কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র মেরামত এবং স্লিপ ফান্ডের জন্য বরাদ্দকৃত টাকার সিংহভাগই ঘুষ দিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঘুষের টাকা যাচ্ছে উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা-কর্মচারী, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রকৌশলী ও শিক্ষক নেতার পকেটে।
Advertisement
ঘুষের টাকার ভাগবাটোয়ারার দায়িত্বে রয়েছেন খোদ উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা। ঘুষের টাকা বণ্টন শেষে নামমাত্র কাজ দেখিয়ে বাকি টাকা প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি আত্মসাৎ করেছেন। ফলে সরকারের বরাদ্দের টাকায় বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন না হলেও সংশ্লিষ্ট অসাধু ব্যক্তিদের উন্নয়ন হচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ক্ষুদ্র মেরামতের কাজে উপজেলার ৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য এক লাখ ৫০ হাজার করে মোট এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। একই সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) অধীনে ৫৬টি বিদ্যালয়ের জন্য দুই লাখ করে মোট এক কোটি ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
পাশাপাশি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বরাদ্দের ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা ৩৯টি বিদ্যালয়ে এক লাখ ৫০ হাজার করে দেয়া হয়। সেই সঙ্গে পিইডিপি-৪ এর আওতায় ৪২টি বিদ্যালয়ের জন্য দুই লাখ করে মোট ৮৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এর সঙ্গে ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্লিপ ফান্ডের জন্য ১৩৫টি বিদ্যালয়ে ৪০ হাজার করে মোট ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। সব মিলিয়ে বরাদ্দের টাকার পরিমাণ চার কোটি ১৩ লাখ ৫০ হাজার।
Advertisement
সে হিসাবে উপজেলার একাধিক বিদ্যালয়ে দুই থেকে তিনটি করে প্রকল্পের টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে বিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজ শেষ করার কথা থাকলেও কাজ হয়নি কোনো বিদ্যালয়ে। অথচ কাজ সমাপ্ত দেখিয়ে বিল ভাউচার জমা দিয়ে টাকা তুলে নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধানরা।
উপজেলার কেদার, কচাকাটা, বল্লভের খাষ, রায়গঞ্জ ও নারায়ণপুর ইউনিয়নের কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, মার্চ মাস থেকে বিদ্যালয়ে তালা ঝুলছে। করোনার শুরু থেকে এসব বিদ্যালয় বন্ধ। ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে বিদ্যালয়গুলো। চলতি বছর উন্নয়নকাজ হয়নি কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অথচ উন্নয়নের বরাদ্দের টাকা তুলে নিয়েছেন প্রধান শিক্ষকরা।
কেদার ইউনিয়নের সুভার কুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকার বাসিন্দা সবুর মিয়া, শাহ আলম, কাটাজেলাস সরকারি বিদ্যালয় এলাকার আবু হানিফ, বিষ্ণুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকার আব্দুল বাতেন, প্রভাষক আজাদ হোসেন ও ভাটিকেদার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকার নুরুন্নবী মিয়া জানান, এ বছর মার্চ মাস থেকে বিদ্যালয়গুলো বন্ধ। আমাদের ছেলে-মেয়ে বাড়িতে। এরই মধ্যে একদিনের জন্যও বিদ্যালয় খোলা হয়নি। উন্নয়নমূলক কাজ হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।
