মতামত

ভ্যাকসিন রাজনীতি : লোকাল জাতীয়তাবাদ না গ্লোবাল জাতীয়তাবাদ?

সাব্বির পারভেজ এবং শবনম নাহার

Advertisement

বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় করোনা ভ্যাকসিন কবে পাবো? কিভাবে পাবো? কে আগে পাবে? ভ্যাকসিন এর বিষয়টি শুধু এর আবিষ্কার প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ নয়। এর সাথে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, লোকাল রাজনীতি, সমাজনীতিসহ রাষ্ট্রীয় যোগাযোগ- সব কিছইু জড়িত। এটি শুধু করোনা টিকার জন্যই সত্য নয়। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে যে, আগে যত টিকা আবিষ্কার ও প্রয়োগ এর বিষয় সামনে এসেছে সবসময় এই রাজনীতি ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের ভিতর দিয়েই যেতে হয়েছে। এখন করোনা ভ্যাক্সিনকে সামনে রেখেও এই ধরণের রাজনীতি, বৈশ্বিক যোগাযোগ, উন্নয়ন, কৌশল, ও বন্ধুরাষ্ট্র- এই বিষয়গুলো নতুন করে যোগ হয়েছে। অনেককাল আগে থেকেই ইতিহাসবিদ এবং নৃবিজ্ঞানীরা এই বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। “দি পলিটিক্স অব ভ্যাকসিন: এ গ্লোবাল হিস্ট্রি”- এই বইতে এ বিষয়টি খুব ভালভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

ঊনিশ শতকে যখন পাবলিক হেল্থ এর ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রামকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলো তাদের জনগণকে রক্ষার জন্য টিকা নেয়ার উপকারিতার উপর জোর দিচ্ছিল তখন এর উপর ভিত্তি করে সেসময় বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিরাষ্ট্রিক মতাদর্শ গড়ে উঠে। আবার কিছু রাষ্ট্র এই বিষয়গুলোর দিকে তেমন নজর দেয়নি। এর সবচেয়ে ভাল উধাহরণ হিসেবে ১৮০০ সালে স্মল পক্সের টিকা প্রয়োগের বিষয়টি উল্লেখ্য। সেসময় জার্মান তাদের নাগরিকদের টিকা প্রয়োগ করে একদিকে রক্ষা করতে চায়; কিন্তু অপরপক্ষে ব্রিটেন সেইভাবে কোন উদ্যোগ নেয় নি।

আগে টিকা রাজনীতির সাথে কলোনিয়াল রাজনীতি, জাতীয়তাবাদ, ডি-কলোনাইজেশন, কোল্ড ওয়ার, নব্য উদারনৈতিকতাবাদ- এই বিষয়গুলো যুক্ত ছিল। কিন্তু এখন করোনা এর ভ্যাকসিন যুদ্ধে নতুন আরো কিছু বিষয় সামনে আসছে; তবে নতুন মোড়কে, যেগুলো বাদ দিয়ে ভ্যাক্সিনের রাজনীতি বোঝা যাবেনা। ইতিহাস অন্তত তাই বলে। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের উৎপাদিত ভ্যাকসিন সফল বলে প্রমাণ করার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে; যেখানে ক্ষমতা ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে ঐ রাষ্ট্রগুলোর প্রভাব থেকেই যায়; কারণ এর মাধ্যমে রাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতার বৈধতার বিষয়টি জড়িত। আগের মত এখন হয়ত কলোনিয়াল সাম্রাজ্যবাদ নেই; কিন্তু নানা ধরনের প্রভাববাদ তো এখনও আছেই। আমেরিকা, চীন, রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশ এই প্রতিযোগিতায় এখন লিপ্ত। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের টিকা আবিষ্কারের দাবি এই প্রতিযোগিতায় সামনের সারিতেই আছে। কোন ভ্যাকসিনটি বেশি কার্যকরী তা প্রমাণ করার রাজনীতির সাথে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটও নিহিত রয়েছে। বিভিন্ন সুপারপাওয়ার বা ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলো তাদের উৎপাদিত ভ্যাকসিন যে সফল সেটি প্রমাণ করার জন্য ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোকেও সাথে নিতে চাইবে; বাংলদেশ এখন এই রাজনীতির রোষাণলে পড়েছে। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি একটি বড় সমস্যা। একদিকে আমাদের ভ্যাকসিন পাওয়ার চাহিদা এবং কোন ভ্যাকসিনটি আসলে বেশি কার্যকর-দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাথে সেটিই বা আমরা কবে পাবো? আমার দেশের মানুষের টিকা দেয়ার উপর আস্থা তৈরিরও ব্যাপার আছে।

Advertisement

আমাদের দেশের উন্নয়নের বিষয়টিই একটি বড় প্যারাডাইম। দরিদ্র দেশগুলোর সাথে সুপারপাওয়ার বা ক্ষমতাশালী দেশগুলো টিকা ভাগাভাগিতে অংশ নিবে কিনা সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ। আবার, বাংলাদেশ এখন দরিদ্র দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে; সেদিক বিবেচনায় বাংলাদেশের টিকা প্রাপ্তির সারির তালিকায় প্রথম দিককার সারিতে নেই এটি নিশ্চিত।

