করোনাকাল মানুষের জীবনের নিয়ে এসেছে পরিবর্তন। সেই পরিবর্তন বস্তুত ভালো না হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ সেটিকে নিয়েছে চ্যালেঞ্জ হিসেবে। এবং এই চ্যালেঞ্জে জিতে মানুষ নিজেকে বদলেছে, বদলেছে তার স্বপ্নকে। একই সৃঙ্গে হয়ে উঠছে নিজেই উদ্যোক্তা। এই উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়টি কেন এলো, এই কারণে যে, মানুষ ঠেকে শিখছে।
Advertisement
করোনা অনেক মানুষকে পথে বসিয়েছে। অনেককে শহরছাড়া করেছে। প্রিয়জনকেও হারানোর কথাতো জানা। তবে এর মধ্যেও মানুষ থেমে থাকে না। মানুষকে শত প্রতিকূলতার মাঝেও সংগ্রাম করেও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয় বলে সভ্যতার বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে যারা বয়স বা মনের দিক থেকে তরুণ তারাতো থেমে থাকলে চলবে না। তাই তারা থেমে থাকছে না।
উঠতি তরুণ, যারা উদ্যম নিয়ে কাজ শুরু করেছিল করোনার মতো মাইক্রো ভাইরাস এসে তাদের থামিয়ে দিয়েছিল প্রথম দিকে। বিশেষ করে এমন অনেক কাজ রয়েছে যা লোকসমাগম ছাড়া সম্ভব নয়, আবার করোনার কারণে সেটিও হচ্ছে না। সেসব দিক বিবেচনা করে করোনাকালে এখন তরুণরা ঝুঁকছেন অনলাইন প্ল্যাটফরমের দিকে। অনলাইনের নিজেদের ব্যবসা বাণিজ্যকে সম্প্রসারণ করে নিজে নিজেই হয়ে উঠছেন স্বাধীন উদ্যোক্তা।
লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, করোনাকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বা অন্যান্য মাধ্যম ব্যবহার করে তরুণ তরুণীরা নিজেদের আগ্রহের জায়গাটা ছড়িয়ে দিচ্ছেন সবার মাঝে। এটি একদিকে নিজের কাজের বা ভালোবাসার শক্তিকে প্রদর্শনের জায়গা যেমন তেমনি আয়েরও একটি বড় উৎস। অনেকে এর মাধ্যমে নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি পরিবারের দায়িত্ব যেমন নিতে পারছেন তেমনি করোনাকালে হঠাৎ বেকার হয়ে যাওয়ার অভিশাপ থেকেও মুক্ত হওয়া সম্ভব হচ্ছে।
Advertisement
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশই ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী তরুণ এবং কর্ম উপযোগী। বিশাল এই জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বছরজুড়ে হিমশিম খায় সরকার। কর্মবাজারে নতুন যারা প্রবেশ করতে আগ্রহী তাদের অর্ধেকেই থেকে যায় বেকার আর অদক্ষ। আবার স্বল্প দক্ষদের বড় অংশ কাজ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এই যখন সাধারণ সময়ের অবস্থা এর মধ্যে মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছে করোনা ভাইরাস। গেল কয়েকমাসে কর্মহীন, চাকরি হারানো বা বিদেশ ফেরত লোকের সংখ্যা আরো বেড়েছে।
নতুন নিয়োগ বা কাজের হারও বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই সীমিত। কর্মহীনতার সঙ্গে বেড়েছে দারিদ্যের হারও। এহেন পরিস্থিতিতে তরুণরা ঝুঁকছেন নিজেরা উদ্যোক্তা হয়ে অনলাইন বাণিজ্যের দিকে। অনেকে বন্ধু বান্ধব নিয়ে ছোট পরিসরে শুরু করলেও এই কয়েকমাসে ব্যবসার পরিধি আরো বাড়িয়েছেন। এবং অনেকেই সিরিয়াসলি ভাবছেন করোনা পরিস্থিতি যদি ভালোও হয়ে যায় তাহলে আর চাকরিতে না ফিরে এই ব্যবসা চালিয়ে যাবেন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অবস্থা থেকে প্রচণ্ড ইচ্ছে শক্তির কারণে তরুণ তরুণীরা এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, এটা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
শুধু চাকরির পেছনে না ঘুরে তারা জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পেয়েছেন। করোনা তাহলে সম্ভাবনাময় তরুণদের ভবিষ্যত নষ্ট করতে পারেনি। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে, অনেক নারী, যারা হয়তো নিজের অনেক গুণকে খোলতাই করার সুযোগ পাচ্ছিলেন না তারাও অনলাইনের সুযোগে নানা পণ্য তৈরি করছেন, নিজেকে ক্ষুদ্র হলেও উদ্যোক্তার কাতারে নিয়ে আসছেন।
