মতামত

ডিজিটাল বিভাজন

বাংলাদেশে মোবাইল সেবার ২৭ বছর হয়ে গেছে। দেশে মোবাইল ফোনের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে। সিটিসেল নিয়ে আসে প্রথম মোবাইল ফোন। এটা শুধু বাংলাদেশেই প্রথম ছিল না, উপমহাদেশের মধ্যে প্রথম মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ছিল। চড়া মূল্য এবং সীমিত নেটওয়ার্ক এর কারণে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের অল্প কিছু মানুষ এই ফোন ব্যবহার করতো। তবে মোবাইল ফোনকে সাধারণ মানুষের পণ্য করতে সহায়তা করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ১৯৯৬-এ ক্ষমতায় আসেন। ১৯৯৬ সালে তিনটি প্রতিষ্ঠান ‘গ্রামীণফোন’, ‘একটেল’ এবং ‘সেবা’ জিএসএম ঘরানার মোবাইল ফোন সেবা দেয়ার জন্য লাইসেন্স পায়। দ্রুত এই সেবা ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে।

Advertisement

বড় লোকের যন্ত্র থেকে দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়নে মোবাইল ফোনকে সহজলভ্য করে তোলেন শেখ হাসিনা। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার নিত্যসঙ্গী এখন মোবাইল। প্রতিটি সেকেন্ডে মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় সামগ্রী এই মোবাইল ফোন। জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি) তাদের ওয়েবসাইটে জানায়, বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি ছাড়িয়েছে। গত মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর অর্থনীতিতে যে স্থবিরতা দেখা গেছে সে কারণে এই সংখ্যা এখন কমেছে বলেই ধারণা করছি। নাগরিকের মুঠোয় সেবা, তা সে শিক্ষাই হোক বা ব্যাংক অথবা সরকারি কাজের সুবিধা, সবকিছুতে মোবাইল ফোন কাজে লাগছে।

মোবাইল ফোন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবনকে, অর্থনীতিকে যেমন গতিশীল করেছে, তেমনি পরিবর্তিত সময়ে এসে নতুন এক বিভাজন দেখছি আমরা। করোনাকালে মোবাইল ফোনে, ইন্টারনেট সিস্টেমে যে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে, সেটায় ৪০ শতাংশেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী অংশ নিতে পারেনি, পারছে না। স্মার্টফোন নেই, থাকলেও ইন্টারনেটের খরচ দেয়ার সক্ষমতা নেই, তাই এই ‘আন-স্মার্ট’ নাগরিকদের সন্তানরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। যে দেশে আর্থিক অসাম্য ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, সেদেশে এমন করে ডিজিটাল জগতে প্রবেশ করতে না পারা নাগরিকদের জন্য বৈষম্যের পথকে আরও সম্প্রসারিত করে। শহর কিংবা গ্রাম, যে যেখানেই এই সুযোগ হারাচ্ছে সে আসলে শিক্ষার অধিকার হারাচ্ছে, হারাচ্ছে নিজেদের ভবিষ্যৎ।

অন্যদিক থেকেও এই ডিজিটাল বিভাজন স্পষ্ট। মানুষের পুরো জীবন ব্যবস্থা যখন ফোননির্ভর বাজারব্যবস্থায় কাঠামোবদ্ধ, সেই বাজারে মানুষ কেবলই ভোক্তা, যার কোনো অধিকার নেই কিছু বলার। পুরোটাই সেবা প্রদানকারী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অধিকার। স্মার্টফোননির্ভর প্রযুক্তি শুধু গরিবের নাগালের বাইরেই নয়, ভোক্তার অধিকারের বাইরেও।

Advertisement

করোনার মধ্যেই অর্থমন্ত্রী জুন মাসে যে বাজেট দেন সেখানে মোবাইল সেবায় সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা করা হয়েছে, যার ফলে ফোনে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সরকারের কাছে কর হিসাবে যাবে প্রায় ২৫ টাকা- যা এতদিন ছিল ২২ টাকার মতো। এর ফলে মোবাইল ব্যবহারকারীদের ফোনে কথা বলার খরচ তো বাড়লোই, মোবাইল ইন্টারনেটের খরচও বাড়লো। সরকারের এই সিদ্ধান্ত এমন সময় এলো, যখন করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশের অধিকাংশ মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত এবং ঘরে থেকে সময় কাটানোর জন্য ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীলতা অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে।

আমরা দেখলাম সরকারের ভাবনায়ও ডিজিটাল বিভাজনের দর্শন। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের খরচ বাড়লে গরিবের সমস্যা, নিম্ন মধ্যবিত্তের সমস্যা, ক্ষেত্র বিশেষে মধ্যবিত্তের সমস্যা। সমস্যা নেই কেবল ধনিক শ্রেণির।

আমাদের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আসছে বা আসবে। ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে সুবিধাভোগী শ্রেণির জন্য যে সেবা আছে তা আরও বিস্তৃত হয়ে ‘ক্যাশলেস ইকোনমি’-তে এগুতে থাকবে। নগদের পরিবর্তে ডেবিট কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা ই-ওয়ালেটের ব্যবহার বাড়তে থাকবে। প্রযুক্তি কীভাবে জীবনকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে, পকেটে থাকা মোবাইল ফোন তার সাক্ষ্য দেবে। অতএব, যে ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি প্রযুক্তি, সেটাই জনসাধারণের পক্ষে অসুবিধাজনক, যেহেতু সেটা সবার জন্য সহজলভ্য নয়। ক্যাশলেস ইকোনোমি বাস্তবতা, তবে স্বল্পমেয়াদের জন্য হলেও তা ক্ষমতাবানদের পাল্লা আরও ভারী করবে। সেটা ধনী-দরিদ্রের বিভাজনই হোক অথবা শহর-গ্রামের বিভাজন হোক, বিষয়টি কার্যত এক।

স্মার্টফোন এবং তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর দুনিয়ায় এখনো যাদের প্রবেশাধিকার ঘটেনি, তারা কোণঠাসা হবে। ছোট ব্যবসায়ীর ব্যবসা মার খাবে, কৃষক টাকার অভাবে চাষ করতে পারবে না। এই অসুবিধাসমূহের কাছে নতি স্বীকার করে নেয়াই হয়তো নিয়তি।

Advertisement

তাই রাষ্ট্রের কিছু করা প্রয়োজন। ডিজিটাল ইকোনোমি থেকে ডিজিটাল লিভিংয়ে যেতে শুধু কম্পিউটার আর বিশাল মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা দেখালেই বাংলাদেশ ডিজিটাল হয়ে যাবে না। কিছু বাস্তব উদ্যোগ প্রয়োজন। ইন্টারনেট সেবার প্রসার বাড়াতে হবে। তার জন্য বিপুল অবকাঠামো প্রয়োজন। স্মার্টফোনের প্রযুক্তিকে আরও সহজলভ্য, আরও সস্তা করতে হবে। তার কতখানি সরকার করবে, কতটা বাজারের মাধ্যমে হবে, সেটি সিদ্ধান্ত হোক। মোটকথা, শহর যা পায়, গ্রামও যাতে ততখানিই পেতে পারে; ধনীর যা স্বভাবত জোটে, দরিদ্রও যেন তাতে বঞ্চিত না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/জেআইএম