মতামত

রিপোর্টারের চোখে দেখা ভয়াল গ্রেনেড হামলা

রফিকুল ইসলাম সবুজ

Advertisement

২০০৪ সাল। তখন আমি দৈনিক সংবাদের রিপোর্টার। সংসদ বিটের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ বিটে কাজ করি। আওয়ামী লীগ বিটের মূল দায়িত্ব ছিল সালাম জুবায়ের ভাইয়ের। একুশে আগস্ট শনিবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউর দলীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের সমাবেশের এ্যাসাইনমেন্ট ছিল সালাম জুবায়ের ভাই এবং আমার। আগের দিন রাতেই অফিসে বসে সিদ্ধান্ত হয় সালাম ভাই বিরোধী দলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা লিখবেন এবং আমি জিল্লুর রহমান ও জলিল ভাই (আবদুল জলিল)সহ সিনিয়র নেতাদের বক্তৃতার পাশাপাশি কোন সাইড স্টোরি থাকলে তা করব।

সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা, এবং দলীয় নেতা-কর্মী হত্যা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ এই সমাবেশ ও গণমিছিল ডেকেছিল। আমি বিকেল তিনটার দিকেই চলে যাই বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে। সালাম ভাই এর কিছুক্ষণ পরে আসেন। সমাবেশ শুরু হয় বেলা সাড়ে ৩টার দিকে। সমাবেশ শুরু হওয়ার পর জনকন্ঠের উত্তম দা, প্রথম আলোর জাহাঙ্গীর ভাই, ভোরের কাগজের সুমন মাহবুব (ভোরের কাগজেও আমি আওয়ামী লীগ বিটে সুমনের সহযোগী হিসেবে কাজ করতাম), চ্যানেল আই এর খোকন (আশরাফুল আলম খোকন), মানবজমিনের মশিউর রহমান খানসহ আমরা রিপোর্টাররা আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে রমনা ভবনের সিঁড়ির ওপর বসে নেতাদের বক্তৃতা শুনি এবং নোট করি। পরে যুগান্তরের শাহেদ ভাই (শাহেদ চৌধুরী) ও বাসস এর বাদল দা আসেন। আর এনটিভির মিল্কি ভাই ও ক্যামেরাম্যান রমনা ভবনের দোতলার বারান্দায় থেকে সমাবেশের ছবি নিচ্ছিলেন। নেত্রীর বক্তৃতা শুরু হলে চ্যানেল আইয়ের খোকন ট্রাকের ওপর বানানো মঞ্চের সামনে ক্যামেরাম্যানের কাছে চলে যান।

সিনিয়র নেতাদের বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর নেত্রী বক্তৃতা শুরু করলে আমার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। তখন সালাম ভাই নেত্রীর বক্তৃতা নোট করতে থাকেন আর আমি রিলাক্সমুডে বসে থাকি। এমন সময় আমার কলেজের এক বন্ধু ফোন করে জানায় সে জিপিও মোড়ে একটা কাজে এসেছে। আমি তাকে রমনা ভবনের সামনে আসতে বললে কিছুক্ষনের মধ্যে সে আসলে পাশে চায়ের দোকানে দুজনে চা খেতে খেতে আড্ডা দিতে থাকি। নেত্রীর বক্তৃতা শেষ হওয়ার পরে গণমিছিল শুরু হলে সালাম ভাইয়ের সঙ্গে অফিসে যাবো। সম্ভবত বিকেল ৫ টা ২১ বা ২২ মিনিটের দিকে নেত্রী তার ভাষন শেষ করবে এমন সময় এক-দেড় মিনিটের ব্যবধানে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। চারদিক ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়।

Advertisement

সবাই এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। এসময় পুলিশ কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ করলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়। আমি তখন অন্যদের সঙ্গে একটি দোকানের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছি। তখন দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে বিরোধীদলীয় নেতাকে সরিয়ে নেওয়া হয়। শেখ হাসিনার গাড়ি বহর যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিলেন তখনো কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে ঘটনাস্থলে বিস্ফোরনের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। একই সঙ্গে চলছিল গুলির শব্দ। এসব গুলি-বিস্ফোরণ ঠিক কোথা থেকে ছোড়া হচ্ছিল তা বোঝা না গেলেও বেশ পরিকল্পিতভাবে যে হামলা হয়েছে তা পরে সবাই বুঝতে পারি। প্রাথমিক ভাবে ধারনা করি বোমা হামলা হয়েছে।