এবার প্রশ্ন হলো, এই যে এতো এতো উদ্যোক্তাকে আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি, অনলাইনের জয়জয়কার ও ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রসংশা করছি এসব কিছুই পরিপূর্ণতা পাবে একমাত্র সততার ওপর। তারুণ্যের বিকাশে সরকারের ২২টি মন্ত্রণালয় জড়িত, কিন্তু তাদের প্রকল্পগুলোতে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় না তরুণ ও যুব সমাজের উন্নয়নকে। কিন্তু সরকারি সহযোগিতা পেলে এই ছোট ছোট উদ্যোগগুলোই একসময় হয়তো মহীরূহ হতো। তাই তরুণদের এখন একমাত্র মূলধন সততা।
Advertisement
যদিও বাজারে প্রচলিত হাস্যরস রয়েছে, এখন বেশিরভাগই দেখা যায়, ঘি, তেল, মধু ও সর্ষের তেল বিক্রি করতে। কিন্তু এর বাইরেও যে নানা জিনিস বিক্রি হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে বলছিলাম, আমাদের দেশে অনলাইন ব্যবসা সম্পর্কে মানুষের ধারণা সুখকর নয়। বিদেশ থেকে যখনই আমরা পরিচিত কাউকে প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে বলি তারা অ্যামাজন ডট কম লিংক দিয়ে সেখান থেকে জিনিস পছন্দ করতে বলেন, এটার কারণ তাতে সময় ও শ্রম বাঁচে। এর জিনিস ওকে, ওর জিনিস তাকে দিয়ে মধ্যস্বত্ত্ব ভোগী হয়েও অ্যামাজন বা আলীবাবার মালিক সে কারণে বিশ্বের সেরা ধনীর তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছেন।
অন্যদিকে আমাদের দেশে যে কয়েকটি সুপরিচিত বা প্রতিষ্ঠিত অনলাইন ব্যবসার প্লাটফরম রয়েছে তাদের রেটিং মার্ক খুব সুবিধার নয়। পণ্য কিনে নানা ধরনের হয়রানি, মানহীন পণ্য বা পণ্যের বদলে অন্য বস্তু দেয়ার উদাহরণও রয়েছে। একইসঙ্গে সেসব বিষয়ে নিস্পত্তি হওয়ার অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। কাজেই অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে এখনো এদেশে বাধা বাধা ঠেকে। সে জায়গায়টায় নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ রয়েছে তরুণ উদ্যোক্তাদের। এবং সেখানে সুযোগ রয়েছে সততা দেখানোর। আমাদের দেশে অনলাইন ব্যবসায়ীদের এমন অবস্থা পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ফেসবুকে অসংখ্য অনলাইন শপিং পেজ রয়েছে।
যেগুলো নানা রকমের চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে লোকজনকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে থাকে। এরমধ্যে কিছু পেজ পাওয়া যায় যেগুলো কখনও কখনও এক ধরনের প্রোডাক্ট দেখিয়ে অন্য ধরনের প্রোডাক্ট বা নিম্নমানের প্রোডাক্ট ডেলিভারি দিয়ে থাকে। আবার, কিছু কিছু পেজ পাওয়া যায় যেগুলো প্রোডাক্ট অর্ডারের জন্য অগ্রীম মূল্য পরিশোধ করার পরও কোনও প্রোডাক্টই ডেলিভারি দেয় না। এক্ষেত্রে, আপনি যদি তাদের চ্যালেঞ্জ করেন তারা আপনার নম্বর বা একাউন্টটি ব্লক করে দেবে।
এ ধরনের পেজগুলো সাধারণত চালু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন পরিমাণের টাকা হাতিয়ে নিয়ে অ্যাকাউন্টটি হঠাৎ করে ডিএকটিভেট করে দেয়’। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। তরুণ যারা উদ্যোক্তা হচ্ছেন তারা যেন এই বিষয়টি খেয়াল রাখেন। কারণ কোনো পণ্য একবার কিনে যদি সাধারণ মানুষ উপকৃত হয় তবে বারবার তার কাছেই যাবে।
আবার কেউ যদি পণ্য কিনে প্রতারিত হন তবে মনে রাখতে হবে সেপথে ক্রেতা আর পা বাড়াবে না। অনলাইনে এসব প্রতারণার সঙ্গে শুধু যে দেশি অনেকে জড়িত তা নয়। নানা উপহারের ফাঁদে ফেলে অনেকের সর্বশ্রান্ত করার ঘটনাও ঘটেছে। বিশেষ করে নাইজেরিয়ানদের সঙ্গে দেশিয় কিছু মানুষের যোগসাজশ প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে।
সে ক্ষেত্রে পরামর্শ হচ্ছে, এদের দ্রুত দেশে পাঠিয়ে দেয়া। এসব প্রতারণার পাশ কাটিয়ে আমার মনে হয় নতুন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাই পারবে মানুষের মন জয় করতে। যেখানে অনেক প্রতিষ্ঠিত অনলাইন ব্যবসায়ী বদনাম কুড়িয়েছে সেখানে একমাত্র ক্রেতা সন্তুষ্টির কথা মাথায় রাখলেই তরুণ উদ্যোক্তা একদিন স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারবে। কারণ কে না জানে, তারুণ্যই শক্তি, তারুণ্যই বল।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ।
এইচআর/এমএস