গণতন্ত্র চাই- এমন একটা চিৎকার খুব সরব রাজনীতির মাঠে যারা ক্ষমতার বাইরে থাকে। আর যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের অভিমত, আমরা যা বলছি, যা করছি তাই গণতন্ত্র। বাংলাদেশের রাজনীতির অন্তহীন দুর্নীতি আর ক্রমবর্ধমান অন্যায়প্রবণতার সঙ্গে মিশে আছে দল প্রধান আর তার পরিবার ও গোষ্ঠির একচ্ছত্র প্রভাব। ক্ষমতা ও পেশিশক্তির উপর রাজনীতি যখন এতটা নির্ভরশীল হয়, তার একটা নিজস্ব স্ট্র্যাটেজি বা পদ্ধতিও তৈরি হতে থাকে। এর বৈশিষ্ট্য হলো রাজনীতি তারাই করবে যারা জি হুজুর জি হুজুর বলে দল প্রধানের সামনে সমানে কুর্নিশ করে যাবে। নিজে আবার তার ভুবনে একই ধরনের সংস্কৃতি লালন করবে। সংসদ নিয়ে টিআইবি’র প্রতিবেদন, ক্ষমতাসীন দলের প্রতিক্রিয়া আর বিএনপি নেতা শমসের মবিন চৌধুরীর রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা নতুন করে এই আলোচনাকে সামনে এনেছে। রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার সংস্কৃতি প্রয়োজন, এমনটাই বলছেন শমসের মবিন চৌধুরী। এই সংস্কৃতি একেবারেই নেই এদেশে। অসুস্থ, বয়সের ভারে চলতে পারেন না, তবুও দল ছাড়েন না, পদ ছাড়েন না। কিন্তু শমসের মবিন চৌধুরীর রাজনীতি ছাড়া মানে শুধু এটুকু নয়। এখানে দল বলতে যে শুধু কিছু ব্যক্তি তার প্রতিও দৃষ্টি এনেছে তার পদত্যাগ। আওয়ামী লীগ মানে শেখ হাসিনা, জাতীয় পার্টি মানে এরশাদ আর বিএনপি মানেতো কিছুটা খালেদা জিয়া, তার চেয়েও বেশিটা তারেক রহমান। যেখানে ব্যক্তি দিয়ে দল চিহ্নিত সেখানে সুস্থ, সাংস্কৃতিক পরিবেশের উপস্থিতি কোথায়?টিআইবি’র প্রতিবেদন নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে, আর সেজন্য পাল্টা তথ্য উপস্থাপনও করা যায়। কিন্তু চরম জিঘাংসায় ব্যক্তিগত আক্রমণ করা কোনো সুস্থতার লক্ষণ নয়। যারা এমনটা করছেন তারা করছেন দলীয় প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই। টিআইবি যে গবেষণা তথ্য উপস্থাপন করেছে সেটা তাদের নিয়মিত কাজ, অনেকদিন থেকেই করছে। এই প্রতিবেদন টিআইবি করছে, হয়তো আবারো করবে। কিন্তু আমার কেন যে মনে হচ্ছে টিআইবি তুলে ধরতে পারে আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যদের মান ধীরে ধীরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুধু কোরামের মান নয়, বিতর্কের মান নয়, আমরা এমন সংসদ সদস্য পাচ্ছি যাদের অনেকে গাড়ি থেকে গুলি করে ফিল্মি স্টাইলে, এমন সদস্য আছেন যারা যার যার এলাকায় নিজ দলেরই উপজেলা চেয়ারম্যানকে কাজ করতে দিচ্ছেন না। এমন খবর হামেশাই পাচ্ছি যে সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যরা অনেক এলাকায় স্থানীয় এমপি’র সন্ত্রাস আর সহিংসতার শিকার। আমাদের রাজনৈতিক দলের কাউন্সিল হয় না, কাউন্সিল হলে ভোট হয় না, ভোট হলেও নেতা নেত্রী বদলায় না। দলের অভ্যন্তরে এমন যে গণতন্ত্রের চর্চা, তাতে যারাই মসনদে বসুক, তাতে দেশে কতটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বজায় থাকে? বাংলাদেশ যে প্রায়শই গণতন্ত্রের পথ থেকে বিচ্যুত হয়, গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতার পালাবদলের পরও যে গণতন্ত্র দৃঢ় ভিত পায় না, তার মূলে রয়েছে প্রধান দলগুলোতে গণতন্ত্র না থাকা। শমসের মবিন চৌধুরী রাজনীতি থেকে অবসর নিলেন এমন এক সময়ে যখন দেশে এক ধরনের অস্থিরতা আছে, রাজনীতি অনেকটা অনিশ্চিত যাত্রায়। স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়েছেন, কিন্তু পুরোটা বোঝা যাবে না শুধুমাত্র লিখিত পদত্যাগপত্র থেকে। একটা দিক হলো, জীবনভর আরাম আয়েশে থাকা আমলারা যে বিরোধী দলে বেশিদিন থাকতে পারেন না তার আরো একটি নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এর আগে এমন আচরণ দেখেছি সাবেক আমলা থেকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বনে যাওয়া সাবিহ উদ্দিন আহমেদ-এর কাছ থেকে। এতগুলো ঘটনার পর আর কোনো কর্মকাণ্ডে দেখা যাচ্ছে না সাবেক কূটনীতিক রিয়াজ রহমানকেও। আওয়ামী লীগে যে আমলা উপদেষ্টা শ্রেণি আছেন তাদেরও দুঃসময়ে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। আরেকটি হতে পারে দল করতে হলে ভদ্রতা, নম্রতা কিংবা আত্ম-মর্যাদাবোধ থাকতে নেই। থাকলে দল করা যায় না। ভৃত্যের মতো বয়সে ছোট দল প্রধানের পরিবার ও গোষ্ঠি সদস্যদের আদেশ নির্দেশ হজম করে থাকতে হয়। শমসের মবিন আন্তর্জাতিক মহলের সাথে যোগাযোগ রাখতেন, বৈঠক করতেন। কিন্তু দল প্রধান বা উপ-প্রধানের সন্তুষ্টি হয়তো অর্জন করতে পারেননি। তাই দেখা গেল পরবর্তীকালে তাঁকে অনেকটা বাইরে রেখেই বিএনপির নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে আলোচনা করছে। জি-হুজুর রাজনীতির দাপটে তিনি দলে থেকেও হারিয়ে গিয়েছিলন। তার পরিসমাপ্তি ঘটালেন রাজনীতিকে বিদায় জানিয়ে। সরকারের চাপে পদত্যাগ করেছেন কিনা তা জানা যাবে না খুব শীঘ্র। কিন্তু আওয়ামী লীগের দু’একজন নেতা যেভাবে বলছেন, আরো বিএনপি নেতা দল ছাড়বেন, তা কিন্তু অন্য রকম ইঙ্গিত দেয়। রাজনীতি কোন পথে চলছে, বা চলবে জানার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে আমাদের। এইচআর/এমএস
Advertisement