‘লাইন চালু রেখেই ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের তারের সংযোগ লাগাতে বলা হয়। বারবার বলেছি লাইন বন্ধ করেন। ঠিকাদার বললেন কাজ করো। চাপের মুখে সংযোগ স্থাপনের জন্য ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের তারে হাত দিই। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে খুঁটিতে ঝুলে যাই। ঝুলে থাকা অবস্থায় ঠিকাদার পালিয়ে যান। পরে বিদ্যুতের সংযোগ বন্ধ করে আমাকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। প্রাণে বাঁচলেও দুই হাত কেটে ফেলতে হয় আমার। এখন প্রতিবন্ধী হয়ে বেঁচে আছি। ঠিকাদারের ভুলে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেলাম আমি।’
Advertisement
পল্লী বিদ্যুতের কাজ করতে গিয়ে পঙ্গু হওয়ার নির্মম ঘটনার বর্ণনা এভাবেই দেন গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের চন্দনপাঠ গ্রামের যুবক বাদশা মিয়া। ঠিকাদারের হয়ে পল্লী বিদ্যুতের কাজ করতে গিয়ে পঙ্গু হন তিনি। সেদিনের ঘটনার কথা মনে করে কেঁদে ফেলেন বাদশা মিয়া।
২০০৯ সালে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন বাদশা। ২০১১ সালে এমএ মোত্তালিব টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। ২০১৩ সালে তার মা মেরিনা বেগম মারা যান। মা হারানোর শোক বুকে নিয়ে অনেক কষ্টে পড়াশোনা চালিয়ে বোনারপাড়া সরকারি কলেজ থেকে ২০১৭ সালে ডিগ্রি পাস করেন তিনি।
বাবা মোসলেম উদ্দিন রংপুর সুগার মিলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে বাদশা মেজো। বড় ভাই মোহাম্মদ আলী বিজিবিতে কর্মরত। ছোট ভাই মেহেদী হাসান লেখাপড়া করছেন। স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষে সরকারি চাকরি করে বড় ভাইয়ের পাশাপাশি সংসারের হাল ধরবেন। এরই মধ্যে পাশের গ্রামের উর্মি আক্তারকে বিয়ে করেন বাদশা।
Advertisement
বিয়ের ছয় মাস না যেতেই অধিক বেতনে চাকরি দেয়ার কথা বলেন প্রতিবেশী পল্লী বিদ্যুতের ঠিকাদার সোহরাব এন্টারপ্রাইজের মালিক মোখলেছুর রহমান। পল্লী বিদ্যুতের কাজে বাদশাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার বিটঘর কাইতলা এলাকায় নিয়ে যান মোখলেছুর রহমান। কি কাজ করতে হবে কোনো ধারণা না দিয়েই বাদশাকে পল্লী বিদ্যুতের কাজ করতে বলা হয়। এরপর জীবিকার তাগিদে পল্লী বিদ্যুতের কাজ শুরু করেন তিনি।
নেই কোনো অভিজ্ঞতা, নেই দক্ষতা। ঠিকাদার যেভাবে বলেন সেভাবে বিদ্যুতের কাজ করতে হয়। কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুতের সংযোগ বন্ধ আছে কি-না জানতে চাইলে ঠিকাদার গালিগালাজ করেন। কাজ করতে গিয়ে বাদশা বুঝে গেছেন ঠিকাদারের কাছে কর্মীদের জীবনের কোনো মূল্য নেই।
১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের সংযোগ বন্ধ না করেই নতুন সংযোগ স্থাপনের কাজ করতে হয় বাদশাকে। দুর্ঘটনার দিন বিদ্যুতের খুঁটিতে উঠে বাদশা বারবার ঠিকাদার মোখলেছুর রহমান ও অন্যদের বলেছেন সংযোগ বন্ধ কি-না। এ সময় ঠিকাদার রেগে গিয়ে বলেন লাইন বন্ধ, কাজ করো। এত ভয় কিসের। টাকা কি এমনি এমনি দেব।
