কথায় বলে, বানরের গলায় মুক্তার হার বা বানরের হাতে তরবারি। পশ্চিমা বিশ্বের তৈরি করা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আমাদের দেশে এসে এই অবস্থায় পড়েছে। যার যা খুশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাউন্ট খুলে লিখছে। যাকে সামান্য অপছন্দ করছে তাকে হেয় করে ছাড়ছে। তার সামাজিক অবস্থান, মর্যাদা কোনো কিছুই পরোয়া করছে না। হাঁতুড়ে ডাক্তারের কাছে সার্জারির অপারেশনের মতো অবস্থা। নির্দ্বিধায় ফোঁড়া ফাটিয়ে ফেলছে, এতে শরীরের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে কোনো চিন্তা নেই। বিশেষ করে নারী সম্পর্কিত কোনো বিষয় যদি হয় তাহলেতো কথায় নেই! নেই নারীকে নিয়ে চুলচেঁড়া বিশ্লেষণ শুরু করে দেয় এদেশের নেটিজনেরা।
Advertisement
এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চাপে কিন্তু অনেক নারীই নিজেকে গুটিয়ে নেন। সামাজিকভাবে বা নিজের মেধা বিকাশ দিয়ে তিনি নিজেকে প্রস্ফুটিত করতে পারেন না। আবার এমনও হয় এসব ট্রল বা মিমের কারণে অনেকে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নেন। কিন্তু যারা ধর্মকে জড়িয়ে একজন নারীকে সামাজিকভাবে হেয় করার চেষ্টা করেন তারা এমন সব বাক্য বা বিশ্লেষণ জুড়ে দেন যা রীতিমতো অপরাধের সামিল। আর কিছু ইউটিউবার বা ফেসবুক পেজধারী রয়েছেন তারা নিজেদেরে চ্যানেলের সাবস্কাইবার বা পেজের ভিউ বাড়ানোর জন্য একটু বাড়তি রঙ যোগ করে। অনেক ‘ডট কম’ ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যমও এমনটি করে থাকেন।
সম্প্রতি তেমন একটি বিষয় ঘটেছে যশোরের মেয়ে ফারহানা আফরোজার ক্ষেত্রে। তিনি বাইক চালিয়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান উদযাপন করেছেন। সেটিই এখন ভাইরাল বিষয়। সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। তবে বিষয়টি সহজ ভাবে নেননি অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফারহানাকে নিয়ে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। শুধু তাই নয় ফারহানার গায়ে হলুদের ছবি এবং ভিডিও ইউটিউবসহ নানা যোগাযোগমাধ্যমে বিরূপভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এবং যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন তাদের বেশিরভাগেরই মন্তব্য এতোটাই জঘন্য যে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ফারহানা আফরোজ পরে বাধ্য হয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখতে এবং একই সঙ্গে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যকারীদের বিরুদ্ধে বিচার দাবি করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমার সাথে এটা হয়েছে আমি চাই না এরকম হেরাসমেন্ট আর কোন মেয়ে বা লেডি বাইকারের সাথে হোক। এমনিতেই সমাজে আমারা যারা বাইক চালাই তাদের অনেকের কথার সাথে লড়াই করতে হয়। ধীরে ধীরে এগুলো কমবে, তা না বেড়েই চলেছে? আর কতদিন দেখব আমাদের সাথে এই অত্যাচার জানি না।
যেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী মেয়ে, স্পিকার মেয়ে, দেশ মেয়েরা চালায় সেখানে একটা মেয়ে যে বাইক জানে তার বাইক চালনো কেন সমাজ ভালো ভাবে নিচ্ছে না? নিচ্ছে না মানলাম কিন্তু তার চরিত্র নিয়ে আজে বাজে কথা। এগুলো কীভাবে সহ্য হয়? আমার ও পরিবার আছে। বর আছে, শ্বশুরবাড়ি আছে। আমার বর শ্বশুরবাড়ি না হয় আমার পক্ষে আছে। আমার কোন সমস্যা নাই। কিন্তু সমস্যা না থাকলেই কী এভাবে একটা মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলতে হবে? শুধু বাইক চালানো ছবি দেখে সবাই আমার চরিত্র সনদ দিয়ে দিল? এগুলির বিচার কি হবে?’
Advertisement
দেখেন ফারহানা কতো সুন্দর করে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। ফারহানার এই ফেসবুক স্ট্যাটাসের নিচেও যেসব কমেন্ট করেছেন অনেকে, তারও বেশিরভাগ পড়ার অযোগ্য। তার পারিবারিক জীবন, বিয়ে, সন্তান কতোকিছুই যে মানুষ বের করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে তা বলা বাহুল্য! তর্কের খাতিরে ধরা যাক, তার বাইক চালানোটা কারো অপছন্দ হতেই পারে, সেক্ষেত্রে তিনি চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারতেন অথবা প্রতিবাদ করলেও সেটি শালীন ভাষায় করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে যেভাবে অতীত টেনে আনছেন পরিবার বা মেয়েটির মন দৃঢ় বলেই টিকে থাকা সম্ভব। আমরাতো এমন মেয়েই চাই।
আমরা বলি সমাজ এগুচ্ছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যে কুপমণ্ডুকদের আখড়া সেটা যে কেউ বুঝবেন। অথচ এদেশের মেয়েরা এখন বিমান চালান, গাড়ি বা বাইকতো নিয়মিত ঘটনা। এছাড়া অফিসে যাওয়ার জ্যাম থেকে বাঁচতে বা নিজের আয় রোজগার করতেও অনেকে বাইক চালান। রাইড শেয়ার করেন। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এই যে নারীর অগ্রগতি এটি কিন্তু একটি আদর্শ রাষ্ট্রের উন্নয়নের প্রথম সোপান। আর রাষ্ট্র সেটিকে সাপোর্ট করে বলেই সেটি সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু যারা হয়তো লেখাপড়া করেছেন কিন্তু শিক্ষিত হতে পারেননি তারা কিছুতেই নারীর অগ্রযাত্রাকে ভালো চোখে দেখেন না। সেটি শুধু আমাদের দেশে কেন, যারা ধর্মান্ধ, অনগ্রসরমান তারা চান নারীকে দমিয়ে রাখতে। তারা চান নারী বন্দি থাকুক চার দেয়ালের মাঝে। সময় পার করুক রান্না আর স্বামী সন্তান নিয়ে। অথচ কে না জানে বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। কিন্তু যেসব দেশে দেখা যায় উগ্রবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সেসব দেশেই নারীকে করে তোলা হয়েছে মহিলা। অন্দরমহলেই তাকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে অস্ত্র বা সন্মানহানির ভয় দেখিয়ে।
আমাদের এখানেও এসব নিয়ে কম ফতোয়া জারি হয়নি। যখনই কোনো নারী শুভবোধের পরিচয় দিয়ে ধর্মান্ধতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে চেয়েছে তখনই উগ্রবাদীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ব্যতিক্রম কিছু যেন সহ্য করতে পারে না। কিন্তু রাষ্ট্র হয়তো নারীর উত্থান চায় বলেই তিনি এগিয়ে যেতে পেরেছেন বা পারছেন। কাজেই নারীর প্রতি যারা বিরূপ, অবমাননা যাদের নিত্যসঙ্গী তাদের বিষয়েও কঠোর হতে হবে রাষ্ট্রকেই। তবেই বাজবে নারীর বিজয় কেতন। ভগিনি, মাতারা জেগে উঠার সাহসতো আমাদেরকেই দিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
Advertisement
এইচআর/এমকেএইচ