অর্থনীতি

করোনাকালে হান্নান গ্রুপের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত

করোনায় ধুঁকছে মানবতা। বিপর্যস্ত অর্থব্যবস্থা। মহামারির এ বিপর্যয়ে সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি আয়ের খাত পোশাক শিল্পে। অনিশ্চয়তার চাদরে ঘেরা কারখানার মালিকদের অনেকেই শ্রমিক ছাঁটাই করেছেন। শ্রমিকদের কেউ কেউ আবার স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।

Advertisement

এমন দুঃসময়ে যখন চারদিকে বেঁচে থাকার হাহাকার আর শ্রমিক বঞ্চনার খবর, ঠিক তখনই স্বস্তির নিশ্বাস মিলেছে পোশাক খাতের হান্নান গ্রুপের কারখানায়। যেন বিষাদের মাঝে একটু আনন্দের সংবাদ, অনুকরণীয়ও বটে।

পোশাক খাতের ব্যবসায়ী এ বি এম শামসুদ্দিন। হান্নান গ্রুপের মালিক ও চেয়ারম্যান তিনি। তার মহানুভবতায় সহস্রাধিক শ্রমিককে করোনাসেবা, ছাঁটাই না করে বরং বিপুলসংখ্যক শ্রমিককে নতুন করে নিয়োগ দিয়ে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি তার প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। একক প্রচেষ্টায় অসম একটা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে। ক্যালেন্ডারের পাতায় আগস্ট শেষ হয়ে সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে, এ বি এম শামসুদ্দিনের লড়াইয়ের বয়সও হয়েছে চার মাসের বেশি। এ পর্যায়ে এসে বলা যায়, করোনার বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন তিনি-ই।

মার্চের শুরুর দিকে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে অনেকের মতো তৈরি পোশাক শিল্প খাতের এ প্রতিষ্ঠানও উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এপ্রিলের ২৬ তারিখে সরকারি সিদ্ধান্তে পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

Advertisement

পোশাক কারখানার মালিকদের অনেকেই তখন স্বার্থপরতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই অজস্র কারখানা চালু হয়, সামাজিক দূরত্ব বা শ্রমিকদের কোয়ারেন্টাইনের বিধিনিষেধ মানা নিয়ে চলে একধরনের উদাসীনতা।

ঠিক তখনই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেয় হান্নান গ্রুপ। তাদের ১২ হাজার কর্মীকে সুরক্ষিত রাখতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় করোনা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির মালিক এ বি এম শামসুদ্দিন নিজের টাকায় শ্রমিকদের জন্য ৯টা বিল্ডিং ভাড়া করে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করেন। আক্রান্ত শ্রমিকদের করোনা পরীক্ষা থেকে শুরু করে চিকিৎসা— সবকিছুর দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। অন্যরা যেখানে অর্ধেক বেতন দিয়ে শ্রমিকদের প্রতি দায়সারা আচরণ করেছেন সেখানে হান্নান গ্রুপের প্রতিটা শ্রমিককে বেতন-বোনাস শতভাগ পরিশোধ করা হয়েছে।

করোনায় আক্রান্ত কর্মীদের আলাদা স্থানে কোয়ারেন্টাইনে রেখে তাদের খাওয়া-দাওয়াসহ চিকিৎসারও ব্যবস্থা করেছেন এ বি এম শামসুদ্দিন। এক হাজার ৩৫৭ শ্রমিককে প্রায় দুই মাস ধরে কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করেন। তাদের মধ্যে মাত্র ১৪৩ জনের করোনা পজিটিভ রিজাল্ট আসে। নানামুখী পদক্ষেপের কারণে করোনায় আক্রান্তের হারও কমিয়ে আনে প্রতিষ্ঠানটি। এই সময়ে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে কম-বেশি ছাঁটাই হলেও গত দুই মাসে প্রতিষ্ঠানটির পাঁচটি ইউনিটে নতুন করে প্রায় এক হাজার ৬০০ কর্মীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

