটি সুস্বাদু ও মুখরোচক খাবার। শেষবাারের মতো বছর তিনেক আগে তিনি সিদল খেয়েছেন। ২৫-৩০ বছর আগেও মাসে অন্তত ২-৩ বার সিদল দিয়ে তৈরি করা খাবার খেতেন। এখন সিদল তৈরির মাছ বাজারে পাওয়া গেলেও তার দাম বেশি হওয়ায় অনেকেই তা কিনে এনে সিদল তৈরির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
রংপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বরুন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার, জলাশয় দূষণ, নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, নদী সংশ্লিষ্ট খাল-বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানোসহ নানা কারণে দেশীয় ছোটে মাছের প্রাপ্যতা কমে গেছে। ফলে ঐতিহ্যবাহী সিদল আগের মতো পাওয়া যায় না। তাই অভয়াশ্রম তৈরি করাসহ বিভিন্নভাবে দেশি মাছের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে মৎস্য অধিদফতর।’
জিতু কবীর/এসইউ/এএ/পিআর