শ্যামল কান্তি ধর
Advertisement
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে নির্মিত বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সিনেমা ‘টোপ’র কাহিনি এগিয়ে গেছে তার নির্মাণশৈলীর স্বতন্ত্র ধারায় এবং তা কখনো কবিতায়, জাদুবাস্তবতায় আবার কখনো ইমেজ ও কম্পোজিশনের নান্দনিকতায়।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টোপ গল্পে কথক ‘বিচিত্র’ শিকার কাহিনির গল্প বলতে গিয়ে গল্পের শেষে আমাদের যে অমানবিক ও নৃশংস শিকারের মুখোমুখি করেছেন, তাকে শুধুমাত্র ‘বিচিত্র’ বললে স্টোর কিপারের বেওয়ারিশ ছেলেটির প্রতি অবিচারই করা হয়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সিনেমার শেষে সেই অমানবিকতা ও নৃশংসতাকেই তুলে ধরেছেন। বলা যায়, ‘বিচিত্র’ এক রাজাবাহাদুরের গল্পের মাধ্যমে অমানবিক বা নৃশংস শিকারের সিনেমাই হচ্ছে ‘টোপ’। যেখানে রাজাবাহাদুর শুধু বাঘ শিকার করেন না, শিকারের ‘টোপ’ও শিকার করেন। শুধু তা-ই নয়, গল্পের কথক যেখানে বাঘের চামড়ার চটি পায়ে দিয়ে বেশ আরামবোধের কথা বলে গল্প শেষ করেন, বুদ্ধদেব তখন রাজাবাহাদুরের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণকে জাগিয়ে তোলেন।
‘টোপ’ গল্প লেখা হয়েছিল চল্লিশের দশকে। কিন্তু এত বছর পরও কাহিনির প্রাসঙ্গিকতা একেবারেই বদলায়নি। আঞ্চলিক কিংবা বিশ্ব রাজনীতিতে, বিনোদন মাধ্যমে, শিল্প-সাহিত্যে, ব্যক্তিগত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানুষ আজও ‘টোপ’ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিংবা নিজেই ‘টোপ’ হচ্ছে কিছু স্বার্থসিদ্ধির জন্য। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প যেখানে রাজাবাহাদুর ও কথকের আলাপচারিতায় ও পারিপার্শ্বিকতার বর্ণনায় এগিয়ে যায়, সেখানে সিনেমায় মূল গল্পের সাথে আরও অনেক গল্প আসে। কিন্তু কোনভাবেই গল্পগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয় না। আমরা দেখতে পাই ডাকপিয়ন গজার গল্প, মাদারীর খেলা দেখানো এক পরিবারের গল্প, রাজাবাহাদুরের সঙ্গিনী রেখার গল্প। এই গল্পগুলোর সাথে আমরা প্রবেশ করি ‘টোপ’ সিনেমায়, কখনো জাদুবাস্তবতায়, কখনো কবিতায় আবার কখনো গভীর নৈশব্দতায়।
Advertisement
কবিতা ও চলচ্চিত্র সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র দুটো শিল্পমাধ্যম হলেও কখনো কখনো চলচ্চিত্রের নিজস্ব প্রকাশভঙ্গী কিংবা ভাষার কারণে কিছু ইমেজ কিংবা কম্পোজিশন কবিতার মত কথা বলে, সংলাপের ব্যবহার সেখানে বাতিল হয়ে যায়। আসলে চলচ্চিত্রে ইমেজের অন্তর্নিহিত বোধ থেকেই একটি কবিতার জন্ম হয়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত একজন কবি, তাই স্বাভাবিকভাবেই তার চলচ্চিত্রে বিভিন্ন ইমেজ কিংবা কম্পোজিশন কবিতার মতই কথা বলে। পুরো চলচ্চিত্র এক কাব্যময় গতিতে