কিছু কিছু লেখা দেখেই মনে হয় সেগুলো শুধু প্রকাশকের অনুরোধ বা চাপ নয়, লেখক লিখছেন নিজের ভালবাসা বা তাগিদ থেকে। নিজের ভেতরে ভাল কিছু লেখার যে প্রেরণা, যে তাড়না, তা থেকে। সিদ্ধার্থ হকের একটি বেশ বড় উপন্যাস ‘অচিরকাল’ পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এই বইটা আসলে তিনি না লিখতেনই।
Advertisement
সহকর্মী, কিংবা কাছাকাছি থাকা মানুষ যে কত রকম হয়, তাদের লোভ, হিংসা, উদারতা, সংকীর্ণতা, যৌনতা, জীবনের জটিলতা তুলে ধরে অচিরকালের লেখক শুধু কাহিনী নয়, আমাদের সামনে এনেছেন কাহিনীর পূর্ণতা। এই উপন্যাসে লেখকের যে জীবন দেখা তার সবটাই মানুষের দ্বান্দ্বিক অবস্থান। বইটিতে একসাথে চলতে গিয়ে পিছিয়ে পড়া বা এগিয়ে যাওয়া মানুষের রসায়ন যেমন আছে, আছে খুব নিকটজনই কি করে অমানবিক হয়ে উঠে কারো সাজানো বাগানকে তছনছ করে দেয়, সে কথাও। উদারতার ভিতরেও যে স্বার্থপরতা থাকে, আবার স্বার্থপর মানুষের ভেতরেও সে দ্বন্দ্ব থাকে সেসব কথা সিদ্ধার্থ হক বলেছেন সমাজের বাস্তব চালচিত্র তুলে ধরে।
টুকু, যাকে তার বস হামিদ বিকৃত করে ডাকে ‘অংশটুকু’। “টুকুর মনে হয়, হামিদের দেওয়া বিকৃত এই নামের মধ্যে তার জীবনের গভীর সত্য লুকিয়ে আছে”। এক দারুণ অফিস চরিত্র, একই সাথে আরেক মূল চরিত্র কৃপার বন্ধু চরিত্র। কিন্তু উপন্যাস শুধু চরিত্র নয়, হৃদয়কে, মনকে কত সুন্দর করে তুলে ধরে, যখন পড়ি, “প্রতিদিন দেখা কিন্তু তবু জানতে না পারা কোন মানুষের মতো সন্ধ্যা উপস্থিত হয় আর চারদিকে এক বিরাম নেমে আসে”।
টুকুর বেতন কমে যায় শুধু, হয়তো বাড়েও কখনও। কিন্তু তার নিজের বাবা, ভাইদের যে চরিত্র পাই তাতে বুঝতে পারি, কী নিদয়া আমাদের কারও কারও পারিবারিক জীবন, কতটা নিষ্ঠুর কর্ম জীবন! দালানের ভেতরে টুকুর বাবা হারিয়ে যায় এবং আর ফিরে আসতে পারে না... আসলে ফিরে আসা যায় না। টুকু কৃপাকে ভালবাসে না বন্ধু ভাবে এই দ্বন্দ্ব হয়তো লেখককেও স্পর্শ করে যখন তিনি বলেন, “বন্ধুত্ব আর প্রেম যেন এক হয়ে যায়, এবং হয় না”।
Advertisement
একটা অফিস, কিছু সহকর্মী, কিছু মানুষের জীবনের গল্পে প্রকাশিত হয়েছে সমাজের চিত্র। পাপ আর পুণ্য এখানে হাত ধরাধরি করে হাঁটে। নিজেদের ভিতর ভালবাসায় ভরা জীবন, এই জীবনের ভেতর পাপের বাসা। বড় বস হামিদ টুকুকে ঠকায়, সে অর্থ এবং নারী লুলুপ, সে মিথ্যা বলে অবিরত। কিন্তু তাকেও নিজের সাথে সংলাপ করতে হয়। “ক্যাফেতে একা বসে বসে, বসে আছে হামিদ; হামিদের মতো, হামিদ নিজেই, অ-হামিদের প্রায় এক হামিদ। যেন সে খানিকটা টুকু, এক-তৃতীয়াংশ টুকু”।
উপন্যাসটি শেষ করে মনে হল, এই বই আমাদের কথাই বলেছে। চরিত্র গুলোকে যেভাবে নির্মাণ করেছেন লেখক, তাতে অন্তর্লীন হয়ে আছে সময়। আমাদের সবারই আছে একান্ত নিজস্ব সংঘাতের জীবন। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শহরের শ্রেণীর মনস্তত্ব, উল্লাসের বিপরীতে বঞ্চনা আর হাহাকারের সংঘর্ষ সবই আছে এই উপন্যাসে। পরম মমতায় বর্ণনা করেছে তাদের স্বপ্নকথাগুলো, তার তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি অব্যাহতি দেয়নি জীবনের সৌন্দর্য আর অসৌন্দর্যকে। টুকুর জীবনের অধ্যায়ের উপর নির্ভর করে খেয়া, তুলি, কৃপা, সুজাতা চরিত্র গুলো একেকটা আলাদা কাহিনী।
পড়তে পড়তে কখনও কখনও টুকু বা কৃপার অন্তর্বেদনা মনে সঞ্চার করে শূন্যতার অনুভূতি। মানুষের জীবনসংগ্রাম, তাদের রোগ,শোক, আনন্দ, উচ্ছ্বাস, অভাব,আবেগই মনের গহীনে বেঁচে থাকার মতো সিদ্ধার্থ হকের উপন্যাস ‘অচিরকাল’।
এইচআর/পিআর
Advertisement