ড. ইনামুল হক। দেশের প্রখ্যাত সংস্কৃতিব্যক্তিত্ব। একাধারে অভিনেতা, লেখক, নাট্যকার, শিক্ষক। দীর্ঘকাল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করার প্রয়াসে বিভিন্ন আন্দোলনমুখী নাটকে অংশগ্রহণ করে আলোচনায় আসেন।
Advertisement
১৯৭০ সালে আইয়ুব খানের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তৎকালীন অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন তিনি নাট্যচর্চাকে হাতিয়ার করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সৃজনীর ব্যানারে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ট্রাকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে পথনাটক করেছেন। টিভিতে অভিনয় করছেন কয়েক দশক।
লেখালেখিতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। তার ১৮টি নাটক বিভিন্ন নাট্যপত্রে, বিশেষ ম্যাগাজিনে এবং বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। তার গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে নির্জন সৈকতে, গৃহবাসী, মুক্তিযুদ্ধ নাটক সমগ্র, স্ট্রিন্ডবার্গ এর দুটো নাটক, মহাকালের ঘোর সওয়ার, বাংলা আমার বাংলা ইত্যাদি।
বর্ণিল ক্যারিয়ারের স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক, টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ পুরস্কার আজীবন সম্মাননা, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন ড. ইনামুল হক।
Advertisement
সংস্কৃতির আঙ্গিনায় সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই কিংবদন্তি সম্প্রতি এক আড্ডায় মেতেছিলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সেই আড্ডার চুম্বকাংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন অরণ্য শোয়েব-
জাগো নিউজ : কেমন আছেন স্যার?ড. ইনামুল হক : এই বয়সে যেমন থাকা যায় আরকি। শারীরিক ভাবনায় ভালোই আছি। মনের দিক দিয়ে একটু কষ্টে। কারণ হচ্ছে দেশ এবং জনগণের অবস্থা খুব ভালো না। করোনা, বন্যা নিয়ে বিষাক্ত এক সময় পার করছে বাংলাদেশ। সারা পৃথিবীটাই আসলে ভালো নেই।
জাগো নিউজ : দীর্ঘ সময় বাসায়ই আছেন। সময় কাটছে কি করে? ড. ইনামুল হক : আগেও খুব একটা বাইরে যাওয়া হতো না। শুটিং থাকলে শুধু বের হতাম। এমনিতে বাসায় থাকলে বই পড়ি। এ লম্বা সময়টাতেও অনেক বই পড়েছি। পুরনো কিছু নাটক দেখেছি। পরিবারকে সময় দিচ্ছি। নাতিদের সাথে দুষ্টুমি করে সময় চলে যাচ্ছে।
মাঝে মধ্যে সহ-অভিনেতাদের সঙ্গে ফোনে একটু কথা-আড্ডা হয়। বন্ধুদের সঙ্গে, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়। এসব করেই যাচ্ছে দিন। কিছু অনুবাদ করছি। যেসব শিল্পীর অবস্থা একটু শোচনীয় তাদের অনুদানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে খোঁজখবর নিচ্ছি, এখনো করছি। আরো কিছু নিজের অফিসিয়াল কাজ রয়েছে সেসবও করতে হচ্ছে। ঘরে থাকলেও আসলে অবসরে আছি বলা যাবে না। কাজ ছাড়া আমার ভালোও লাগে না।