এগিয়ে যায়। টোপ সিনেমায় যখন জঙ্গলে বিকেল থেকে সন্ধ্যা এবং রাত নামার দৃশ্যায়ন সম্পাদিত হয় তখনই আলো ও অন্ধকারের এই দৃশ্যান্তরেই একটি কবিতার জন্ম হয়। সময় বয়ে যায় কী এক স্তব্ধতার ভেতর দিয়ে, যেভাবে বর্ণিত হয়েছে গল্পেও-‘জঙ্গলের সেই আশ্চর্য স্তব্ধতা। অরণ্য যেন আজ রাত্রে বিশ্রাম করছে, একটি রাত্রের জন্য ক্লান্ত হয়ে জানোয়ারগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে খাদের ভেতর, ঝোপের আড়ালে। কেটে চলেছে মন্থর সময়।’এ মন্থর সময়কেই বুদ্ধদেব অপূর্ব এক কম্পোজিশনের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। জঙ্গলের দৃশ্যায়নে এই সময় বয়ে যাওয়ার দৃশ্যে জীবনানন্দ দাশের কবিতার এই লাইনটি মনে আসে, ‘বিকেলের থেকে আলো ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে নিভে যায় তবু/ ঢের স্মরণীয় কাজ শেষ হয়ে গেছে/ হরিণ খেয়েছে তার আমিষাশী শিকারীর হৃদয়কে ছিঁড়ে।’ সময় বয়ে যাওয়ার এই দৃশ্যায়নের পরপরই পাখিদের কলকাকলির শান্তিময় নীরবতা ভেঙে যায় বাঘের গর্জনে, আতঙ্কিত হয়ে ঘুম থেকে উঠে যায় মাদারীর খেলা দেখানো ছোট মেয়ে মুন্নি।
সিনেমার শুরুর কয়েকটি দৃশ্যে আমাদের নিয়ে যায় স্বপ্নভুবনে। বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। মাঠে দরজার সাজানো ফ্রেম, তারই ভেতর দিয়ে রাজাবাহাদুরের নেচে নেচে প্রবেশ। যেন দরজার ফ্রেমের একপাশে বাস্তবতা আরেকপাশে স্বপ্নের জগৎ। রাজাবাহাদুর স্বপ্নের জগৎ থেকে কখনও বাস্তবে আবার কখনও বাস্তব জগৎ থেকে স্বপ্নে প্রবেশ করেন। সাথে সাথে আমরা দর্শকরাও দোল খাই স্বপ্ন ও বাস্তবতার দোলাচলে। লং শটে ফ্রেমের মাঝখানে পুরোনো গ্রামোফোন। দরজার ফ্রেমে সাজানো রঙিন কাগজ, খেলনা লাগিয়ে রাজাবাহাদুর নেচে যান। এ যেন তার শিকারের বিশেষ টোপ ধরার আয়োজন। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, ট্রেনের হুইশেলের সাথে তার এগিয়ে চলার শব্দ, বাতাসে বর্ণিল কাপড়ের দোলার শব্দ, সব একাকার হয়ে যায়। শুরুর এই দৃশ্যগুলো ভালোভাবে খেয়াল করতে হয়। কারণ সিনেমার শেষের দিকে এই দৃশ্যেরই পুনরাবৃত্তি হবে একটু ভিন্নভাবে। এই দৃশ্যগুলোই যেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সেই ‘ম্যাজিক’ কিংবা তার ভাষায় বলতে হয় বাস্তবতার এক এক্সটেন্ডেড রূপ, যা অনায়াসেই কবিতা হয়ে যায়। সিনেমায় প্রবেশের আগে এক স্বপ্নের আবেশে থাকতে হয় কিছুটা সময়, যতক্ষণ পর্যন্ত না তরুণ তথ্য নির্মাতাদের গাড়ি এসে থামে কাপড়বাহী ঘোড়ার দলের মাঝখানে। মনে হয় সিনেমার কাহিনি তাহলে শুরু হলো।