রাজধানী ঢাকার অদূরে গাজীপুর বোর্ডবাজারে অবস্থিত হান্নান গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির মোট পাঁচটি ইউনিটে ১২ হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করেন। চেয়ারম্যান এ বি এম শামসুদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, কারখানা খোলার প্রথম দিন থেকে কর্মীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা শুরু করি। তাপমাত্রা বেশি হলে ওই কর্মীকে কিছু ওষুধসহ দুদিনের ছুটি দিয়ে বাসায় থাকতে বলা হয়। দুদিনে তাপমাত্রা না কমলে তাকে কোম্পানির নির্দিষ্ট কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠানো হয়।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, করোনার উপসর্গ দেখা দিলেই আমরা তাদের কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠিয়েছি। এভাবে এক হাজার ৩৫৭ কর্মীর জন্য মোট ৯টি সেন্টার খুলতে হয়েছে। কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলো চালানো ছিল একটি জটিল প্রক্রিয়া। প্রতিদিন ৯টি সেন্টারে রান্না করা খাবার ও পানি সরবরাহ করতে হয়েছে। সবাই যাতে পর্যাপ্ত গরম পানি খেতে পারে এবং গড়গড়া করতে পারে সেজন্য ১ হাজার ৪০০ ফ্লাক্স দেয়া হয়। আদা, লেবু, এলাচ, দারুচিনি সরবরাহ করা হয় প্রতিটি সেন্টারে। প্রতিদিন কোম্পানির ছয়জন চিকিৎসক ও সেবিকা রোগীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, যাদের উপসর্গ কম তাদের আলাদা করে রাখা হবে। করোনার সবগুলো লক্ষণ আছে এমন রোগীদের পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। মোট ৬৭০ জনের টেস্ট করে ১৪৩ জনের ফল পজিটিভ আসে। চিকিৎসকরা একপর্যায়ে জানান, কোয়ারেন্টাইনে থাকা কর্মীদের বিভিন্ন ধরনের ভেষজ খাওয়ানোর ফলে তাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বেড়েছে।

এ বি এম শামসুদ্দিন বলেন, কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলো চালাতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। বিশেষ করে স্থানীয়দের বিরোধিতার কারণে আমরা কারখানার কাছাকাছি সেন্টার ভাড়া নিতে পারিনি। এছাড়া সেন্টারগুলোতে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র পাঠাতে কর্মকর্তাদের বেগ পেতে হয়েছে।

তিনি বলেন, এতগুলো কর্মীকে যাতে একসঙ্গে কারখানায় প্রবেশ করতে না হয় সেজন্য পুরুষ ও নারীদের আলাদা সময়ে (আধাঘণ্টা আগে ও পরে) প্রবেশ করতে দেয়া হয়। ছুটির সময়ও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। প্রতিদিন সকালে কর্মীরা যখন প্রবেশ করেন তখন সবার শরীরের তাপমাত্রা মাপা হয়। এছাড়া দুপুরে ও বিকেলে সবার আরও দুই দফা তাপমাত্রা নেয়া হয়। কারও শরীরের তাপমাত্রা বেশি হলে তাকে দুদিনের ছুটি দিয়েছি আমরা। পরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের কাজে যোগদান করতে দেই। করোনা থেকে সুস্থ রাখার জন্য কারখানায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিপুল পরিমাণ হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করা হয়।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, এক হাজার ৩৫৭ কর্মী কোয়ারেন্টাইনে থাকার কারণে তারা একদিনের বেতন থেকে বঞ্চিত হননি। এমনকি তাদের পুরো বোনাস দেয়া হয়েছে। অথচ অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের ৬০ শতাংশ বেতন দিয়েছে।

কোম্পানির চেয়ারম্যান বলেন, কর্মীদের যত্ন নেয়ার ফলে কারখানার অন্য কর্মীদের মাঝে কাজের স্পৃহা বেড়ে যায়।

হান্নান গ্রুপে কর্মরত এবং করোনাযুদ্ধে জয়ী এক কর্মী জানান, শরীরের তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে আলাদা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে খাওয়া-দাওয়াসহ সব ধরনের ওষুধ দেয়া হয়। এক মাস ১৬ দিন পর আমার রেজাল্ট নেগেটিভ আসে। এর মধ্যে সব বেতন-ভাতা আমাকে পরিশোধ করা হয়। অনুপস্থিতির কারণে একদিনের বেতনও কাটা হয়নি। অথচ তারা ইচ্ছা করলে সেটা করতে পারত।

সুপারভাইজার এমদাদুল ইসলাম জানান, করোনা পজিটিভ হওয়ার পর আলাদা ছিলাম। কাজে ফেরার পর কারখানার পরিবেশ নিয়ে আমরা বেশ সন্তুষ্ট। কোম্পানির পক্ষ থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক এবং অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছে।

হান্নান গ্রুপ মূলত ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নামিদামি ব্র্যান্ডের ক্রেতাদের কাছে পোশাক বিক্রি করে। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক টার্নওভার ৮০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।

এসআই/এমএআর/এমএস