Advertisement
জাগো নিউজ : এদিকে শুটিং শুরু হয়েছে অনেকদিন ধরেই। আপনি ফিরবেন কবে? ড. ইনামুল হক : এখনো শুটিংয়ে ফেরার পরিকল্পনা করিনি। সাহসই করছি না। মনে হয় না এই মাসে কাজ করবো। যদিও অনেকেই কাজের জন্য ফোন দিয়েছেন। তাদের এখন না করতে হচ্ছে।
শারীরিক অর্থে অনেটাই স্ট্রংও নেই। বয়সের তো একটা বিষয় আছে। মাঝে মধ্যে কিছু ভীতিও কাজ করে মনের মধ্যে। পরিবার থেকেও এখন চায় না খুব বেশি কাজ করি। বিশেষ করে করোনার এই অসময়ে। অসুখটা তো বয়স্কদের জন্য একেবারেই প্রাণঘাতী! যাক আরও কিছু দিন।
জাগো নিউজ : বয়সের কারণে কী কাজে অনিয়মিত দেখা যায় আপনাকে?ড. ইনামুল হক : বলাই যেতে পারে। এ বয়সে আসলে আমি নিজেই এখন আর চাইলেও নিয়মিত কাজ করতে উৎসাহী নই। ভালো গল্পের নাটক হলে সেটি আমি আগ্রহের সহিত করি। ভালো কাজে অংশ নিতে সব শিল্পীই চায়। একটু প্রতিকূলতা থাকলেও সেটা কাটিয়ে ওই কাজটি করতে চায়। আমিও চাই।
জাগো নিউজ : টেলিভিশন নাটকের গুণগত মান আজ কাঠগড়ায়। অনেক কথা হয় সে নিয়ে। আপনার অভিমত কী সাম্প্রতিক নাটক ও টেলিফিল্ম সম্পর্কে?ড. ইনামুল হক : ঢালাওভাবে বলা যাবে না যে মান নেই। অবশ্যই আছে। হয়তো যে পরিমাণ কাজ হচ্ছে সে তুলনায় মান কম। কিন্তু অনেক মানসম্পন্ন, সুন্দর কাজ হচ্ছে এখানে। নাটক-টেলিফিল্মে মান দুর্বল হওয়ার কিছু কারণ রয়েছে। তার অন্যতম হচ্ছে শর্টকার্টে কাজ করতে চায় অনেকেই।
শিল্প কখনো শর্টকার্টে হয় না। শিল্প সৃষ্টির জন্য অনেক মনোযোগ দরকার। এখনকার কথা বাদই দিলাম। কারণ এখন আসলে অংকটাই বদলে গেছে। স্ক্রিপ্টের কাজে উদাসীনতা এসেছে। প্রস্তুতি নেই। ধর-মার-কাট গতিতে চলছে। কিছু একটা স্ক্রিনে ভেসে উঠলেই বলা হচ্ছে ওকে, টেক।
ভাঁড়ামি টাইপের নাটকের জন্য যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেটা আর কী বলবো। তার জন্য বিরক্ত হয়েও অনেক দর্শক নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কমেডি খুবই জনপ্রিয় সব দেশেই। সবাই বিনোদন চায়। কিন্তু তারও একটা আর্ট আছে, প্রেজেন্টেশনের ব্যাপার আছে।
দেখুন আমাদের টেলেন্টের যে অভাব সেটা নয় কিন্তু। অনেকেই ভালো লিখছে। আবার অনেকেই ভালো ডিরেকশনও দিচ্ছে। এই সংখ্যাটা খুব কম।
জাগো নিউজ : এই আলোচনাটাও খুব হচ্ছে আমাদের শোবিজে যে আজকাল নাটকের চরিত্রের সংখ্যাও কমেছে, মানও কমেছে...ড. ইনামুল হক : অবশ্যই কমেছে। আগে দেখতাম কিছু কাজ এক্সপেরিমেন্টের জন্য হতো যেখানে দু-একজন শিল্পী থাকতেন। এগুলো একটা ভিন্ন মজা দিয়েছে। কিন্তু সেই ব্যতিক্রমটাই এখন নিয়ম হয়ে গেছে। এজন্য চোখে লাগে। সব নাটকেই দেখা যায় নায়ক-নায়িকা আর তাদের বন্ধুরা। যদিও বাবা-মা-পাড়া-প্রতিবেশীরা চরিত্র হয়ে আসছেন সেগুলোর প্রতি খুব একটা যত্নশীল নন নির্মাতারা। সব ওই দুজনকেই কেন্দ্র করে। এটা মন্দ তা বলবো না। কিন্তু এতে নাটকটি সব শ্রেণির দর্শককে বিনোদন দিতে পারে না। সাময়িক ভিউ হলে এটি টিকে থাকছে না। আগের নাটকগুলো যেমন মনে পড়লেই সবাইকে রোমাঞ্চিত করে তেমনটা হচ্ছে না।
