দেশজুড়ে

সমলের একটি হাত!

বাবার দেখানো পথে সততার সঙ্গেই পথ চলছিলেন ২০ বছরের তরুণ সমল ধর। স্বপ্ন ছিল বাবার মতো একজন দক্ষ স্বর্ণের কারিগর হবেন। এজন্য কারখানার অন্য সবার চেয়ে একটু বেশিই মনোযোগী এবং দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতেন তিনি। এতে করে ধীরে ধীরে তার কাজের দক্ষতা বাড়তে থাকে। তার কাজে খুশি হতে শুরু করে মালিকপক্ষও।

Advertisement

মালিকের আস্থাভাজনও হয়ে ওঠেন তিনি। এসব দেখে অনেকেই সামনাসামনি তাকে মূল্যায়ন করা শুরু করলেও মেনে নিতে পারেননি তার কিছু সহকর্মী। এক সময় তারা জোট বেঁধে মাঝে মাঝেই সমলের কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে শুরু করেন। টার্গেট ছিল মালিকের কাছে যেকোনোভাবে সমলকে খাটো করা। অবশেষে তারা সফলও হন।

ঘটনাটি ২০০৪ সালের। অন্যসব দিনের মতোই একদিন কারখানায় এসে সমল জানতে পারলেন সামান্য স্বর্ণ চুরি হয়েছে। অভিযোগ তার বিরুদ্ধেই। ছুটে গেলেন মালিকপক্ষের কাছে। কিন্তু তার আগেই মালিকের কান ভারী করে ফেলেন তারই কিছু সহকর্মী। অনেক বোঝানোর পরও সমল সেদিন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করতে পারেননি। বরং চোরের অপবাদ নিয়ে সহ্য করতে হয়েছে মালিকের বেধড়ক মারধর। সেদিন নিজেকে বারবার সান্ত্বনা দিয়ে মারধরের বিষয়টি ভুললেও ভুলতে পারছিলেন না চোর অপবাদটা।

দীর্ঘদিন একই পেশায় বাবা সন্তোষ চপল কাজ করলেও সামান্যতম বদনাম তাকে ছুঁতে পারেনি। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের রামপুর বণিকপাড়ায় তারা পরিবার নিয়ে বেশ সুনামের সঙ্গে বসবাস করতেন। কিন্তু সমলের চুরির ঘটনায় তারা লজ্জায় পড়ে যান। তার কারণে কথা শুনতে হতো পরিবারের লোকজনকেও। এসব সহ্য করতে না পেরে ঘটনার পরদিনই সমল বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে।

Advertisement

হাঁটতে হাঁটতে চলে যান চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকার রেলস্টেশনে। সিদ্ধান্ত নেন আত্মহত্যার। সঙ্গে সঙ্গে কাঠের স্লিপারে শরীর রেখে লাইনের একপ্রান্তে মাথা, অন্যপ্রান্তে পা দিয়ে শুয়ে পড়েন লাইনের ওপর। কপালে হাত রেখে ভাবতে থাকেন চুরির সেই অপবাদের কথা।

এভাবে ১৫ মিনিট শুয়ে থাকার পর কানে ভেসে আসে ট্রেনের হর্ন। একবার স্টেশন থেকে উঠে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলেও আটকে দেয় সেদিনের চুরির অপবাদের নির্যাতন ও একেকটি বদনাম। এসব চিন্তা করতে করতে হঠাৎ করে লাইন থেকে মাথাটা নেমে আসে নিচের অংশে। পা দুটি ও ও ডান হাত থেকে যায় লাইনের ওপর। মুহূর্তেই ট্রেনের চাকায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ডান পা ও হাত। ভেঙে যায় বাম পা। ট্রেন চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ পর স্টেশনের ধার দিয়ে যাওয়া মানুষজন রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করে সমলকে।

হাসপাতালে নেয়ার পর বাম পা-ও কাটা পড়ে সমলের। তার সম্বল এখন শুধুই বাম হাত। এ ঘটনার পর পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে পড়েন সমল। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে মেঝো সমল হয়ে যায় পরিবারের বোঝা।

কিছুদিন বাড়িতে বসা থাকলেও এক হাত নিয়ে আবারও সংগ্রামে নামেন সমল। বাড়ির পাশে ছোট একটি দোকান নিয়ে মোবাইল রিচার্জ ও বিড়ি-সিগারেট বিক্রি করা শুরু করেন তিনি।

Advertisement

এর মাঝে ২০১০ সালে আত্মীয়দের মধ্যে একজনকে সমঝোতার মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বর্তমানে তার ৯ বছর বয়সী এক ছেলে ও ছোট ছোট দুটি মেয়ে রয়েছে।