বিস্ফোরণ থামলে আমি এক দৌড়ে পুরানা পল্টনে দৈনিক সংবাদ অফিসে চলে আসি। অফিসে নির্বাহী সম্পাদক বুলবুল ভাইকে (মনজুরুল আহসান বুলবুল) বলি সমাবেশে বোমা হামলা হয়েছে। এসময় বুলবুল ভাই ও চিফ রিপোর্টার সাইফুল আমিন ভাই জানতে চান নেত্রী ঠিক আছেন কিনা? তার কোন সমস্যা হয়নিতো? তখন আমি জানাই নেত্রীর গাড়ি ঘটনাস্থল থেকে বের হয়ে যেতে দেখা গেছে। এসময় বুলবুল ভাই বলেন তুমি অফিসে এসেছো কেন? নিউজ লিখতে হবে না? যাও ঘটনাস্থলে যাও। তখন ফের দৌড়ে ঘটনাস্থলে যাই। জিপিও মোড় পার হয়ে পীর ইয়ামেনী মার্কেটের কাছে গিয়ে দেখি সুরঞ্জিত দাকে (সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত) মটরসাইকেলে করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন ফটোসাংবাদিক মহিউদ্দীন সোহান ভাই। দাদার জামাকাপড় রক্ষেভেজা এবং পেছনে একজন তাকে ধরে রেখেছেন। এছাড়া হাছান মাহমুদ ভাইকে (বর্তমান তথ্যমন্ত্রী) দলের দু’জন মহিলা কর্মি ধরে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য যানবাহন খুজছেন। হাছান ভাইয়ের জামাও রক্তে ভেজা।

জিপিও মোড় থেকে সচিবালয়ে যাওয়ার সড়কে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট রহমত আলীকে রক্তমাখা পাঞ্জাবি গায়ে এক সমর্থকের কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোন বাহন খুঁজছিলেন ঐ কর্মি। এসময় ফটো সাংবাদিক জিয়া ইসলাম ছবি তুলছিলেন। এরকম আহত আরো অনেক নেতা কর্মিকে দলের নেতাকর্মি ও সাধারণ মানুষ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন রিক্সা, ভ্যান বা অ্যাম্বুলেন্সে করে। চ্যানেল আইয়ের আশরাফুল আলম খোকনকে আহত অবস্থায় সহকর্মিরা হাসপাতালে নিয়ে গেছেন বলে জানান উপস্থিত ঘটনাস্থলে থাকা রিপোর্টার ও ফটো সাংবাদিক সহকর্মিরা।

বিস্ফোরণের পর ধোঁয়ার কুণ্ডলী, মানুষের চিৎকার, ছুটোছুটিতে একটি প্রাণবন্ত সমাবেশের চেহারা পাল্টে যায়। একটু থিতু হতেই দেখা যায়, আওয়ামী লীগ কার্যালয় আর রমনা ভবনের সড়কে জায়গায় জায়গায় রক্তের স্রোত। ছেঁড়া স্যান্ডেল, রক্ত, পড়ে থাকা ব্যানার, পতাকার সঙ্গে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে নারী-পুরুষের দেহ-কেউ নিথর-স্তব্ধ, কেউবা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। সন্ধ্যা পৌনে ৬ টার দিকে আমরা সেখানে অবিস্ফোরিত অবস্থায় দুটি গ্রেনেডও দেখতে পাই। তখনই মুলত বুঝতে পারি এটা বোমা হামলা নয় ছিল গ্রেনেড হামলা।

Advertisement

ঐদিনও সমাবেশ শুরুর পর আদা চাচা আমাদের সাংবাদিকদের লবন মেশানো শুকনা আদা খেতে দিয়েছিলেন। গ্রেনেড হামলায় আদা চাচাও নিহত হন। তার লাশও পড়ে ছিল সমাবেশস্থলে। ঐ সময়ে আওয়ামী লীগ বিটের রিপোর্টারদের কাছে আদা চাচা ছিল খুবই পরিচিত। তিনি সাংবাদিকদের সবাইকেই আদা খেতে দিতেন। সব সমাবেশেই তাকে দেখা যেত। তিনি মুলত দলীয় নেতা ও যারা শ্লোগান দিতেন তাদের জন্য বাসা থেকে লবন দিয়ে আদা শুকিয়ে নিয়ে আসতেন। এটি ছিল সামনে থেকে আমার দেখা দ্বিতীয় বোমা হামলার ঘটনা। কারন এর আগে ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারী পল্টন ময়দানে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার সময়ও আমি রিপোর্টার হিসেবে ঘটনাস্থলে ছিলাম।