রেখা ও তার জলপুরুষের গল্প: রেখা, রাজাবাহাদুরের সঙ্গিনী কিংবা রক্ষিতা- যে নামেই ডাকি না কেন, এই চরিত্রে আমরা এক মুক্তিকামী নারী চরিত্রের দেখা পাই। রাজার প্রাসাদে বন্দি রেখা প্রতিনিয়ত মুক্তির স্বপ্ন দেখে। বাস্তবে বসবাস হলেও স্বপ্নে যার নিত্য চলাফেরা। তাই আমরা রেখার চোখে, স্বপ্নে কিংবা ভাবনায় বারবার জলে তার অবাধ সাঁতার কাটা দেখি। রেখা যেন তখন এক স্বপ্নের জলপরি। সিনেমায় ঘুরে-ফিরে কয়েকবার এই দৃশ্য আসে। এ যেন এক চিত্রশিল্পীর জলরঙে আঁকা পেইন্টিং, যার সাথে মিশে আছে আরও না দেখা ইমেজের। জলে মেঘের ছায়া, শ্যাওলার সবুজ রং, মাছ, তাদের সাথে রেখা ও তার স্বপ্নপুরুষের অবাধ সাঁতার ইত্যাদির মাধ্যমে অপূর্ব এক কম্পোজিশন তৈরি হয়। বাস্তবতায় নিস্পৃহ রেখা দূরবীনেও যখন জলমগ্ন এই দৃশ্য দেখতে দেখতে বাস্তব কোন দৃশ্যে ফিরে আসে; তখন রেখার মুখের নিস্পৃহতা আরও প্রবলভাবে প্রকাশিত হয়। তাই হয়তো রেখাকে দেয়ালে ঝুলানো তৈলচিত্র শূন্যে উড়িয়ে জলে বিসর্জন দিতে দেখা যায়। এ যেন রেখারই আত্মবিসর্জন। জলে ছিল আকাশের ছায়া, যা ভেঙে যায় বিসর্জিত তৈলচিত্রে। রেখা তার স্বপ্নজগতে এত বিভোর যে, যখন তথ্যনির্মাতা দলের একজন তাকে মুক্ত করে তাদের সাথে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়; তখন রেখা তা প্রত্যাখান করে। কারণ সে একজনকে কথা দিয়ে রেখেছে। পরবর্তীতে আমরা দেখি সেই একজন তার স্বপ্নের জল থেকে উঠে আসা পুরুষ।
রেখা ভাবে, যেদিন সে বুড়ি হয়ে যাবে, চুল সাদা হবে, বুক ঝুলে যাবে, গায়ের চামড়া কুঁচকে যাবে; তখন সে নিজের মত বাঁচবে, তখন তাকে দেখে আর কারো ইচ্ছে হবে না। তাই স্বপ্নের জল থেকে উঠে আসা পুরুষের আহ্বানে সে একদিন তার সাথে চলে যায়, যার সমস্ত শরীর থেকে জল ঝরে। সৃষ্টি হয় এক জাদুবাস্তবতার। জানালা খুলে যায়, জানালার শিকগুলো আলাদা হয়ে দুদিকে চলে যায়। রেখা বেরিয়ে যায় স্বপ্নের জলে ভেজা পুরুষের সাথে, যেখানে স্বপ্ন ও বাস্তবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। রেখা নিজেও সমাজের এক ‘টোপ’ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে, হয়তো তার অজান্তেই। কিন্তু এই টোপের জীবন তার ভালো লাগেনি। তাই রেখা বেছে নিল জলের জীবন। এই দৃশ্যের সাথে মনে পড়ে ‘চরাচর’ সিনেমার লখার কথা, যে এক ভোরে দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে পেয়ে যায় সমুদ্র। সমুদ্রতীরের পাখিদের সাথে যেন সে পাখা মেলে উড়ে যায়।
Advertisement
ডাকপিয়ন গজা ও গাছের গল্প: গজা নামক ডাকপিয়নের চরিত্রটি দেখেও চরাচরের লখার কথা মনে পড়ে। পাখি ধরা যার পেশা কিন্তু পাখি ধরে ছেড়ে দেওয়ার অদ্ভুত নেশা তার। সংসারের প্রতি চরম উদাসীন লখা একদিন বাস্তবতার চৌকাঠ পেরিয়ে পেয়ে যায় স্বপ্নের সমুদ্র, যেখানে হাজার হাজার পাখি উড়ে বেড়ায়। সেও মিশে যায় পাখিদের দলে। ‘টোপ’র ডাকপিয়ন গজাও সরকারি ডাকঘরে চাকরি করে। কিন্তু চাকরি তার ভালো লাগে না, সংসার ভালো লাগে না। তাই তার বিষাদমাখা খোদোক্তি, ‘কী যে বলেন ছাই! এই এক ঘর, এক বউ, এক চাকরি, এক গ্রাম, এক পঞ্চায়েত, একই মোড়ল ভালো লাগে? বোরিং লাগে না!’ কিংবা ‘বাড়ি তো সবার হয়, গাছ কারো হয়।’ তাই গজা ঘর ছেড়ে গাছে আশ্রয় নেয়। গাছের ডালে ঝুলে থাকে চিঠির ব্যাগ, ডাকপিয়নের পোশাক, স্যান্ডেল। রেখা যখন জলের জীবন বেছে নেয়, গজা তখন বেছে নেয় গাছের জীবন। গাছে বানরদের সাথে তার সংসার। ডাকঘরের পোস্টমাস্টার যখন সাইকেল নিয়ে গজার গাছের অনতিদূরে মেঠো পথ ধরে চলতে চলতে থেমে যান এবং গজার সাথে কথোপকথন শুরু করেন; তখন স্থির ফ্রেমে যেন আমরা চিত্রশিল্পীর আরেকটা পেইন্টিং দেখতে পাই। বিস্তীর্ণ মাঠ, নিঃসঙ্গ গাছ, মাঠের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া পথ, সাইকেলের দু’চাকা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। তারাও যেন শুনতে পায় পোস্টমাস্টার ও ডাকপিয়ন গজার কথা। তাদের সাথে ওই গাছ, পথ, সাইকেলও সিনেমার চরিত্র হয়ে ওঠে। ‘গজা’ গাছ ভালোবাসে, তাই তাকে গাছ থেকে নামানোর জন্য গ্রামবাসীরা যখন গাছ কাটার প্রচেষ্টা চালায়; তখন সে বানরদের নিয়ে অন্য গাছে আশ্রয় নেয়। তবু সে গাছ ছাড়ে না, জড়িয়ে থাকে গাছের গলা। এই প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের গাছ নিয়ে লেখা কবিতার কয়েকটি লাইন পড়ে দেখা যায়-‘আজ বারবার হাজার গাছের মাঝখানে গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা, গাছ হয়ে মরে যাবার কথা ভাবি।একটা গাছ আর একটা গাছের দিকে এগিয়ে যায়, জড়িয়ে ধরে অন্য একটা ডাল;আমার একটা হাত এগিয়ে যায় তোমার গলার উপর, অন্য হাত এগিয়ে যায় তোমার গলার নিচে,তোমার গাছের শরীর মুখ থুবড়ে পড়ে মাটির উপর, ঠিকরে বেরিয়ে আসতে থাকে কচিপাতার চোখ।আসলে গাছ হয়েও ভোলা যায় না সবকিছু, গাছের মান অপমান, ঘৃণা-প্রেম, মর্মরের মতো কথা বলা না বলাসব নিয়েই একটা গাছ অজস্র গাছের ভেতর মিশে থাকে, আর এগিয়ে যেতে চায় একট একটু করে, আত্মসাৎ করতে চায় আরেকটা গাছের শিকড়।’
এভাবেই হয়তো ডাকপিয়ন গজাও গাছকে ভালোবেসে নিজেকে গাছের মতই ভাবে। তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় তার সংসার, চাকরি। তার বউ শত চেষ্টায় তাকে গাছ থেকে নামাতে পারে না, নামাতে পারে না তার মা, গ্রামের মোড়ল। সে গাছের ভালোবাসায় বন্দি। সে যেন কান পেতে শোনে পাতাদের মর্মর। আবার বাঘের টোপ হিসাবে ব্যবহৃত মুন্নির মায়ের চিৎকার যেন গাছেরা শুনতে পায়। মাদারীর খেলা দেখানো মুন্নি যখন বাঘের টোপ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে নিষ্প্রাণ, তখন আমরা একটি ফ্রেমে পাঁচটি গাছ দেখতে পাই যার পাশ দিয়ে গজা দৌড়ে ফ্রেম আউট হয় আবার মুন্নির মা, বাবাকে নিয়ে ফ্রেম ইন হয়ে আউট হয়। মুন্নির মায়ের আর্তচিৎকারের সাথে গাছের কাণ্ডগুলোকে জুমশটে ও সম্পাদনার শৈলীতে আরও নিবিড়ভাবে দেখানো হয়, যেন গাছ কান পেতে শোনে মুন্নির মায়ের আর্তচিৎকার। বিবর্ণ রঙে প্রকাশ করে তাদের প্রতিবাদ। গ্রামের মানুষের কাছে গজা অস্বাভাবিক হলেও এই অস্বাভাবিকতার কারণেই হয়তো রাজাবাহাদুরের পথ আগলে ধরে কটাক্ষ করতে পারে, ‘রাজাবাবু, আপনাকে দেখে খুব কষ্ট লাগে, এতদিন ধরে চিঠি বিলি করলাম, আপনাকে তো কেউ একটা চিঠিও লিখল না।’