সংসার শুরুর কিছুদিনের মধ্যে তার দোকানটি বন্ধ হয়ে যায়। এলাকার লোকজন বাকিতে কেনাকাটা করলেও ঠিকমতো টাকা দিতো না তাকে। শারীরিক অক্ষমতার কারণে তিনিও টাকা তুলতে যেতে পারছিলেন না কারও কাছে। এভাবে কেটে যায় আরও কিছুদিন।

পড়ালেখায় প্রাইমারির গণ্ডি পার না হলেও সমলের সঙ্গে কথা বলে বোঝার উপায় নেই যে, তিনি উচ্চ শিক্ষিত নন। দুই বছর আগে বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানকে রেখে প্রতিবন্ধী কোটায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি ওষুধ কারখানায় ১১ মাস চাকরি করেন।

এক বছর আগে কোনো এক মাধ্যমে সমল দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী সাইফুজ্জামান শিখরের সঙ্গে। আবদার করেন একটি চার্জার হুইল চেয়ারের। সাইফুজ্জামান শিখর সমলের সেই চাওয়া পূরণ করেন চট্টগ্রাম-১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভীর মাধ্যমে। দেয়া হয় তাকে একটি চার্জার হুইল চেয়ার।

কিন্তু সেই চেয়ারও বেশিদিন চালাতে পারেননি সমল। তিন মাসের মাথায় অকেজো হয়ে পড়ে সেটি। বার বার মেরামত করারও টাকা ছিল না তার। তবে ওই চেয়ার থাকার ফলে এলাকায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করতেন সমল। কিন্তু সেটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আবারও বন্ধ হয়ে যায় তার ব্যবসা। শুরু হয় অভাব।

স্ত্রী-সন্তানদের এলাকায় রেখে তিন মাস আগে ঢাকায় চলে আসেন সমল ধর। সঙ্গে নিয়ে আসেন স্ত্রীর শেষ সম্বল গহনা। সেগুলো বিক্রি করে আবারও একটি চার্জার হুইল চেয়ার কিনেছেন সমল।

চেয়ারটিকে গড়ে তুলেছেন সুসজ্জিত একটি দোকানের মতো। পণ্যে ভরপুর। সেটিতে বসে রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় ভ্রাম্যমাণ দোকানদারি করেন তিনি। থাকেন শ্যামলীর ২ নম্বরে রোডের ১২ নম্বর ভবনে। এক রুম নিয়ে সেখানে থাকলেও দিনে ১০০ টাকা দিয়ে দুই বেলা খান আরেকজনের সঙ্গে।

শুক্রবার দুপুরে সমলের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয় শ্যামলী শিশু মেলা এলাকায়। এসময় তার ব্যতিক্রম এ দোকান কয়েকজন পথচারী বেশ আগ্রহ ভরে দেখছিলেন।

সমল জাগো নিউজকে বলেন, সেদিনের সেই অপবাদ আজও ভুলতে পারি না। এখনও মনে পড়লে কান্না আসে। মরে গেলেই বুঝি সব শেষ হয়ে যেত, বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

তিনি বলেন, এভাবে চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত হেরে যাচ্ছি। তারপরও টিকে থাকার চেষ্টা করছি। এখন দৈনিক এ দোকানে হাজার টাকা বিক্রি হলে সাড়ে ৩শ থেকে ৪শ টাকার মতো লাভ হয়। তবে বৃষ্টির দিন বের হতে পারি না। মাস শেষে বাসা ভাড়া ও খাওয়া দাওয়া শেষে যা টিকে তা বাড়িতে স্ত্রী সন্তানদের জন্য পাঠাই। বড় সন্তান স্কুলে যায়, মেয়ে দুইটা ছোট। কিন্তু আজ পর্যন্ত বাবা হিসেবে তাদের আবদার পূরণ করতে পারিনি।

তিনি আরও বলেন, ঢাকায় এসেছি তিন মাস হলো। এর মাঝে দেড় মাস আগে বাসা থেকে মালামাল কেনার টাকাসহ ঘরের আসবাবপত্র চুরি হয়ে গেছে। এ ঘটনায় থানায় জিডি করায় বাড়ির মালিক আমার ওপর ক্ষেপে গেছে। সম্ভবও তিনি আমাকে আর বাসায় রাখবেন না।

সমল বলেন, এ শহরে কাউকে চিনি না। কারও কাছে টাকা ধার নেয়ারও সুযোগ নেই। খুব কষ্ট করে চলছি।

তিনি বলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে খাব। আমার সন্তানদের যেন কেউ না বলতে পারে তোর বাবা ভিক্ষা করে। প্রয়োজনে একবেলা কম খাব, মোটা কাপড় পড়বো তবুও আমার অবস্থান থেকে কখনও নিচে নামবো না। আমার জন্য শুধু দোয়া করবেন।সমলের সঙ্গে কথা বলা যাবে 01822-935824 নম্বরে

এমএএস/এমএস