বিশেষ প্রতিবেদন

ছোট হয়েছে আকাশপথ, ক্ষতির অঙ্ক বড়

>> শাহজালাল বিমানবন্দরের আয় কমেছে ২৬৭ কোটি টাকা>> মার্চ-জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানের ক্ষতি প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা>> ফ্লাইট অপারেশনসহ সব কার্যক্রম বন্ধ রিজেন্ট এয়ারওয়েজের>> প্রতি মাসে ১০০ কোটি টাকার লোকসান গুনছে ইউএস-বাংলা>> মাসে নভোএয়ারের ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার বেশি

Advertisement

করোনাকালে প্রায় তিন মাস বন্ধ ছিল দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ চলাচল। থেমে ছিল না খরচ। উড়োজাহাজ আকাশে ডানা মেলুক আর না মেলুক, এর পেছনে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় মোটা অঙ্কের। এর ওপর লিজে আনা উড়োজাহাজের ভাড়া পরিশোধ, সিভিল এভিয়েশনের অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ, কর্মীদের বেতন, অফিস ভাড়াসহ বিভিন্ন ব্যয় টানতে গিয়ে তছনছ বাংলাদেশের এভিয়েশন খাত।

ঋণ নিয়ে প্রতিষ্ঠান টানছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, পাঁচ মাস ধরে আকাশে উড়ছে না রিজেন্ট, সরকারি নিয়মনীতি মেনে সীমিতভাবে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। লাভ-তো দূরের কথা, ছোট হয়ে এসেছে আকাশপথ; ক্ষতির অঙ্ক বেশ বড়। তিন-চার মাস ধরে প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এভিয়েশন খাতে এর চেয়ে বড় বিপর্যয় আর দেখা যায়নি।

মহামারি করোনার কারণে বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতের সার্বিক অবস্থা এবং বর্তমান ক্ষতি পুষিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে করণীয় নিয়ে এ খাতের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে জাগো নিউজ। তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথমটি।

Advertisement

করোনাকালে বাংলাদেশের এয়ারলাইন্সগুলোর হালচাল

প্রাণঘাতী করোনার কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের এভিয়েশন ব্যবসার ভাটা শুরু হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে। বিভিন্ন দেশের আরোপিত নিয়মনীতির কারণে একের পর এক ফ্লাইট স্থগিত ও বাতিল হয়ে যায়। লোকসানে ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশের অন্যতম বেসরকারি এয়ারলাইন্স রিজেন্ট এয়ারওয়েজ করোনাকালীন আগাম সতর্কতা হিসেবে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ফ্লাইট অপারেশনসহ সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ওই সময় তিন মাস পর অর্থাৎ জুনে ফেরার কথা বলেছিল রিজেন্ট। পরে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। বাংলাদেশের এভিয়েশনের ইতিহাসে ফ্লাইট বন্ধের পর কোনো এয়ারলাইন্সই নতুন করে আর ফিরতে পারেনি। রিজেন্ট পারবে কিনা— জানতে চাইলে এয়ারলাইন্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফেরা নিশ্চিত নয়।’

বছরের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ২০০ কোটি টাকার লোকসান গুনেছে প্রতিষ্ঠানটি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স

করোনার আঘাতে সবচেয়ে বেশি জর্জরিত রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানটি ১৭টি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করতো। বর্তমানে তাদের রুট মাত্র দুটি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চালু আছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হিসাব অনুযায়ী, করোনাকালে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বিমানের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা।

Advertisement

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে বর্তমানে মোট ১৮টি উড়োজাহাজ রয়েছে। বিমান সূত্রে জানা গেছে, করোনা মহামারির মধ্যে আয় না থাকলেও বিমানের প্রতি মাসে ৬২৮ কোটি টাকার ফিক্সড কস্ট (নির্দিষ্ট ব্যয়) আছে। পরিচালন ব্যয় ২০৩ কোটি টাকা, উড়োজাহাজের ঋণের কিস্তি ৬১ কোটি, উড়োজাহাজের লিজ ভাড়া ৯৮ কোটি এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ২৬৬ কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ফ্লাইট বন্ধের কারণে তারা এসব ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে।

এছাড়া লোকসানের খাতায় নাম লেখানোর অন্যতম কারণ হচ্ছে, হজযাত্রী পরিবহন করতে না পারা। এবার হজযাত্রী পরিবহন করে প্রায় ৯৪৭ কোটি টাকা আয় করতো বিমান। তবে সেখানেও বাগড়া বসিয়েছে মহামারি করোনাভাইরাস।

শিডিউলড ফ্লাইট বন্ধ থাকায় মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করছে বিমান, করছে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংও। এগুলো পরিচালনা না করলে বিমানের ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তো। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সরকারের প্রণোদনা হিসাবে ব্যাংক থেকে এক হাজার কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করিয়েছে বিমান। কর্মীদের বেতন কমানো হয়েছে ১০ থেকে ৫০ শতাংশ। বন্ধ করা হয়েছে কর্মীদের সব ধরনের ভাতা। এরপরও টিকতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। বর্তমানে আন্তর্জাতিক রুটে দুবাই, আবুধাবি, যুক্তরাজ্যের লন্ডন, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর এবং সীমিতভাবে অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইট পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে করোনাকালে ফ্লাইট বন্ধের কয়েক মাসে নভোএয়ারের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি— এমনটি জানিয়েছে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। অভ্যন্তরীণ সবকটি রুটে ফ্লাইট চালু আছে তাদের। ভারতের সিভিল এভিয়েশনের নিষেধাজ্ঞার কারণে বন্ধ আছে সে দেশের ফ্লাইট।