ঠিকাদারের চাপের মুখে নতুন সংযোগ স্থাপনের জন্য ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের তারে হাত দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে খুঁটিতে ঝুলতে থাকেন বাদশা। ঝুলে থাকা বাদশাকে ফেলে ঠিকাদার ও তার লোকজন ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। পরে বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে বাদশাকে উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। কিন্তু ততক্ষণে বড় ক্ষতি হয়ে যায় বাদশার। প্রাণে বাঁচলেও দুই হাত কেটে ফেলতে হয় তার। এখন প্রতিবন্ধী হয়ে বেঁচে আছেন তিনি। ঠিকাদারের খামখেয়ালিপনায় এমন ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ বাদশার।
Advertisement
নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সেদিনের ঘটনার কথা মনে করে কেঁদে ফেলেন বাদশা মিয়া। কেঁদে কেঁদে তিনি বলেন, ঠিকাদার কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই আমাদের দিয়ে বিদ্যুতের কাজ করান। লাইন চালু রেখে ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের তার খোলা ও সংযোগের কাজ করতে বলা হয়। সেদিন বারবার বলেছি লাইন বন্ধ কি-না। ঠিকাদার কোনোভাবেই আমার কথা কানে নেননি। যদি সেদিন কথা কানে নিতেন তাহলে আমার এই অবস্থা হতো না। নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য আমাদের মতো কর্মীদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করান ঠিকাদার। আমি এখন অসহায়, প্রতিবন্ধী হয়ে বেঁচে আছি। আমার চলাফেরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল। ঠিকাদারের ভুলে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেলাম। এ নিয়ে উপজেলা ও জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো সমাধান পাইনি।
তিনি বলেন, পিপাসা লাগলে এক গ্লাস পানি নিজ হাতে খেতে পারি না। কেউ খাইয়ে না দিলে না খেয়ে থাকতে হয়। বাবা আছেন তার সমস্যা নিয়ে। বাবা নিজেই চলতে পারেন না আমাকে কীভাবে চালাবেন। সংসারে এখন আমি সবার বোঝা হয়ে গেছি। বাড়ির সব কাজ স্ত্রী করে দেয়। অনেক সময় বিরক্ত হয়ে রাগারাগি করে বাপের বাড়ি চলে যায়। প্রস্রাব-পায়খানা করে পানি নিতে পারি না। ভাই কিংবা স্ত্রী অথবা অন্যের সাহায্যে আমাকে চলতে হয়।
বাদশা মিয়ার বাবা মোসলেম উদ্দিন বলেন, ঠিকাদার মোখলেছুর রহমানের খামখেয়ালিপনায় আমার ছেলে পঙ্গু হয়ে গেছে। কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়ে এখন হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন মোখলেছুর রহমান। তার ভয়ে অসহায় জীবনযাপন করছি আমরা। আমি এ ঘটনার উপযুক্ত বিচার চাই।
বাদশা মিয়ার স্ত্রী উর্মি আক্তার বলেন, বিয়ের ছয় মাসের মাথায় পল্লী বিদ্যুতের কাজে গিয়ে আমার স্বামী পঙ্গু হয়ে যায়। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি প্রতিবন্ধী হওয়ায় দিশেহারা আমরা। অনেক কষ্টে সংসার চলে আমার। ক্ষতিপূরণ চাইলে আমাদের ভয়ভীতি দেখান ঠিকাদার। এত বড় ক্ষতির পরও আমাদের কোনো সহযোগিতা করেনি ঠিকাদার কিংবা পল্লী বিদ্যুৎ। আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। আমি অন্তঃসত্ত্বা। আমরা কোথায় যাব, কি করব, কীভাবে চলবে আমাদের সংসার তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। আমার স্বামীর এ অবস্থার জন্য যারা দায়ী তাদের শাস্তি চাই। একই সঙ্গে আমাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ জানাই।
