শেখ সাইফুল্লাহ রুমী
Advertisement
লোকগান বা লোকসাহিত্য বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। যদিও লোকগানের সৃষ্টি গ্রামীণ জনপদের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষের হাত ধরে। বাংলা লোকগান বাঙালির নিজস্ব সৃষ্টি। এই সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙালি তার আবেগ-ভালোবাসা, অনুভূতি, চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছে।
লোকগানের অনেক শাখা, উপ-শাখা রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় বাউল গান। বাউল গান পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। ইউনেস্কো ২০০৫ সালে বাউল গানকে বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে।
বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছেন অনেক বাউল গানের স্রষ্টা। তার মধ্যে লালন ফকির অন্যতম এবং সর্বাধিক সমাদৃত। লালনের গানে অসাম্প্রদায়িকতার ছাপ থাকায় বিশ্বের সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য। যে ক’জন শিল্পী বিশ্ব দরবারে লালনের বাণী প্রচার করে বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন শফি মণ্ডল তাদের মধ্যে অন্যতম। একজন শফি মণ্ডল সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য জনপ্রিয় শিল্পী, সুর করেছেন লালন ফকিরের অসংখ্য গান।
Advertisement
অনেকের ধারণা, লালন ফকির তো তার সব গানের সুর করে গেছেন, বিষয়টি মোটেও সত্য নয়। ফোক ফিউশন করে লালনের বেশ কিছু গান বর্তমান সময় উপযোগী করে তরুণ প্রজন্মের কাছে লালন ফকিরকে তুলে ধরেছেন শফি মণ্ডল। এ কারণে তাকে হতে হয়েছে আলোচিত ও সমালোচিত।
সংগীতকে আমরা গুরুমুখী বিদ্যা বলি। সাধক-গুরু শফি মণ্ডলও যৌবনে গিয়েছেন গুরুর কাছে, প্রথম তালিম নেন মামাতো ভাই সবদার হোসেনের কাছে। দীক্ষা নিয়েছেন বাউল গানের উপর। ১৯৭৯ সালে ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতের ওপর তালিম নেন ভারতের শ্রী সাধন মুখার্জির কাছে। যদিও এসব সহজ ছিল না ১৩ ডিসেম্বর ১৯৫২ সালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ফিলিপনগরে জন্ম নেওয়া শফি মণ্ডলের জন্য।
শফি মণ্ডলের বাবা ছিলেন মসজিদের ইমাম। অনেকবারই পড়তে হয়েছে ধর্মীয় গোঁড়ামির মুখোমুখি। পরবর্তীতে যদিও পরিবারের লোকজনের সমর্থন পেয়েছেন। ১৯৯৫ সালে প্রথম একক অ্যালবাম প্রকাশ পায়। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে ‘লালনের দেশে’ শিরোনামে লালনগীতির অ্যালবাম দিয়ে বেশ আলোচনায় চলে আসেন।
ঢাকা ও কুষ্টিয়ায় তৈরি করেছেন বাউল সংগীতের ওপর নিজস্ব আশ্রম। আশ্রমে দেওয়া হয় নতুন প্রজন্মকে বাউল গানের দীক্ষা। শেখানো হয় অসাম্প্রদায়িক বিষয়ের নানা দিক। লালনের গানের বাইরেও শফি মণ্ডল গেয়েছেন অসংখ্য মৌলিক গান। তার মধ্যে- ‘মন মন্দিরে পূজা দেবো পড়বো নামাজ দিল কাবায়’, ‘জন্মসূত্রে মানুষ আমি আমার নাই অন্য পরিচয়’, ‘মানুষ নামের মানুষ আমি আসল মানুষ হইলাম না’ ইত্যাদি।
Advertisement
একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়- শফি মণ্ডল বর্তমান প্রজন্মের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। অনেকেই তাকে ভালোবেসে বাবা বলে ডাকেন। পিতৃ দৃষ্টিতে দেখেন। আমরা জানি যে, বিনয় মানুষকে মহান করে তোলে। শফি মণ্ডল এতটাই বিনয়ী একজন মানুষ, যা আগামী প্রজন্মের কাছে একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
লেখক: কবি, গীতিকার ও সুরকার।
এসইউ/এলএ/পিআর