রাজাবাহাদুর ও মুন্নির গল্প: যদিও ‘টোপ’ গল্পের কথক রাজাবাহাদুরের প্রশংসা করেই গল্প শুরু করেন, গল্পের ভেতরে যত প্রবেশ করা যায় ততই রাজার আসল চেহারা একটু একটু করে ফুটে ওঠে এবং গল্পের শেষে পুরো চেহারা উন্মোচিত হয়ে যায়। গল্পের কথক বর্ণনার এক জায়গায় লিখেছেন, ‘হঠাৎ তার চোখ ঝকঝক করে উঠল, মৃদু হাসিটা মিলিয়ে গিয়ে শক্ত হয়ে উঠলো মুখের পেশীগুলো—মুহূর্তে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল আমার। রাজাবাহাদুরের দুচোখে বন্য হিংসা।’
আরেক জায়গায় লিখেছেন, ‘রাজাবাহাদুরের প্রখর উজ্জ্বল চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে এলো ক্রমশ, ফর্সা, লাল, গোলাপী রঙ ধরল। হঠাৎ অসুস্থ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।’ বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত মূল গল্প থেকে অনেকখানি সরে আসলেও রাজাবাহাদুরের চরিত্রের বন্য হিংসা, প্রখর চোখ, মৃদু হাসি, আবার তা মিলিয়ে গিয়ে মুখের পেশী শক্ত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সিনেমার রাজাবাহাদুরের চরিত্রেও নিয়ে এসেছেন নানা বৈচিত্রে। সিনেমার রাজাবাহাদুর পুরোনো গ্রামোফোন নিয়ে ঘুরে বেড়ান, শিকারের আগে পরে নাচেন কিন্তু ভেতরে পুষে রাখেন বন্য হিংসা। যিনি নিজেকে বাঘের মত ‘ইনডিজেনাস স্পিসিস’ বলেই মনে করেন। যিনি গ্রামোফোন নিয়ে ঘুরে বেড়ান, মনের আনন্দে নাচেন, গান করেন সেই তিনিই আবার তার রক্ষিতাকে ‘শালী ধুমসী’ বলে গালমন্দ করতে দ্বিধা করেন না, দ্বিধাবোধ করেন না ছোট ছেলেমেয়েদের বাঘের টোপ হিসাবে ব্যবহার করতেও।
গল্পে রাজাবাহাদুর যখন তিন চারদিনেও একটা বাঘ শিকার করে দেখাতে পারলেন না; তখন তার অস্থিরতার বর্ণনায় লেখক লিখেছেন, ‘অস্থির চঞ্চল পায়ে রাজাবাহাদুর ঘরের ভেতর পায়চারি করছেন। চোখমুখে একটা ঠোঁটদুটোর নিষ্ঠুর কঠিনতা। কখনো ভোজালি তুলে নিয়ে নিজের হাতের ওপরে ফলাটা রেখে পরীক্ষা করেন সেটার ধার। আবার কখনো বা জানালার সামনে খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন নিচের জঙ্গলটার দিকে। আজ তিনদিন থেকে উল্লেখযোগ্য একটা কিছু শিকার করতে পারেননি-ক্ষোভে তাঁর দাঁতগুলো কড়মড় করে।’
সিনেমায় যখন তথ্যচিত্র নির্মাতার দলের নীলা বাঘ শিকার করা নিয়ে রাজাবাহাদুরকে কটাক্ষ করে; তখন রাজাবাহাদুর ক্ষেপে গিয়ে মেয়েটির প্রায় মুখের উপর পড়ে চাপা স্বরে, সবার পায়ের মাপ দিয়ে যেতে বলেন এবং বাঘ মেরে সবাইকে বাঘের চামড়ার তৈরি চটি পাঠিয়ে দেবার প্রতিজ্ঞা করেন। রাজাবাহাদুরের অস্থিরতা দেখা যায় তখনো, যখন তিনি শিকারের টোপ বাঁধার দড়ি বের করেন। খেপে যাওয়া রাজাবাহাদুর মোষ বেঁধে যখন বাঘের দেখা পাচ্ছিলেন না; তখন তিনি পেয়ে যান মাদারীর খেলা দেখানো বাচ্চা মেয়ে মুন্নিকে।