এর পেছনে অনেকেই বাজেটের ঘাটতির কথা বলেন। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। আগেও যে সবাই অনেক বাজেটে নাটক বানিয়েছে তা কিন্তু নয়। অল্প বাজেটেও ভালো কাজ হয়েছে। এখনো হচ্ছে। আসলে ফ্যামিলি ড্রামা করা খুবই ডিফিকাল্ট। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানতে হবে। তাহলেই তো ওই চরিত্রগুলোকে ফুটিয়ে তোলা যাবে। চরিত্র বুঝতে হলে পড়তে হয়, জানতে হয়, শিখতে হয়। সেই সময় এখনকার লোকদের নেই। তারা সব শর্টকাট করে। কিন্তু একটু চিন্তা ভাবনা করলে, মেধাটা খাটিয়ে পরিশ্রম করলে ভালো কিছু করা সম্ভব।
জাগো নিউজ : আজকাল প্রায় সব নাটকেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব এবং আফরান নিশো, দর্শকপ্রিয় এই দুই অভিনেতাকে দেখা যায়। গত কয়েক বছর ধরেই টিভির পর্দায় তাদের জয়জয়কার। এ দুই অভিনেতার উপস্থিতি মানেই দর্শকের জন্য বাড়তি আগ্রহ। আপনিও তাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। জুনিয়র এই দুজনের কোন কোন বিষয়গুলো একজন সিনিয়র অভিনেতা হিসেবে আপনাকে মুগ্ধ করে? ত্রুটিগুলোও ধরিয়ে দেবেন.... ড. ইনামুল হক : শুধু আলোচিত বা চাহিদাসম্পন্ন বলবো না, আমি বলবো এই মুহূর্তে তারা দুজনই ভালো কাজ করছে। দুজনই খুব ভালো অভিনেতা। ভার্সেটাইল। তাদের সঙ্গে আমার অনেক কাজ হয়েছে। অপূর্বর কণ্ঠ ও সংলাপের ভঙ্গিমা সেরা। আমাদের এখনকার কম অভিনেতাদের মধ্যেই এই গুণ আছে। অভিনেতার জন্য কণ্ঠটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। চরিত্র অনুযায়ী কণ্ঠ পরিবর্তন করতে পারাটা বিশেষ গুণ। অপূর্ব এটা দারুণ পারে। ও কথা বললে সেটা শুনতে ইচ্ছে করে।
অপরদিকে কণ্ঠের জায়গা নিশো দুর্বল। তার এক্সপ্রেশন ইজ গুড। নিশো নিজেকে সহজে চরিত্রের জন্য ভাঙতে পারে। ও বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অনেক কাজ করছে।
সেদিক থেকে অপূর্বকে ব্যবহার করা হচ্ছে কম। ওর প্রেমিক ইমেজটি অনেক স্ট্রং দর্শকের কাছে। কিন্তু ওর যা পারসোনালিটি, অভিনয়ের ক্ষমতা আমার মনে হয় তাকে নিয়ে আরও অনেক এক্সপেরিমেন্ট করতে পারেন নির্মাতারা। অপূর্বকেও নিজের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। বৈচিত্র্যময় কাজ করার এই তো সময়।
জাগো নিউজ : টিভি মিডিয়ায় কি নোংরা রাজনীতি হয়? ড. ইনামুল হক : বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত বলতে চাই না। তবে কিছু ক্ষেত্রে তো হয়, হচ্ছে।
এলএ/পিআর