বাদশা মিয়ার সহকর্মী ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাঘাটা উপজেলার কামালের পাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘আমি সেদিন বাদশা মিয়াকে বিদ্যুতের যন্ত্রপাতি তুলে দেই। বাদশা ও আমি একাধিকবার বলার পরও বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করেননি ঠিকাদার ও সুপারভাইজার। সেদিন আমাদের জোর করে বিদ্যুতের খুঁটিতে তুলে দেন ঠিকাদার। বিদ্যুতের লাইন বন্ধ না করে কাজ করতে বাধ্য করার ফলে দুর্ঘটনায় দুই হাত হারান বাদশা।’
বাদশা মিয়ার মতো একই অবস্থা সাঘাটা উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের চন্দনপাঠ গ্রামের বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম, বাবুল ইসলাম ও আব্দুল হাইসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির। ঠিকাদারের হয়ে পল্লী বিদ্যুতের কাজ করতে গিয়ে পঙ্গু হয়েছেন তারা।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, পল্লী বিদ্যুতের ঠিকাদার মোখলেছুর রহমানের অবহেলায় আজ আমি পঙ্গু। সংসারের বোঝা হয়ে আমাকে জীবনযাপন করতে হয়। এত বড় ক্ষতির পরও কোনো ধরনের সহায়তা দেননি ঠিকাদার।
এ বিষয়ে মেসার্স সোহরাব এন্টারপ্রাইজের মালিক ঠিকাদার মোখলেছুর রহমান বলেন, বাদশার বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা চলছে। এক সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টি মীমাংসা করা হবে। তবে দুর্ঘটনার দিন বিদ্যুতের লাইন বন্ধ না করার জন্য ঠিকাদার দায়ী নন। ঠিকাদারের কাজে নিযুক্ত সুপারভাইজার ও শ্রমিক সর্দারের বিষয়টি দেখার কথা ছিল।
ঠিকাদারের কাজে নিযুক্ত সুপারভাইজার মাহিদুল ইসলাম বলেন, সেদিন ঘটনাস্থলে আমি ছিলাম না। পরে শুনেছি বাদশা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।
শ্রমিক সর্দার সাদ্দাম হোসেন বলেন, আমরা লাইন বন্ধ করার অবেদন দিয়ে কাজ শুরু করেছি। কাজ চলা অবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি মীমাংসার জন্য একাধিকবার সালিশ-বৈঠক করলেও কোনো সমাধান হয়নি। ঠিকাদার বিষয়টি মীমাংসা করছেন না।
সাঘাটার কচুয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. গোলজার রহমান বলেন, আমার ওয়ার্ডে হাত-পা হারানো ব্যক্তির সংখ্যা অনেক। সঠিক সংখ্যা আমার জানা নেই। এদের অধিকাংশই পল্লী বিদ্যুতের কাজে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে হা-পা হারিয়েছেন। এখন প্রতিবন্ধী হয়ে দিন কাটছে তাদের। ভবিষ্যতে আর কেউ যেন দুর্ঘটনায় না পড়ে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানাই। একই সঙ্গে অভিযুক্ত ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক।
অভিজ্ঞতা ছাড়া ঠিকাদারের লোকজন বিদ্যুতের কাজ করতে পারবে কি-না জানতে চাইলে গাইবান্ধা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বোনারপাড়া জোনাল অফিসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) আব্দুল হালিম বলেন, আমরা পল্লী বিদ্যুতের যেকোনো কাজ টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদারদের দেই। নতুন সংযোগ বা ট্রান্সফরমার পরিবর্তনের জন্য পল্লী বিদ্যুতের নির্দিষ্ট ফরমের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। নিয়মবহির্ভূতভাবে কাজ করতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার জন্য ঠিকাদার দায়ী থাকবেন। যেহেতু টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ দেয়া হয় সেহেতু দুর্ঘটনার দায় নেবে না পল্লী বিদ্যুৎ।
এএম/পিআর