মুন্নি তার মা-বাবার সাথে মাদারীর খেলা দেখায়। খেলা দেখানোর জন্য তারা ঘুরে বেড়ায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। ধোপারা যখন শেষ বিকেলে শুকিয়ে যাওয়া কাপড় তুলতে ব্যস্ত তখন পরিচালক লং শটে মুন্নিদের ফ্রেমে প্রবেশ করান। যেন এক লাল রঙের তিনটি বিন্দু একটি রেখায় এগিয়ে যায় বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ ধরে, যা এক দ্যোতনার জন্ম দেয়। আবার শেষ বিকেলে খেলা দেখিয়ে তাদের অস্থায়ী ঘরে ফেরার দৃশ্যও মনে করতে পারি, যেখানে মুন্নির বাবার কাঁধের বাঁশের আগায় ঝুলানো থাকে হারিকেন। লং শটে এই হারিকেনের হলুদ আলো জোনাকির আলোর মত দেখায়, যেন সন্ধ্যার অন্ধকারে জোনাকির আলোয় ঘরে ফিরছে স্বপ্নগ্রস্ত তিনটি মানুষ। গজা তাদের শত বছর বেঁচে থাকার ভবিষ্যদ্বাণী করেছে কিন্তু শত বছর বেঁচে থাকার তাদের এই স্বপ্ন মাদারীর খেলা দেখানোর চক্রে আটকে যায়। তবু মুন্নি শেষ বিকেলের আলোয় ‘শাদী’র স্বপ্ন দেখে, কনে সাজের স্বপ্নে সে বিভোর হয়। সে এর জন্য পয়সা জমা করে, যে পয়সার লোভ দেখিয়ে রাজাবাহাদুর তাকে একদিন শিকারের ‘টোপ’এ পরিণত করেন।
নীলাদের সাথে আলাপচারিতায় রাজাবাহাদুর যখন জঙ্গলের ভাষা বোঝানোর জন্য মুখ দিয়ে অদ্ভুত এক শব্দ করেন; তখন পরের দৃশ্যে আমরা মুন্নিকে দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে খেলা দেখাতে দেখি। আবার রাজাবাহাদুর যখন বাঘের টোপ হিসাবে মোষ বেঁধে বন্ধুক তাক করে থাকেন, এর পরের দৃশ্যেই আবার মুন্নিকে দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়, যে দড়ি বিগ ক্লোজআপে স্থির হয়। এই দৃশ্যান্তর রাজাবাহাদুর, মুন্নি ও দড়ির সাথে একটি সম্পর্কের ঈঙ্গিত বহন করে, যা পরবর্তী সময়ে উন্মোচিত হয়। ‘টোপ’ গল্পে রাজাবাহাদুর বাংলোর মাতৃহীন ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তেতলার জানালা থেকে পয়সা, রুটি কিংবা বিস্কুট ছুঁড়ে দেন, নিচে ওরা সেগুলো নিয়ে কুকুরের মতো লোফালোফি করে। কখনো এগুলো নিয়ে হরির লুটের মত কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। সিনেমায় এক বৃদ্ধের শবযাত্রার মিছিলের মাঝে রাজাবাহাদুরের সাথে মুন্নির দেখা হয়। হরিলুট দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছিল শবযাত্রা। শবযাত্রার মিছিল আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলে রাজাবাহাদুর মুন্নির দিকে কিছু পয়সা উড়িয়ে দেন, হরির লুটের মতই। মুন্নি খুশি হয় এবং রাজাবাহাদুরের ‘টোপ’ শিকারের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যায়। মুন্নি যখন অগভীর নদীর জলের উপর দিয়ে হেঁটে যায়; তখন সে অবাক চোখে মাছেদের সাঁতার দেখে। সে তখনো জানে না ভবিষ্যতে রাজাবাহাদুরের এক বিচিত্র ‘মাছ’ শিকারের ‘টোপ’ হতে যাচ্ছে। এভাবে একদিন নদীর পার থেকেই রাজাবাহাদুরের পাতা ফাঁদে পা দেয় মুন্নি।
