দেশজুড়ে

অকল্পনীয় কৌশলে এখনও করোনামুক্ত আদিবাসী গ্রামগুলো

বিভিন্ন সুবজে ঘেরা বনসংলগ্ন জায়গায় বসবাস নৃতাত্তিক গোষ্ঠী খাসিয়া এবং গারো সম্প্রদায়ের। মূলত পাহাড় বনকে ঘিরে পানচাষ করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তাদের গ্রামকে পুঞ্জি বলা হয়। আধুনিক সুযোগ সুবিধার বাইরে গিয়ে পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করলেও তাদের মধ্যে সচেতনতার হার সাধারণের চেয়ে বেশি। এই সচেতনার প্রমাণ পাওয়া গেছে বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনাকালে।

Advertisement

করোনা মোকাবিলায় স্বাধ্যবিধি শতভাগ মেনে চলা এবং নিজেদের নিরাপদ রাখতে নিজেদের কৌশল প্রয়োগ করে শতভাগ নিরাপদ রয়েছেন মৌলভীবাজারের ৬৫ পুঞ্জিসহ সিলেট বিভাগের ৯০ পুঞ্জি। শুধু করোনা থেকে নয় এখন পর্যন্ত কারো উপসর্গ পর্যন্ত দেখা যায়নি।

বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরামের কো-চেয়ারম্যান এবং মাগুরছড়া পুঞ্জির মন্ত্রী জিডিশন প্রধান জানান, আমাদের কারো যেমন করোনা হয়নি তেমনি কারোটেস্ট করানোর প্রয়োজনও হয়নি। কারোনায় কারো মধ্যে লক্ষণই দেখা যায়নি যদিও আমরা লক্ষণ দেখা গেলে সাথে সাথে টেস্ট করাতে বলে রেখেছিলাম। স্বাস্থ্যবিধিসহ সব নির্দেষ অক্ষরে অক্ষরে মানার ফলেই এই অর্জন সম্ভব হয়েছে।

খাসিয়া সোশাল কাউন্সিলের দেয়া তথ্যমতে, মৌলভীবাজারের ৬৫টিসহ সিলেট বিভাগে ৯০টি পুঞ্জি রয়েছে। এসব পুঞ্জিতে বসবাস করেন প্রায় ৪০ হাজার নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠির জনগণ। ৪০ হাজার নৃতাত্ত্বিকের মধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় বসবাস করছেন ৩০ হাজার। করোনার প্রকপ শুরু হওয়ার পরই তারা নিজ উদ্যোগে লকডাউনে যান। বাইরের মানুষ ভেতরে প্রবেশ করা এবং ভেতর থেকে বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। সবার জন্য মাস্ক এবং স্যানিটাইজার বাধ্যতামূলক করা হয়।

Advertisement

তবে জীবনধারণের জন্য যেহেতু বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয় এবং খাসিয়া পুঞ্জির প্রধান আয়ের উৎস পান বিক্রি তাই এই ক্ষেত্রেও নেয়া হয় নিজস্ব কৌশল। প্রতিটা পুঞ্জির বাইরে নির্দিষ্ট জায়গা এবং সময় ঠিক করে দেয়া হয় পান বিক্রির জন্য। এতে যারা অংশ নেবেন তাদের মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যাবহার নিশ্চিত করা হয়। পান বিক্রি শেষে পুঞ্জির ভেতরে প্রবেশ করার সময় সবকিছু স্যানিটাইজ করে গোসল নিশ্চিত করা হয়। এমনকি বাইরে থেকে আসা পানের পাইকারদের থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বিক্রি করা হচ্ছে। পানের ক্রেতারাও পুঞ্জির দেয়া স্বাস্থ্যবিধি ও নির্দেশনা মেনে চলেছেন। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে পান বিক্রি করা হবে না এই নির্দেশনাও দেয়া হয়।

প্রতিটি পুঞ্জিতে একজনকে দায়িত্ব দেয়া হয় যার কাজ হচ্ছে সবার নিত্য প্রয়োজনী বাজার করে দেওয়া। করোনার শুরু থেকেই লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জির হাট বাজারের দায়িত্ব পড়েছে সাকিল পামথেটের। তিনি জানান, সপ্তাহে একদিন বাজারে যাই। তার আগে কার কী লাগবে সব তালিকা করে যাই। বাজার নিয়ে এসে প্রথমে সব জিনিস পুঞ্জির বাইরে এক জায়গায় রাখি এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্যানিটাইজ করি। যার যার জিনিসপত্র সে এসে নিয়ে যায়। এর মধ্যে আমি নির্দিষ্ট কারো ঘরে চলে যাই ও সেখানে সাবান দিয়ে গোসল করি। যেহেতু বাজারে যাই তাই নিজেকে সবার থেকে আলাদা রাখি এবং কোনো লক্ষণ আছে কি না বোঝার চেষ্টা করি।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার মেঘাটিলা খাসি পুঞ্জির হেডম্যান মনিকা খংলা বলেন, আমরা সবাইকে সচতন করে নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন জানিয়ে দেই এবং তা মানতে বাধ্য করি। ভাইরাসের বিরুদ্ধে সতর্কতা হিসেবে বাইরে থেকে আনা চাল-ডালের বস্তাও আমরা জীবাণুমুক্ত করে পুঞ্জিতে প্রবেশ করিয়েছি। আমারা সচেতন থাকায় এবং সবাই তা মানায় এখনও করোনামুক্ত।

লাউয়াছড়া পুঞ্জির মন্ত্রী ও সিলেট আদিবাসী ফোরামের সদস্য সচিব ফিলা পতমী জানান, পুঞ্জিতে প্রবেশে ও বাইরে বেরোনোর ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করে যখন আমরা লকডাউন করি তখন অনেকের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল। কিন্তু আমরা জানতাম আমরা ঠিক কাজ করেছি। সেই কাজ করেছিলাম বলেই এখন ফল পেয়েছি এবং সবার প্রশংসা পেয়েছি।

Advertisement

নৃ-তাত্তিক গোষ্ঠীর এমন উদ্যোগ এবং করোনা থেকে মুক্ত থাকায় প্রশংসিত হয়েছেন তারা।

মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, তাদের কার্যক্রমে প্রমাণীত হয়েছে সচেতন হলে সবাই সুরক্ষিত থাকবে এবং অন্যকে নিরাপদ রাখতে পারবে। খাসিয়া সম্প্রদায় সবার জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।

মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন তৌউহীদ আহমদ জানান, মৌলভীবাজার জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৩৫৮জন। এরমধ্যে মারা গেছেন ২০ জন। কিন্তু এরমধ্যে খাসিয়া পল্লীর কোনো সদস্য নেই।

রিপন দে/এফএ/পিআর