মতামত

ইউএনওর ওপর হামলা আমাদের যে বার্তা দেয়

সপ্তাহ শেষে বৃহস্পতিবারটা অনেক আনন্দ নিয়ে আসে এ কারণে যে, এটি ছুটির শুক্রবারের দিনের আগের দিন। কিন্তু এই বৃহস্পতিবার মানুষ উদ্বেগে কাটিয়েছে। কারণ এক সরকারি কর্মকর্তাকে তারই সরকারি বাসায় হত্যাচেষ্টার খবর মানুষ জেনেছে বৃহস্পতিবার। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। বুধবার রাতের কোনো একসময় দুর্বৃত্তরা তার সরকারি বাসভবনে ঢুকে তাকে ও তার বাবা ওমর আলীকে কুপিয়ে জখম করে। কেন হামলা হলো, সেটা জানতে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।

Advertisement

শুক্রবারের স্বস্তির খবর ছিল এই যে, অস্ত্রোপচারের পর দুর্বৃত্তের হামলার শিকার ওয়াহিদা খানমের জ্ঞান ফিরেছে, তিনি কথাও বলেছেন। আরেকটু স্বস্তির খবর এই যে, হামলার ঘটনায় যুবলীগ নেতাসহ দুজনকে আটক করা হয়েছে।

কিন্তু ইউএনওর ওপর এই হামলা যে বার্তা দেয়, যে সংকেত দেয় সেটি কোনো স্বস্তি দেয় না। কথায় কথায় জেলায় জেলায় খুনাখুনি আমরা দেখে আসছি অনেক বছর ধরে, দেখে আসছি চিকিৎসকসহ সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর যখন তখন হামলা। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনের প্রধানের ওপর তারই সরকারি বাসায় হামলা হওয়ায় এমনিতেই সবসময় আতঙ্কে থাকা সাধারণ মানুষ আরও আতঙ্কিতবোধ করছে। মানুষ ভাবতে বাধ্য হয়, পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে, সরকারের বড় কর্তা নিজেই তার ঘরে নিরাপদ নন, তাহলে আমরা কোথায় যাব?

হামলায় আটক দুজন সরকারি দলের যুব সংগঠনের নেতা। এই দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটেই এর আগে গত মে মাসে পৌর মেয়রকে প্রকাশ্যে যুবলীগ নেতারা উপজেলা চত্বরে পিটিয়েছে। এই আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক বলেছেন, ‘আটক হওয়া যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর বেপরোয়া টাইপের। কিছুদিন আগে আমার ওপরও হামলার চেষ্টা করেছিলেন।’ বোঝা গেল স্বয়ং এমপি এদের সমীহ করে চলেন।

Advertisement

ঘোড়াঘাটে সমস্যা আছে, আইনশৃঙ্খলার সমস্যা। কিন্তু আসলে কোথায় নেই? সামগ্রিক সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশটাই সারাদেশে সহিংস। হামলা পাল্টা হামলা নিত্য ঘটনা। আধিপত্য কায়েমের এই ব্যবস্থাই হলো ‘রাজনীতির সিস্টেম’। রাজনীতির প্রশ্নে পরমতসহিষ্ণুতা আমাদের নেই বললেই চলে। কিন্তু এখন দুর্বল বিরোধী দলের উপস্থিতিতে আধিপত্য কায়েমের জন্য হানাহানি প্রিয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নিজের দলের প্রতিপক্ষ, সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী বা সরকারি কর্মকর্তা কেউই আক্রমণ থেকে বাদ যাবে না।

ইউএনওর বাসায় ঢুকে তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা বড় ঘটনা। পুলিশ ও র‌্যাব দ্রুতই মূল আসামিসহ কয়েকজনকে আটক করেছে। প্রত্যাশাও আছে যে, ঘটনার কারণ বের হবে। দ্রুততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই কাম্য সবার। প্রশাসনের কর্মকর্তা হামলার শিকার হয়েছেন, তাই প্রশাসন খুব তৎপর। কিন্তু এর আগে সরকারি চিকিৎসকসহ বহু সরকারি কর্মকর্তা হামলার শিকার হয়েছেন, সেগুলোর সময়ে প্রশাসনের এত তৎপরতা কেন চোখে পড়েনি সে কথা উঠতে পারে। সবার চাওয়া এই মুহূর্তে, বিতর্কে না গিয়েও সামগ্রিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলার একটা নির্মোহ আলোচনা হোক সমাধান সূত্র বের করতে।

যেভাবে ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে হাতুড়ি দিয়ে তার মাথা থেঁতলে দেয়া হয়েছে, তার অনুপুঙ্খ তদন্ত জরুরি। তদন্তের ফল প্রকাশের পূর্বে এমন হিংস্রতার কার্যকারণসূত্র সম্পর্কিত কোনো অভিমত প্রকাশ করছি না। কিন্তু মানুষের চাওয়া আছে। মানুষ বুঝতে পারে জেলায় জেলায় রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক বিভিন্ন নিগ্রহ, খুন-জখম ও গৃহদাহের প্রতিটি ঘটনাই আইনের শাসনকে উল্লঙ্ঘন করে এবং সরকারের প্রশাসনিক ভাবমূর্তিকে মলিন করে।

হামলাকারী সন্দেহে আটক দুই ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় আছে। তারা শাসক দলের সাথে জড়িত। তবুও হয়তো কথা আসবে, সন্ত্রাসীর কোনো দল নেই। আমরা বলতে চাই সন্ত্রাসীর দলীয় এবং রাজনৈতিক পরিচয় থাকে। রাজনীতির যে পরিকল্পিত দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে (যে কারণেই হোক), যেভাবে চিহ্নিত সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতকারীরা দলে দলে দলের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে, তাতে এ কথা আর বলা চলে না যে, সন্ত্রাসীর কোনো দল নাই। বরং কী করে তারা দলে ঢুকল, কাদের প্রশ্রয়ে তারা দুর্বীনিত ও বেপরোয়া হয়ে উঠল সেটি বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নেয়া বেশি জরুরি এসব বিতর্ক ও কৃতর্ক করার চেয়ে।

Advertisement

নিরীহ জনসাধারণকে সন্ত্রস্ত রেখে সমাজজীবনে দলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা গেলেও সুশাসন কায়েম করা যায় না। আওয়ামী লীগ পরপর টানা তিন মেয়াদে এখন ক্ষমতায়। নিজের ত্যাগী কর্মীরাই আফসোস করে যে, তারা বঞ্চিত, বরং অন্য দল থেকে অনেক দুর্বৃত্ত দলে ঢুকে দল ও দেশের ক্ষতি করছে। এই অভিযোগটি গুরুতর। দুষ্কৃতকারীরা অনেকেই কেবল তাদের ছত্রটি পরিবর্তন করে শাসক দলে ঢুকেছে, কিন্তু তাদের মূল রাজনীতির রীতি অপরিবর্তিত রেখে অপকর্ম করে চলেছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা অনেক সময়ই এদের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। পরিবর্তনের দায়িত্ব নেতৃত্বকে নিতে হবে। দলীয় নেতৃত্ব যদি এই দুর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়ায় ছেদ টানতে যথার্থ ভূমিকা রাখতে চান তাহলে সবার আগে দুর্বৃত্তায়নের সংস্কৃতি হতে দলকে টেনে বের করতে হবে। কাজটি দুরূহ। রাতারাতি হওয়ারও নয়। কিন্তু এ ধরনের পৈশাচিক বর্বরতাকে থামাতেই হবে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/জেআইএম