বিচিত্র স্বভাব এই রাজবাহাদুরের। রাজাবাহাদুর হেঁড়ে গলায় গান করেন, গ্রামোফোনে গান বাজিয়ে নাচেন। রাজবাহাদুরের চরিত্রে থিয়েটার নাটকের গবেষক ও অভিনেতা সুদীপ্ত চট্টপাধ্যায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের এক অনন্য নির্বাচন। মুহূর্তে বদলে ফেলা মুখের ‘এক্সপ্রেশন’ কিংবা খালি গায়ে, ঘর্মাক্ত দেহে টোপ বাঁধার দড়ি বের করার দৃশ্যায়ন, ‘আজ খাবই খাব’ বলে রেখার ঘরে প্রবেশ এবং ফিরে আসার সময় রাজাবাহাদুরের চরিত্র রূপায়ন দেখে মনে হয়েছে সুদীপ্ত চট্টপাধ্যায় ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না।
রাজাবাহাদুর (সুদীপ্ত চট্টপাধ্যায়) তার নিজস্ব স্টাইলে যখন ‘আজ নয় গুনগুন’ গান গাইতে গাইতে, লম্বা প্যাসেজ ধরে, গায়ের কাপড় খুলতে খুলতে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে রেখার ঘরে প্রবেশ করেন এবং ভাঙা মনে ধীরে ধীরে আবার ফিরে আসেন, তখন রাজাবাহাদুরের চরিত্রের বিচিত্রতা নতুন রূপে ধরা পড়ে। রেখা যখন তার জলপুরুষের স্বপ্নে বিভোর, রাজাবাহাদুর তখন যেন বাস্তবতার সীমানা অতিক্রম করে রেখার স্বপ্নজগতে প্রবেশ করতে পারেন না। ফিরে আসেন। আবার রেখার স্বপ্নের পুরুষের বয়ানে আমরা জেনে যাই, রাজাবাহাদুরের আর রেখার সাথে শুতে ভালো লাগে না। রাজাবাহাদুর যখন আর্তনাদ করে তার পূর্বপুরুষের ছবির পেছন থেকে টোপ বাঁধার দড়ি বের করেন; তখন আমাদের বুঝে নিতে হয় ছোট শিশুদের বাঘের ‘টোপ’ হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে আসছে অনেক আগ থেকেই।
সিনেমার প্রথম দৃশ্যের মতই বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তরের দরজার ফ্রেমের ভেতর দিয়ে নেচে নেচে মুন্নিকে নিয়ে রাজাবাহাদুর প্রবেশ করেন। যেন নেচে গেয়ে রাজবাহাদুরের ‘টোপ’ ধরার উদযাপন। অদূরে পুরোনো গ্রামোফোনের ক্যাচক্যাচ শব্দ। লক্ষ্য রাখতে হবে, সিনেমা শুরুর প্রথম দৃশ্যে লং শটে গ্রামোফোন দরজার ফ্রেমের মাঝখানে রাখা ছিল। যখন মুন্নিকে নিয়ে রাজাবাহাদুর প্রবেশ করেন, গ্রামোফোনকে তখন বিগক্লোজআপে সিনেমার ফ্রেমের কোণায় দেখা যায়। তাহলে কি গ্রামোফোনও এক টোপের প্রতীক? সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও চলে টোপের ব্যবহার। তাই হয়তো শেষ দৃশ্যে রাজাবাহাদুরের বন্দুক, সিংহাসনের সাথে গ্রামোফোনকেও বিসর্জিত হতে দেখা যায়। সিনেমার প্রথম দৃশ্যে ও শেষ দৃশ্যের গ্রামোফোনের এমন ব্যবহারে দর্শক মনে একটি গভীর ভাবনার জন্ম দেয়, যার ব্যাখ্যা আরও অনেক ভাবেই হতে পারে কিংবা তা ব্যাখ্যাতীত। এখানেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সেই ‘ম্যাজিক’। গ্রামোফোনের ক্যাচক্যাচ শব্দের সাথে মিশে যায় ট্রেনের শব্দ। বাতাসের তোড় বেড়ে যায়, ঝড়ো বাতাসে উড়ে উড়ে ভুপতিত হয় সব রঙিন কাপড়। কী এক অমঙ্গলের বার্তায় ফ্রেম আউট হয় ঘোড়াগুলো। শূন্য থেকে নিচের দিকে নামতে থাকে এক জোড়া পা। তারপর ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয় পুরো শরীর। দড়ি দিয়ে বাঁধা মুন্নির শরীর ছটফট করতে করতে ‘টোপ’ হয়ে যায় বাঘের। উপর থেকে মুন্নির শরীর নিচের দিকে নামতে নামতে ফ্রেম আউট হয়। যে অনভুমিক দড়ির উপর দিয়ে মুন্নি হেঁটে যেত, এবার উলম্বভাবে পর্দায় দৃশ্যমান হয় রাজাবাহাদুরের দড়ি। আমরা শুনতে পাই বাঘের গর্জন, এরপর একটা বন্ধুকের গুলির শব্দ। মূল গল্পে যেখানে বাক্যের পর বাক্যে লিখে ঘটনার বর্ণনা লিখতে হয়, চলচ্চিত্রে সেখানে ইমেজ ও শব্দের মাধ্যমে খুব সহজে ঘটনার ভয়াবহতা প্রকাশ করা গেছে। যে ইমেজ মনের গভীরে প্রোথিত হয়ে যায়, ভাবায়।
এবার মূল গল্পের শেষ বাক্যগুলো একটু পড়ে দেখা যায়, ‘কীপারের একটি বেওয়ারিশ ছেলে যদি জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে থাকে তা অস্বাভাবিক নয়, তাতে কারো ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রকাণ্ড রয়েল বেঙ্গল মেরেছিলেন রাজাবাহাদুর, লোককে ডেকে দেখানোর মত। তার আট মাস পরে এই চমৎকার চটিজোড়া উপহার এসেছে। আটমাস আগেকার সে রাত্রি এখন স্বপ্ন হয়ে যাওয়াই ভালো, কিন্তু চটিজোড়া অতি মনোহর বাস্তব। পায়ে দিয়ে একবার হেঁটে দেখলাম, যেমন নরম, তেমনি আরাম।’
বাঘের চামড়ার নরম, আরামদায়ক, মনোহর চটি জুতা পেয়ে গল্পের কথক কীপারের ছেলের মৃত্যুকে স্বপ্ন হিসেবেই দেখতে চান। কিন্তু বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত গল্পের শেষকে যেন মেনে নিতে পারেন না। না হলে মুন্নির মায়ের আর্তচিৎকারে সিনেমা শেষ হয়ে যেত। পরিচালক মুন্নির মা ও বাবাকে, গজাকে, ঘোড়াসহ ধোপাদের রাজাবাহাদুরের সিংহ দরজায় নিয়ে যান। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে গজা, মুন্নির মা বাবা। তারা নেচে নেচে, বাজনা বাজিয়ে যেন ঘুমন্ত মানুষদের ঘুম ভাঙাতে চায়, প্রতিবাদী করে তুলতে চায়। অবশেষে রাজাবাহাদুরের মহলের সিংহদ্বার ভেঙে তারা ভেতরে প্রবেশ করে। জলে বিসর্জিত হয় রাজসিংহাসন, বন্দুক, গ্রামোফোন। জলের নিচের এই দৃশ্য আমরা মাছেদের চোখে দেখি। শোনা যায়, জলের কলকল শব্দ, যে শব্দ আমরা শুনতে পাই সিনেমা শুরুর আগের টাইটেলের সময়, রেখার জলস্নানের সময়, মুন্নিদের অগভীর নদী পেরিয়ে যাওয়ার সময়।
স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ক্ষেত্রে টোপ হিসাবে মানুষের ব্যবহারের প্রতিবাদ করেই শেষ হয় বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সিনেমা ‘টোপ’।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকার।
এসইউ/এএ/এমএস