বিশেষ প্রতিবেদন

কমিউনিটি ক্লিনিকে বিনামূল্যের ওষুধের দাম ২০ টাকা

গ্রামীণ জনগোষ্ঠির দোড়গোঁড়ায় বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে বর্তমান সরকারের প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো খুব একটা কাজে আসছে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেশিরভাগ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর অবস্থা একেবারেই বেহাল। এসব ক্লিনিকগুলোতে শুধুমাত্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমেপ্লক্স থেকে কয়েক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে রোগীদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন কমিউনিটি হেলথ্ কেয়ার প্রোভাইডাররা (সিএইচসিপি)। তাদের সঙ্গে রয়েছে দুজন স্বাস্থ্য সহকারী ও একজন করে পরিবার কল্যাণ সহকারী। তবে ক্লিনিগুলোতে বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক না থাকায় কাঙ্খিত স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না সাধারণ রোগীরা। এর ফলে বাধ্য হয়েই শহরের বেসরাকারি ক্লিনিকগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন তারা।এদিকে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ বিতরণের নিময় থাকলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কয়েকটি ক্লিনিকে এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। ওষুধের জন্য রোগীদের কাছ থেকে ২০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ ইউনিয়নের সূর্যকান্দি গ্রামের কালিকচ্ছ (পূর্ব) কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা কয়েকজন রোগীর সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এই প্রতিবেদকদের।  তারা অভিযোগ করে বলেন, এই ক্লিনিকের সিএইচসিপি শিরিন আক্তার বকুলের শ্বশুর আশ্রফ আলী মৃধা ক্লিনিকটির জন্য সরকারকে জমি দান করেছেন। সেই কারণে বকুলকে এই ক্লিনিকে সিএইচসিপির চাকরি দেওয়া হয়। এরপর থেকেই এই ক্লিনিকটি পুরোপুরি বকুলের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। রোগীরা আরো অভিযোগ করেন, বকুল টাকা ছাড়া রোগীদের কোনো ওষুধ দেন না। প্রতি রোগীর কাছ থেকে ওষুধের জন্য ২০ টাকা করে মূল্য নেন তিনি। এতে করে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন এই ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা দরিদ্র্য রোগীরা।তবে অভিযুক্ত শিরিন আক্তার বকুল ওষুধের বিনিময়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে জাগো নিউজকে বলেন, ওষুধের জন্য কোনো মূল্য নেওয়া হয় না। শুধুমাত্র উন্নয়ন ফান্ডের জন্য রোগীদের কাছ থেকে দুই টাকা করে নেওয়া হয়। তবে এই দুই টাকা দেওয়া রোগীদের জন্য বাধ্যতামূলক নয় বলে স্বীকার করেন তিনি। কিন্তু ক্লিনিকে তার আধিপত্য বিস্তারের প্রশ্নটি এড়িয়ে যান তিনি।এদিকে সকাল ৯টার মধ্যে ক্লিনিক খোলার কথা থাকলেও গত বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত সরাইল উপজেলার কলিকচ্ছ (ধর্মতীর্থ) কমিউনিটি ক্লিনিকটি ছিল তালাবদ্ধ। তবে সাংবাদিক ক্লিনিকে এসেছেন-স্থানীয়দের কাছ থেকে এমন সংবাদ পেয়ে সকাল সোয়া ১০টায় ক্লিনিকে ছুটে আসেন সিএইচসিপি সৈয়দা নাছিমা বেগম।সিএইচসিপি সৈয়দা নাছিমা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, তিনি প্রতিদিন সময়মতোই ক্লিনিকে আসেন। কিন্তু আজ (বুধবার) তিনি শশুরবাড়ি থেকে আসতে দেরি হওয়ায় ক্লিনিকের তালা খুলতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।অন্যদিকে উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের কাজীউড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে বেলা ১১টায় গিয়ে দেখা যায় সিএইচসিপি শেখ আখতারুজ্জামান রাজিব একাই রোগীদেরকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। এদিন পুরো ক্লিনিকে তিনি আর একজন ঝাড়ুদার ছাড়া অন্য কোনো স্টাফ উপস্থিত ছিলেন না। এর ফলে একা রোগীদেরকে সেবা দিতে হিমশিত খেতে হয় তাকে। ক্লিনিকে না আসার কারণ জানতে চেয়ে কাজীউড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের পরিবার কল্যাণ সহকারী রওশন আরা বেগমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে জানান, সবদিন সময়মতো ক্লিনিকে আসা যাওয়া করা সম্ভব না। আমাদেরও কাজ থাকতে পারে। আজকে (বুধবার) আমি ক্লিনিকে আসতে পারবো না। ম্যাডাম আমাকে ডেকেছেন।কাজীউড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি শেখ আখতারুজ্জামান রাজিব জাগো নিউজকে জানান, প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ জন রোগী ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসেন। আমরা আমাদের সাধ্যমতো রোগীদেরকে ছোট-খাটো সব রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকি। আমাদের ক্লিনিক থেকে রোগীদের ৩০ ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। তবে বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক না থাকায় রোগীদেরকে জটিল কোনো রোগের চিকিৎসা বা ওষুধ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি।শুধুমাত্র সরাইল উপজেলা নয়, জেলার অন্যান্য উপজেলার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর চিত্র ঠিক একই রকম। বেশিরভাগের অবস্থা খুবই নাজুক। এসব ক্লিনিকগুলোতে প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ আর সংশ্লিষ্টদের নজরদারির অভাবে গ্রামীণ দরিদ্র্য জনগোষ্ঠিকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা ভেস্তে যাচ্ছে। তবে ক্লিনিকগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ করে যদি ঠিকমতো নজরদারিতে রাখা যায় তাহলে সরকারের প্রচেষ্টা অনেকাংশেই সফল হবে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় বর্তমানে ২৩৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। এর মধ্যে নাসিরনগর উপজেলায় ২১টি, সরাইল উপজেলায় ২১টি, সদর উপজেলায় ৩১টি, আখাউড়ায় উপজেলায় ১৬টি, কসবা উপজেলায় ৩৩টি, নবীনগর উপজেলায় ৪৭টি, বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় ৩০টি, আশুগঞ্জ উপজেলায় ১৩টি এবং বিজয়নগর উপজেলায় ২৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এসব ক্লিনিকে একজন করে সিএইচসিপি, দুইজন স্বাস্থ্য সহকারী ও একজন করে পরিবার কল্যাণ সহকারী কর্মরত রয়েছেন। তবে ক্লিনিকগুলোতে বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক না থাকায় রোগীদের পাশাপাশি বিপাকে পড়েছেন সিএইচসিপিরাও। এর ফলে সর্দি-কাশি বা ডায়রিয়ার মতো সাধারণ কিছু রোগ ছাড়া অন্য কোনো জটিল রোগের চিকিৎসা করতে পারছেন না সিএইচসিপিরা। তাই বাধ্য হয়েই রোগীদেরকে শহরের বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে যেতে হচ্ছে।এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলার সিভিল সার্জন ডা. হাসিনা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ওষুধের বিনিময়ে রোগীদের কাছ থেকে টাকা রাখার কোনো নিয়ম নেই। তবে রোগীরা যদি অভিযোগ করেন তাহলে সেটি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া যদি কোনো সিএইচসিপি বা স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী ঠিকমতো ক্লিনিকে না যান তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে ক্লিনিকগুলোতে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান তিনি।এমএএস/এমএম

Advertisement