অন্যদিকে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত প্রতি মাসে ১০০ কোটি টাকার লোকসান গুনেছে ইউএস-বাংলা। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সব রুটসহ চীনের গুয়াঞ্জু ও কুয়ালালামপুর রুটে ফ্লাইট চালু আছে এয়ারলাইন্সটির। করোনায় এভিয়েশন খাতের সার্বিক ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর কাছে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পখাতের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছেন, এয়ারলাইন্সগুলো চাইলে এখান থেকে সহায়তা নিতে পারে। এছাড়া কোভিড-১৯ এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এভিয়েশন খাতকে চাঙা করতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সব ধরনের নীতিগত সহায়তা প্রদান করছে। ভবিষ্যতেও প্রয়োজনীয় সহায়তা অব্যাহত থাকবে। নভোএয়ারের সিনিয়র ম্যানেজার (মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস) এ কে এম মাহফুজুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এই খাতের অবস্থা সবারই জানা। প্যাসেঞ্জার ফ্লাইট চলাচল বন্ধ ছিল প্রায় তিন মাস। এরপরও এখন পর্যন্ত সরকার বা কারও কাছ থেকে কিছুই পাইনি। নিজস্ব সোর্স থেকে সার্ভাইভের (টিকে থাকা) চেষ্টা করছি। আমরা বারবার চার্জ মওকুফের দাবি করলেও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বিলের ইনভয়েস পাঠাচ্ছে। আমাদের বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এ খাত আরও হুমকির মুখে পড়বে।’ উদ্বিগ্ন এয়ারলাইন্স, উদ্বিগ্ন বেবিচক; সিদ্ধান্ত ঝুলছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে

চলতি বছরের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশের এভিয়েশন খাতকে টিকিয়ে রাখতে বৈঠকে মিলিত হয় বেবিচক এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। বৈঠকে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০০ ভাগ অ্যারোনটিক্যাল চার্জ মওকুফ এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের ক্ষেত্রে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫০ শতাংশ চার্জ মওকুফের প্রস্তাব গৃহীত হয়। এমন আরও বেশ কয়েকটি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পেশ করা হয়। গত বৃহস্পতিবার (২০ আগস্ট) পর্যন্ত সেই প্রস্তাবের বিষয়ে কিছুই জানায়নি অর্থ মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) সাধারণ সম্পাদক ও নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মফিজুর রহমান বলেন, ‘বেবিচক বিভিন্ন চার্জ নির্ধারণ করে আর অর্থ মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন করে। অন্যান্য দেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এয়ারলাইন্স সংস্থাগুলোর পক্ষে অতিরিক্ত চার্জের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দরকষাকষি করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বেবিচকের চার্জ বাড়ানোর প্রস্তাবনা অর্থ মন্ত্রণালয় সহজেই অনুমোদন দেয়, কিন্তু চার্জ কমানোর বিষয়ে উদ্যোগ নিলে তখন তা আর বাস্তবায়ন হয় না।’ এ প্রসঙ্গে বেবিচক চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এয়ারলাইন্সগুলোর কিছু অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ মওকুফের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। এভিয়েশন খাতকে টিকিয়ে রাখতে সরকার তাদের প্রণোদনা দেবে। সরকার সরাসরি প্রণোদনা না দিয়ে বেবিচককে অথরাইজ করবে। সেক্ষেত্রে বেবিচক নিজের রাজস্ব হারাবে। যদি আমরা এয়ারলাইন্সগুলোকে টাকা ছাড় দেই, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সমপরিমাণ অর্থের জোগান দিতে হবে, আমাদেরও ট্যাক্সছাড়সহ নানা সুবিধা দিতে হবে।’ তিনি বলেন, বেবিচকের বার্ষিক রাজস্ব আসে ১৫০০ কোটি টাকার বেশি। এই টাকা আবার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় হচ্ছে। যদি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ছয় মাসের জন্য ৫০ শতাংশ চার্জ মওকুফ করা হয় তবে আমরা ৫০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাব। আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের ক্ষেত্রে ছয় মাসের জন্য ৫০ শতাংশ চার্জ মওকুফ করা হলে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাতে হবে।

‘বেবিচকেরও নিজস্ব খরচ আছে, সেগুলো চালাতে হয়। আমাদেরও টাকার প্রয়োজন। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই অর্থ মন্ত্রণালয়কে কিছু প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আজ পর্যন্ত (১৬ আগস্ট) অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আপডেট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি’— বলেন বেবিচক চেয়ারম্যান।

শাহজালালের আয় কমেছে ২৬৭ কোটি টাকা

পৃথিবীর যেকোনো দেশের বিমানবন্দরই মোটা অঙ্কের অর্থ আয় করে। বিমানবন্দরের ভেতরের টার্মিনাল ব্যবহারের ফি, ব্যাগেজ বেল্টের ফি, কার পার্কিং, বিমানবন্দরের ভেতরের দোকান ও রেস্টুরেন্টের ভাড়া, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনের বোর্ডসহ আরও কয়েকটি খাত থেকে আয় আসে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেও এসব খাত থেকে অর্থ আসে। তবে করোনার প্রভাবে গত ছয় মাসে ২৬৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকার আয় কমেছে দেশের সবচেয়ে বড় এই বিমানবন্দর থেকে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তৌহিদ-উল-আহসান জাগো নিউজকে জানান, ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে বিমানবন্দর থেকে আয় হয়েছিল ৭৩২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার মতো। ২০২০ সালের একই সময়ে আয় কমে দাঁড়িয়েছে ৪৬৫ কোটি ১০ লাখ টাকায়। করোনার প্রভাবে দীর্ঘদিন বিমানবন্দরে প্যাসেঞ্জার ফ্লাইট বন্ধ এবং ফ্লাইট ওঠা-নামা আগের চেয়ে কমে যাওয়ায় আয় কমেছে। এআর/এমএআর/এমকেএইচ