বেশিরভাগ উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হয় টপ ডাউন এপ্রোচের উপর ভিত্তি করে। আমাদের খুব সতর্কতার সাথে ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ করতে হবে যেন আমরা সহজেই ভ্যাক্সিনটি পেতে পারি। কারণ এই করোনা ভাক্সিন এর সাথে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা, বৈদেশিক ঋণ সুবিধা প্রাপ্তিসহ নানা বিষয়গুলো জড়িত আছে। বর্তমান সময়ে করোনা ভ্যাক্সিন উৎপাদনে শুধু বিভিন্ন দেশের সরকারি সংস্থা জড়িত তা নয়, বিভিন্ন নামকরা ব্যাবসায়িক ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থও জড়িত। উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের বাবসায়িক লাভগুলো হিসাব করবে। সে কারণে করোনা এর ভ্যাকসিন শুধু মানুষের জীবন রক্ষাকারী একটি টিকা হিসাবে বিবেচিত হবে- বিষয়টি এত সহজ নয়। এর সাথে বৈশ্বিক রাজনৈতিক বৈধতা, এবং তাদের ব্যবসা-এই বিষয়গুলো জড়িত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভ্যাকসিনের রাজনীতির সাথে আমাদের বাংলাদেশের পদক্ষেপ কি হবে? কিংবা আমাদের পলিসি কি হবে? আমাদের নীতি নির্ধারকগণ কিভাবে বিষয়গুলো সমাধান করে সেটি আমাদের দেখতে হবে। আমরা এই রাজনীতির বাইরে না- সেটি আগেই বলা হয়েছে। প্রথমে আমাদের কাছে চীনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিনভাক এর তৃতীয় পর্যায়ের করোনা ভ্যাকসিনের পরীক্ষা করার প্রস্তাব ছিল; সেটি এখন অনুমোদিত হয়েছে। এর সাথে এখন আবার এসট্রোজেনকা, এবং রাশিয়ান ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের ব্যাপারেও প্রস্তাব আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা একসাথে কতটি ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করতে পারব সেটিকেও বৈশ্বিক ও স্থানিক রাজনৈতিক মারপ্যাচের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশে যে শুধু এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষাই করা হয় তা নয়, এর থেকে অনেক খারাপ অথবা ভাল মানের ভ্যাকসিনের পরীক্ষাও করা হয়; যেটি আমরা সাধারণ মানুষ অনেকেই জানিনা। এই করোনা এর ভ্যাকসিন যে আমরা বিনামূল্য পাবো এমন কোন খবরও পাওয়া যায়নি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে কেন্দ্র করে এখন আমেরিকা, চীন ও অন্যান্য দেশ তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। নানা প্রকার অনৈতিকতা, গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ তো আছেই। করোনার আগে যে বৈশ্বিক ভাতৃত্ববোধ ছিল তা এখন অনেক যায়গায়ই অনুপস্থিত। কারণ সুপারপাওয়ার বা ক্ষমতাশালী দেশগুলো তাদের জন্য করোনা ভ্যাকসিনের আগাম চুক্তি করে রেখেছে। সেখানে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর কি হবে তা একটি ভাবার বিষয়। হেল্থ ডিপ্লোমেসি আগেও ছিল এখন আরও জোরদার হচ্ছে; ডেভিড ফিল্ডের বর্ণনায় যাকে তিনি বলছেন গ্রেট পাওয়ার সিকিউরিটি।

Advertisement

পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ভারত যে ব্রিটেনের সাথে ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের ব্যাপারে চুক্তি করেছে এবং সেখানে যে বাংলাদেশকে যুক্ত করতে চায়, সেটিই বা কেন তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ ক্ষমতাশালী বড় রাষ্ট্রগুলো ভ্যাকসিন সবার আগে পাবে। তারপর আমাদের মত দেশগুলো। কিন্তু আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য তা অনেক ক্ষতির কারণ হতে পারে। আমাদের চিকিৎসা বাবস্থা এমনিতেই ভেঙ্গে পড়েছে; অর্থনীতি, রপ্তানি, এগুলো এত দীর্ঘসময় কার্যকরী রাখা অসম্ভব। আমাদের সংক্রমণ হারও পরিসংখ্যানিকভাবে অনেক বেশি। ভ্যাকসিন ছাড়া হার্ড ইমিউনিটি সম্ভব নয়। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে; ভ্যাকসিন নেয়ার ক্ষেত্রেও দেশের ভিতর থেকে নানা বাধা আসতে পারে। এ বিবেচনায় টিকার জাতীয়তাবাদ ঠেকিয়ে সরকার কাদের সাথে হেলথ দূতিয়ালি করলে আমাদের অধিকার সমুন্নত রাখতে পারবে সেটি হবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য।

লেখকদ্বয়ের একজন চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী এবং অপরজন পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

এইচআর/এমএস