তাদের অভিযোগ, এর আগে উন্নয়নের নামে যা বরাদ্দ এসেছে প্রধান শিক্ষক ও কমিটির লোকজন ভাগবাটোয়ারা করে পকেট করেছেন। বরাদ্দ কখন আসে, কীভাবে খরচ হয় অভিভাবকসহ কমিটির সদস্যরা জানেন না। বিষয়গুলো সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত করা দরকার। বরাদ্দ পাওয়া বিদ্যালয়ের নাম শিক্ষা অফিসে সাইনবোর্ডে টাঙিয়ে দেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রতি বছর জুনে কোনো না কোনোভাবে বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। বর্ষা, বন্যা এমনকি ছুটিসহ নানা কারণে বন্ধ হয়। বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করতে সুবিধা হয় সংশ্লিষ্টদের। এজন্য আগস্ট থেকে পরের বছরের মে মাস পর্যন্ত বরাদ্দ নির্ধারণ করা জরুরি। এতে প্রকল্পের টাকা সঠিকভাবে ব্যয় হবে; সেই সঙ্গে বিদ্যালয়ের উন্নয়ন হবে।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বছর বরাদ্দের সব টাকা ৩০ জুনের আগে প্রকল্পের কাজ শেষ দেখিয়ে ভাউচার দিয়ে ট্রেজারি থেকে তুলে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তার অফিসের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা রেখেছেন। এখন প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে এক এক করে বরাদ্দ ছাড় দিচ্ছেন। এরই মধ্যে বরাদ্দের টাকা ছাড়ে ঘুষ নিয়ে দর-কষাকষির বিষয়টি ফাঁস হয়েছে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রকৌশলী, শিক্ষক নেতাসহ অনেক ধাপে এ বরাদ্দের টাকা ভাগবাটোয়ারা হয়। খোদ শিক্ষা অফিস থেকে বলা হয়েছে, বরাদ্দের অর্ধেক টাকার কাজ করে বাকি টাকা ঘুষ দিতে হবে বিভিন্ন অফিসে।
এ বিষয়ে সুভার কুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খোরশেদ আলম বলেন, বিল-ভাউচার সব তৈরি। ঘুষের টাকা দেয়া নিয়ে দেনদরবার চলছে। বরাদ্দের ৫০ ভাগ টাকা বিভিন্ন অফিসে দিতে হবে। এসব কথা শিক্ষা অফিস থেকে আমাদের জানানো হয়েছে। হয়রানির ভয়ে সংশ্লিষ্টদের নাম বলতে রাজি হননি প্রধান শিক্ষক খোরশেদ আলম।
নাম গোপন রাখার শর্তে আরেকটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, প্রত্যয়ন নিতে উপজেলা প্রকৌশলীর নামে সাত হাজার, এস্টিমেট প্রস্তুতের নামে তিন হাজার, বিল-ভাউচার তৈরির নামে দুই হাজার, উপজেলা পরিষদের নামে ২০ হাজার টাকা ঘুষ নিচ্ছেন উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ইছাহাক আলী। সেই সঙ্গে শতকরা ১৫ ভাগ টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার অফিসে।
উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ইছাহাক আলী এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে তোলা এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি তো বিলে স্বাক্ষর করি না। আমার নাম ব্যবহার করে কেউ এমন করেছেন হয়তো। বিষয়টি আমার জানা নেই।
উপজেলা প্রকৌশলী বাদশা আলমগীর বলেন, বিদ্যালয়গুলোতে সরেজমিনে কাজ দেখে প্রত্যয়ন দেয়া হয়। ঘুষ নেয়ার বিষয়টি ভিত্তিহীন। তবে কেউ কেউ অভিযোগ করতে পারে।
এ বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা স্বপন কুমার অধিকারীর বক্তব্য জানা যায়নি। তিনি দীর্ঘদিন অফিসে না এসে লালমনিরহাটে নিজ বাড়িতে বসে অফিস করছেন। একাধিকবার তার নম্বরে কল দিলেও রিসিভ করেননি।
এসব বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূর আহমেদ মাছুম বলেন, অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই শিক্ষা কর্মকর্তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বরাদ্দের সব টাকা উত্তোলন করে রেখেছেন। বিদ্যালয়গুলোর কাজ করার পর এসব টাকা দেয়া হবে। বরাদ্দের অর্ধেক টাকা ঘুষ এবং ভাগবাটোয়ার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। কেউ অভিযোগ দিলে বিষয়টি খতিয়ে দেখব।
নাজমুল হোসাইন/এএম/এমকেএইচ