একুশে আগস্ট অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ঐদিন উপস্থিত নেতা-কর্মিরা মানববর্ম হয়ে তাকে রক্ষা করেছিলেন। দলের নেতা-কর্মি ও দেহরক্ষীরা দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে শেখ হাসিনাকে সেখান থেকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরে আমরা জানতে পারি বিস্ফোরণে মঞ্চ ও সমাবেশে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মিদের কমপক্ষে ১৬ জন ঘটনাস্থলেই নিহত এবং চার শতাধিক আহত হয়েছিলেন। এদের অনেকের অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক।

দলের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল (কয়েক দিন পর হাসপাতালে মারা যান)। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কাজী জাফরউল্লাহ, মোহাম্মদ নাসিম, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাহারা খাতুন, ড. হাছান মাহমুদ, নজরুল ইসলাম বাবুসহ অনেকে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। শেখ হাসিনাকে সরিয়ে নেওয়ার পর ট্রাক থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় নামতে থাকেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। যারা অচেতন হয়ে পড়েছিলেন, তাদের ধরে নামানো হয়। কী ঘটছে কিছুই বুঝতে না পেরে অনেক নেতা-কর্মি এ সময় ছুটে দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে যান। আহতদের মধ্যেও অনেককে ধরে ভেতরে নেওয়া হয়।

অনেককে দেখা যায় পথে রক্তাক্ত অবস্থায় ছুটোছুটি করতে। গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় দলীয় নেতা-কর্মিদের। এ অবস্থায়ই রিকশা, অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট কার, বেবিট্যাক্সি, এমনকি রিকশাভ্যানে করেও আহতদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। উদ্ধার অভিযান চলাকালে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে প্রচণ্ড শব্দে আরেকটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয় পুলিশের উপস্থিতিতেই সিটি ভবনের পাশের গলিতে।

ঐ সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মিদের মনোবল যে অনেক শক্ত ছিল তার প্রমান মেলে কর্মিরা আহতদের উদ্ধার করে বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়ও ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে স্লোগান দিচ্ছিলেন। দুঃখজনক বিষয় হলো আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা আহতদের উদ্ধার তৎপরতা না চালিয়ে দূর থেকেই বিক্ষুব্ধ কর্মীদের লক্ষ্য করে ঘন ঘন টিয়ার গ্যাস ছুড়তে থাকে। এ সময় ছুটোছুটি শুরু হলে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ চালায়। পুলিশের টিয়ার গ্যাস আর লাঠিচার্জ এর কারণে আহতদের হাসপাতালে নিতে বাধার সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি এ সময় কর্তব্যরত সাংবাদিকদেরও তথ্য সংগ্রহে বিঘ্ন ঘটে।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ১৬ বছর পার হয়েছে। কিন্তু সেদিন যাঁরা নিহত হন তাঁদের স্বজনেরা এখনো কষ্ট ও যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছেন। সেদিনের ঘটনা জাতির জীবনে যে বেদনা ও কষ্টের পাহাড় তৈরি করেছিল, তার ক্ষত এখনো শুকায়নি। সেদিন বোমা-গ্রেনেড মেরে মানুষ হত্যা করেছে যে জঙ্গিগোষ্ঠী, এখনো তারা সক্রিয়, ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। গ্রেনেড হামলার পর ক্ষমতাসীন বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এটি আওয়ামী লীগের কাজ। আওয়ামী লীগ জনগণের সহানুভূতি পেতেই নাকি গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে নানা তথ্য-উপাত্ত এবং আক্রমণে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে যে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি) নেতা মুফতি আবদুল হান্নানই এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। তার সঙ্গে তৎকালীন সরকারের লোকজনও জড়িত ছিলেন। কিন্তু সেদিন ক্ষমতাসীন মন্ত্রী-নেতারা আক্রান্ত মানুষের পক্ষে না দাঁড়িয়ে জঙ্গিদের পক্ষ নিয়েছিলেন। যা ছিল জঘন্য। মানবতা ও ন্যায়ের স্বার্থেই ইতিহাসের জঘন্যতম এই হামলা ও হত্যাযজ্ঞের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর হওয়া প্রয়োজন।

লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক সময়ের আলো ও সাবেক নির্বাহী পরিষদ সদস্য, বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন।

এইচআর/পিআর