দেশজুড়ে

বিয়ে বাড়ির ভিডিওগ্রাফার এখন রাস্তায় কাঁঠাল বিক্রি করেন

১১ বছর ধরে ভিডিওগ্রাফির কাজ করছেন নীরাঞ্জন রায়। ক্যামেরার শৈল্পিক ও নান্দনিকতা দিয়ে অসংখ্য মানুষের মন রাঙিয়েছেন তিনি। কিন্তু অদৃশ্য এক ভাইরাসের থাবায় তার জীবনের রঙই আজ ফিকে হয়ে গেছে। অনেক সাধের ক্যামেরা ছেড়ে জীবিকার তাগিদে কোমরে গামছা বেঁধে এখন ফুটপাতে নেমেছেন এই ভিডিওগ্রাফার। পরিবারের সাত সদস্যের পেট চালাতে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মৌসুমি ফল বিক্রি করছেন নীরাঞ্জন। এ কাজে কোনো লজ্জা নেই তার কিন্তু আগের সেই জৌলুসের কথা ভেবে তার মন ডুকরে কাঁদে।

Advertisement

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরশহরের কান্দিপাড়া মহল্লার নীরাঞ্জন রায়ের মতো এমন করুণ দিনাতিপাত করছেন ফটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফি ও ভিডিও এডিটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত সবাই। টানা চার মাসেরও বেশি সময় ধরে তাদের কারো হাতেই কোনো কাজ নেই। ফলে বাধ্য হয়ে সংসার চালাতে কেউ বিক্রি করছেন ফল, কেউ চালাচ্ছেন অটোরিকশা আবার কেউবা করছেন দিনমজুরি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রফেশনাল ফটো ও ভিডিওগ্রাফি অ্যাসোসিয়েশনের দেয়া তথ্যমতে, জেলার ৯টি উপজেলায় দেড় হাজারেরও বেশি ফটোগ্রাফার, ভিডিওগ্রাফার ও ভিডিও এডিটর রয়েছেন। মূলত ক্যামেরাই তাদের জীবন ও জীবিকার একমাত্র উৎস। বিয়ে, বৌভাত ও জন্মদিনসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান এবং রাজনৈতিক সভা-সেমিনারে ছবি ও ভিডিওচিত্র ধারণ করেই সংসার চলে তাদের। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে সব ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠান বন্ধ হতে থাকায় কর্মহীন হয়ে এখন অলস সময় কাটছে তাদের।

দীর্ঘদিন ধরে কাজ না থাকায় দোকান ভাড়া দিতে না পেরে ভিডিওগ্রাফির ব্যবসা ছেড়ে অনেকেই এখন পেশা বদলের পথে হাঁটছেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর প্রথম দিকে সরকারিভাবে কিছু ত্রাণসহায়তা পেলেও এখন আর কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা।

Advertisement

অনেকেই জমানো টাকা দিয়ে কিছুদিন সংসার চালিয়েছেন। আবার অনেকেই পেট চালাতে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছেন বেসরকারি সংস্থা থেকে। কিন্তু সেই ঋণের কিস্তি দিতে গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাদের। বাধ্য হয়ে অনেকেই এখন রাস্তায় নেমেছেন জীবিকার সন্ধানে।

ভিডিওগ্রাফার নীরাঞ্জন রায় জানান, ভিডিওগ্রাফির পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সাজসজ্জার কাজও করেন তিনি। এ কাজ করে মাসে ২০ হাজারের বেশি টাকা আয় হয় তার, যা দিয়ে সাত সদস্যের পরিবার নিয়ে ভালোভাবেই চলত। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ায় এখন মানবেতর দিন কাটছে তার। বাধ্য হয়ে ভ্যানগাড়ি নিয়ে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কাঁঠাল বিক্রি করছেন তিনি।

অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে নীরাঞ্জন বলেন, বিয়ে বাড়িতে সবাই ক্যামেরাম্যানকে আলাদা সম্মান দিত। ভালো টাকা আয় করতাম। পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটাতে পারতাম। কিন্তু সবকিছু শেষ করে দিয়েছে করোনাভাইরাস। আমার পুরো পরিবার আমার ওপর নির্ভরশীল। সেজন্য বাধ্য হয়ে জীবিকার তাগিদে এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কাঁঠাল বিক্রি করছি।

শেখ মো. শাহীন নামে এক ভিডিও এডিটর জানান, প্রায় দুই দশক ধরে তিনি ভিডিওগ্রাফি ও ভিডিও এডিটিংয়ের কাজ করছেন। এ কাজ করে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হতো তার। কিন্তু চার মাস ধরে কোনো আয় নেই। অথচ খরচ আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। চার মাস ধরে বাসা ভাড়াও দিতে পারছেন না। বাড়িওয়ালা প্রতিনিয়ত ভাড়া পরিশোধ করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। কাজ না থাকায় এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে এখন সংসার চালাচ্ছেন।

Advertisement

রঞ্জন ধাম নামে আরেক ভিডিও এডিটর জানান, তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছোট চাকরি করেন। সেজন্য বাড়িতে বসে ভিডিও এডিটিংয়ের কাজ করতেন। এতে করে মাসে ১০-১২ হাজার টাকা আয় হতো তার। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে কাজ না থাকায় এখন ছোট চাকরির আয়ে পরিবার নিয়ে চলতে কষ্ট হচ্ছে তার।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের আশিক প্লাজার মৌরি ভিডিও হাউজের স্বত্বাধিকারী আকবর হোসেন চুন্নু আক্ষেপ করে বলেন, আমার দোকানে চারজন ক্যামেরাম্যান আর তিনজন ভিডিও এডিটর কাজ করতো। কাজ নেই তাই সবাইকে বিদায় করে দিয়েছি। এখন আমার নিজেরই চলতে কষ্ট হচ্ছে, তাদের কীভাবে চালাব? কয়েক মাস ধরে দোকান ভাড়া দিতে পারছি না। ধীরে ধীরে হয়তো সবকিছু স্বাভাবিক হবে, কিন্তু আমরা আগের অবস্থায় ফিরতে পারব না। কারণ করোনাভাইরাস আমাদের জীবিকার সঙ্গে পুঁজিও কেড়ে নিয়েছে। আবার ঘুড়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের সুদমুক্ত ব্যাংক ঋণ দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রফেশনাল ফটো ও ভিডিওগ্রাফি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, কাজ না থাকায় আমার ভিডিওগ্রাফির দোকানটিতে এখন স্টেশনারি পণ্য তুলেছি। আমাদের সব ফটোগ্রাফার, ভিডিওগ্রাফার ও ভিডিও এডিটর কর্ম হারিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। প্রথম দিকে আমরা সরকারি কিছু ত্রাণ সহায়তা পেয়েছি। কিন্তু এখন পরিবার নিয়ে চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাদের পরিবার নিয়ে চলার পাশাপাশি আবার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ব্যাংক থেকে সুদমুক্ত ঋণ দেয়া হোক।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যাংকার্স ফোরামের সভাপতি ও সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রধান শাখার ব্যবস্থাপক ইকবাল হোসেন ভূঁইয়া বলেন, করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা ব্যবসার ধরন অনুযায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন। আমরা ৯ শতাংশ সুদ হারেই ঋণ দেব। সেক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা ৪ শতাংশ আর ৫ শতাংশ সুদ সরকার আমাদের পরিশোধ করবে। কিন্তু সুদমুক্ত ঋণ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এফএ/পিআর