দেশজুড়ে

বজ্রপাতে সাড়ে ৫ বছরে ৯৪ জনের মৃত্যু, পরিবারগুলোর করুণ দশা

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার চরানচর ইউনিয়নের ললুয়ারচর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল খালেক। চলতি বছরের ৪ জুন প্রবল বৃষ্টিপাত ও ঝড়ের মধ্যে উপজেলার মিলন বাজার সংলগ্ন হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যান আব্দুল খালেকের বড় ছেলে তকবির হোসেন (২০)। বড় ছেলে তকবির ছিলেন পেশায় জেলে। হাওরে মাছ ধরে তা বিক্রি করে পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু একটি দুর্ঘটনায় পরিবারের একজন সদস্যও ভালো নেই। ছেলে মারা যাওয়ার পর আব্দুল খালেকের সুখের সংসারে অন্ধকার নেমে আসে। সরকারি সহায়তাও পাননি তিনি।

Advertisement

আব্দুল খালেক জাগো নিউজকে বলেন, আমার ছেলে তকবির হোসেন হাওরে মাছ ধরতো। আমার তিন ছেলে ও এক মেয়ের সংসারে সে আছিল সবার বড়। কিন্তু গেল মাসের ৪ জুন ঠেলা জাল দিয়ে হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে আমার ছেলে বজ্রপাতে মারা যায়। সে মারা যাওয়ার পর থকি আমি রোজ কামলার কাজ করি। কোনো দিন ১৫০ টাকা, কোনো দিন ২০০ টাকা আবার কোনোদিন একটাকাও আয় হয় না। আমার ছেলে মারা যাওয়ার পর কোনো সরকারি সহায়তাও দেয়া হয়নি। এছাড়া কোনো ব্যাংকও আমাদের ঋণ দেয় না। আমারে যদি কোনো বড় মনের মানুষে একটা অটোরিকশা কিনার টাকা বা ঋণ দিতো তাইলে আমি সারাজীবন ওই মানুষটার কাছে কৃতজ্ঞ থাকতাম।

দেশের হাওর প্রধান জেলা সুনামগঞ্জে প্রতিবছর বজ্রপাতে প্রাণ হারায় অনেক মানুষ। কৃষি ও মৎস্য আহরণ এখানকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস। তবে হাওরেই প্রতিবছর বজ্রপাতে প্রাণ দিতে হয় অনেককে। সরকারের পক্ষ থেকে বজ্রপাতে মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিবারকে ২০ হাজার টাকা দেয়া হলেও কারও কারও ভাগ্যে সেই টাকাও জোটে না। বজ্রপাতে মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিবারকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য দেয়া হয় না কোনো ঋণ। পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেকেই পথে বসার উপক্রম।

সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সুনামগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ২৫ জন বজ্রপাতে মারা যান। এছাড়াও ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মারা গেছেন প্রায় অর্ধশত মানুষ। ২০১৯ সালে মারা গেছেন ৯ জন এবং চলতি বছরে আগস্ট পর্যন্ত বজ্রপাতে প্রাণ গেছে ১০ জনের।

Advertisement

এদিকে ২০১৭ সালে নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়, সারা বিশ্ব ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কঙ্গোর কিনমারা ডেমকেপ এলাকায়, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে এবং জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভেনেজুয়েলার মারাকাইবো লেক এলাকায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত আঘাত হানে। সুনামগঞ্জে মার্চ থেকে মে এ তিন মাসে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২৫টিরও বেশি বজ্রপাত আঘাত হানে। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে দেশের পূর্বাঞ্চলে বজ্রপাতের পরিমাণ প্রাকৃতিকভাবেই বেশি। ভারতের খাসি পাহাড় ও মেঘালয় এলাকায় মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত মেঘ জমে থাকে। স্তরীভূত মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে ওই এলাকার পাদদেশে অবস্থিত সুনামগঞ্জ জেলায় বজ্রপাতের সংখ্যাও বেশি হয়ে থাকে।

২০১৮ সালে সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল শাল্লা উপজেলায় হাওরে ধান কাটতে গিয়ে প্রাণ হারান জয় সেন দাস। পরিবারের একমাত্র আয় করা ব্যক্তি ছিলেন তিনি। প্রথমদিকে কাপড়ের ব্যবসা করলেও সেই ব্যবসায় লাভের চেয়ে বাকি বেশি হয়ে যাওয়ায় দুঃখে ব্যবসা ছেড়ে চলে যান কৃষি কাজ করতে। সেখানে মহাজনের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে ধান চাষ করতেন তিনি। কিন্তু ২০১৮ সালে উপজেলার ছায়ার হাওরে ধান কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে প্রাণ হারান তিনি।

