বিনোদন

জহির রায়হানের ৮৫তম জন্মদিন আজ

জহির রায়হান। একাধারে একজন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা। আরও অনেক গুণের পরিচয় তার। তবে সবকিছু ছাপিয়ে চলচ্চিত্রকার পরিচয়টি সবচেয়ে বড় আর উজ্জ্বল। এই পরিচয়ে তিনি ছিলেন পূর্ণাঙ্গ। একজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের যা যা করার কথা তার সবই তিনি করেছেন।

Advertisement

আজ বুধবার (১৯ আগস্ট) কালজয়ী এই লেখক ও চলচ্চিত্রকারের জন্মদিন। আজ জহির রায়হানের জন্মের ৮৫ বছর। ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামে।

জহির রায়হান তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে ১১ টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন, প্রযোজনা করেছেন ১১টি। তিনি গান লিখেছেন, অন্য পরিচালকের জন্য চিত্রনাট্যও লিখেছেন। কিন্তু তিনি এমন আরেকটি কাজ করেছেন যা সচরাচর দেখা যায় না। তিনি গঠন করেছিলেন ‘সিনে ওয়ার্কশপ’ এবং সেই ওয়ার্কশপ থেকে তার তত্ত্বাবধানে তরুণ নির্মাতারা যৌথভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন।

পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ ও প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ও তিনি নির্মাণ করেছিলেন। প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ তার অনবদ্য এক সৃষ্টি।

Advertisement

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের রূপরেখা কেমন হবে, তার পূর্ণাঙ্গ ধারণাপত্র তিনি তৈরি করেছিলেন এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছে তিনি তা জমাও দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি নিখোঁজ হবার পর আমলাতন্ত্রের ফাইলের স্তূপে তা হারিয়ে যায়।

আলমগীর কবির তার ‘ফিল্ম ইন বাংলাদেশ’ (১৯৭৯) বইতে জানাচ্ছেন, সেই রূপরেখায় চলচ্চিত্র কারখানার জাতীয়করণের কথা ছিল। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা কিউবার চলচ্চিত্রে সরকারি পৃষ্ঠাপোষকতার ফলে যে উন্নয়ন ঘটেছিল, সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী জহির রায়হান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকেও সেভাবেই দেখতে চেয়েছিলেন।

সারাজীবন কাহিনীচিত্র নির্মাণ করে গেলেও, যখন জাতির প্রয়োজন পড়েছে, তিনি নেমে পড়েছেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশি-বিদেশি নির্মাতারা বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। তবে দেশি নির্মাতাদের উল্লেখযোগ্য চারটি চলচ্চিত্রেই তিনি যুক্ত ছিলেন। তিনি নিজে নির্মাণ করেছেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও এ ‘স্টেট ইজ বর্ন’। আর প্রযোজনা করেছেন আলমগীর কবিরের ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ এবং বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’।

চলচ্চিত্রকার হিসেবে তার প্রস্তুতিপর্বটিও লক্ষ্য করার মতো। তিনি চিত্রগ্রাহক হতে চেয়েছিলেন প্রথমত। তাই কলকাতার প্রমথেস বড়ুয়া মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউট অফ ফটোগ্রাফিতে সিনেমাটোগ্রাফির ওপরে পড়তে গিয়েছিলেন। কিন্তু তা শেষ করতে পারেননি তিনি। তবে হাতেকলমে চলচ্চিত্র শেখার সুযোগ পেলেন এ জে কারদারের মতো পরিচালকের কাছে।

Advertisement

মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ (১৯৫৯) চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক ছিলেন তিনি। এই চলচ্চিত্রটি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া এফডিসির প্রথম বছরগুলোয় এহতেশাম ও সালাউদ্দিনের মতো পরিচালকের সহকারি ছিলেন তিনি।

আর বিদ্যায়তনে প্রথমে অর্থনীতিতে ভর্তি হলেও শেষপর্যন্ত তিনি পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। গল্প-উপন্যাস লেখার পাশাপাশি শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম চলচ্চিত্রেই তার মেধার সর্বোচ্চ স্ফূরণ ঘটে।

জহির রায়হানের প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’ (১৯৬১) বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসেই এক ব্যতিক্রমী সৃষ্টিকর্ম। আর ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০) জহির রায়হানের সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। ব্যক্তি জীবনে জহির রায়হান নিজেকে যুক্ত করেছেন সুমিতা দেবী ও খান আতাউর রহমানের সঙ্গে। প্রতিষ্ঠিত নায়িকা সুমিতা দেবী জহির রায়হানের প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’ এবং দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘কাঁচের দেয়াল’-এ প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। তাদের প্রেম থেকে বিয়েও হয়েছিলো। আর ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ থেকেই খান আতাউর রহমানের সঙ্গে জহির রায়হানের বন্ধুত্বের ও কাজের সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

অভিনয় ও গানের মধ্য দিয়ে খান আতা জহির রায়হানের চলচ্চিত্রে অবদান রেখে গেছেন। ‘বেহুলা’ (১৯৬৬) চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়েই নায়ক হিসেবে রাজ্জাক ও নায়িকা হিসেবে সুচন্দা প্রতিষ্ঠিত হন। সুচন্দার সঙ্গেও সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে করেন তিনি। তারই বোন ববিতা ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ চলচ্চিত্রে নায়িকা হিসেবে নির্বাচিত হন, যদিও চলচ্চিত্রটি শেষ হয়নি।

জহির রায়হানের কাছে কাজ শিখে পরে চলচ্চিত্রকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন আলমগীর কবির ও আমজাদ হোসেন।

শিষ্য আলমগীর কবিরের মতে, চলচ্চিত্রের নন্দনতাত্ত্বিক বিবেচনায় জহির রায়হানের শ্রেষ্ঠ কাজ ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩)। চলচ্চিত্রটি দর্শকপ্রিয় হয়নি, কিন্তু পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসব পুরস্কার, নিগার পুরস্কার এবং ফ্রাংকফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে সার্টিফিকেট অব মেরিট পুরস্কার পায়। ‘বেহুলা’ (১৯৬৬) ও ‘আনোয়ারা’ (১৯৬৭) নিশ্চয়ই তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র।

চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ নিগার পুরস্কার, একুশে পদক (মরণোত্তর) লাভ করেন জহির রায়হান। এছাড়া সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি আদমজী পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।

দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা ফিরে আসেন জহির রায়হান। তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে মিরপুরে যান এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির পর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মিরপুর ছিল ঢাকা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত বিহারী অধ্যুষিত এলাকা। এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে সেদিন বিহারিরা ও ছদ্মবেশি পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশিদের ওপর গুলি চালিয়েছে। সেখানে অন্য অনেকের সঙ্গে জহির রায়হানও নিহত হন।

বাংলা ও বাংলাদেশি সিনেমার কালপুরুষ জহির রায়হানের জন্মদিনে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তিনি না থেকেও রয়ে গেছেন এ দেশের চলচ্চিত্রের পথ নির্দেশক হয়ে। থাকবেন তার উপন্যাসের মতোই ‘হাজার বছর ধরে’।

এলএ/পিআর