জয় সেনের বাবা নিখিল চন্দ্র দাস একই বছর উনার মা, ছেলে ও এক আত্মীয়কে হারিয়ে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। এখন কোনো কিছু মনে রাখতে পারেন না। ছেলের কথা মনে হলে মাঝে মধ্যে কেঁদে ফেলেন। জয় সেনের ঘরে আছে দুই সন্তান। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত জয় সেন দাসের স্ত্রী সুমি রাণী দাস।

জয় সেন দাসের ছোট ভাই অজয় সেন দাস বলেন, দাদা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা কোনো কিছু মনে রাখতে পারেন না। একটি বছরেই বাবা অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছেন। দাদা মারা যাওয়ার পর সরকার থেকে আমাদের ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়। এখন আমি হাটে-ঘাটে কাজ করে যা পাই তা দিয়া সংসার চালাই। দাদার ঘরে দুই সন্তান আছে, তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। আমরা কীভাবে কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। সরকার থেকে আমাদের ঋণ বা বড় অঙ্কের আর্থিক অনুদান দিলে ব্যবসা করবো। সেই ব্যবসা দিয়েই আশা করি পরিবারকে চালাতে পারবো।

Advertisement

জামালগঞ্জ উপজেলা সদর ইউয়িনের দক্ষিণ কামলাবাজ গ্রামের শান্তনা বেগম। ২০১৯ সালে বজ্রপাতে একমাত্র ছেলে অন্তর রহমান (৬) ও স্বামী সাবিবুর রহমানকে হারিয়েছেন তিনি। ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে বজ্রপাতের আঘাতে মৃত্যু হয় তাদের।

শান্তনা বেগমের স্বামী কৃষি কাজ করতেন। তাদের সংসার অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে চলছিল। স্বামী ও ছেলে মারা যাওয়ায় ঘরে খাবার আনার মানুষ নেই, নেই কোনো আয়ের মানুষও। শান্তনা বেগমের তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে একমাত্র ছেলেকে তিনি হারিয়েছেন। বর্তমানে তার দুই মেয়েই ভরসা। তাদের পড়াশুনা ও নিজের ভাঙ্গা ঘরের মেরামতের জন্য সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন শান্তনা বেগম।

স্বামী ও ছেলে হারানো শান্তনা বেগম বলেন, আমার একমাত্র ছেলেটারে স্কুল থকি বাড়ি আনার সময় সে আর তার বাবা বজ্রপাতে মারা যায়। সরকার থকি আমরারে ৪০ হাজার টাকা দিলেও সেই টাকা ঋণ পরিশোধ ও মেয়ের পড়াশুনায় চলে গেছে। এখন আমার ঘরটিও যেকোনো দিন ভেঙে যাবে। বর্তমানে বাপের বাড়ি থেকে খাবার আসে, তাই দিয়ে আমরা চলি। আমি সরকারের কাছে আমার ভাঙা ঘরটা মেরামত ও আমার মেয়েগুলা যেন পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারে সেজন্য সহযোগিতা চাই।

এদিকে বজ্রপাত প্রাণহানি কমাতে হাওরে তালগাছ না লাগিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বজ্র নিরোধক যন্ত্র লাগানো, বজ্রপাতে মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিবারকে মোটা অংকের অনুদান প্রদান এবং হাওরের কৃষক ও মৎস্যজীবীদের মধ্যে বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকার জন্য সচেতনতামূলক প্রচারণা জোরদার করার দাবি জানান হাওর উন্নয়নে সংশ্লিষ্টরা।

হাওর এরিয়া আপলিফটমেন্ট সোসাইটির (হাউস) নির্বাহী পরিচালক সালেহীন চৌধুরী শুভ বলেন, সুনামগঞ্জ সবচেয়ে বজ্রপাত প্রবণ এলাকা। সেই এলাকায় বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ লাগানোর পরিকল্পনা ভুল। সুনামগঞ্জে প্রতিবছর বজ্রপাতে কৃষক-মৎসজীবীরা প্রাণ হারান। তাই সরকারকে সুনামগঞ্জ জেলার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে হাওর ও খোলা জায়গায় অতি দ্রুত বজ্র নিরোধক যন্ত্র লাগাতে হবে। এছাড়াও মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিবারকে বড় অংকের আর্থিক অনুদানসহ হাওর এলাকার মানুষদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল আহাদ বলেন, সুনামগঞ্জের হাওরে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য কয়েকদিন আগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন সুনামগঞ্জের প্রতিটি হাওরে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বজ্র নিরোধক যন্ত্র লাগানো হবে। সেখানে যারা কাজে যাবেন তারা আশ্রয় নিতে পারেন এমন আশ্রয়কেন্দ্রও তৈরি করা হবে।

তিনি আরও বলেন, বজ্রপাতে মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিবারকে এক লাখ টাকা অনুদান দেয়ার জন্য একটি তালিকা প্রেরণ করা হয়েছে। সেই টাকা দিয়ে বজ্রপাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

আরএআর/জেআইএম