শিরোনামটাই কেমন যেন বিদঘুঁটে তাই না? একজন ফুটবলার খেলতে নেমে যদি কার্ড দেখেন তাহলে কতভাবেই না হতাশা প্রকাশ করেন। রেফারির সিদ্ধান্ত সঠিক হলে একরকম, বেঠিক হলে আরেকরকম। ফিফটি-ফিফটি হলে আবার অন্যরকম। লাল বা হলুদ যে রঙেরই হোক- কার্ড পাওয়া ফুটবলারদের প্রতিক্রিয়াগুলো কোলাজ ক্যামেরায় দেখা যায় নানা ভাবে।
Advertisement
এই কার্ড না দেখলে কেউ অতৃপ্ত হন, যা অদ্ভুত এক খবর! এমন ফুটবলারও ছিলেন এবং তিনি বাংলাদেশের। নাম এনামুল হক শরীফ। এক যুগেরও বেশি সময় আগে শরীফের নামের আগে ‘এনামুল হক’ এর জায়গায় যোগ হয়েছে ‘টাইগার।’ বাংলাদেশের ফুটবলে তার পরিচিতি বেশি ‘টাইগার শরীফ’ হিসেবে।
তারকাখ্যাতি পাননি। কিন্তু ১৯ বছরের ফুটবল ক্যারিয়ারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপাধি যোগ হয়েছে তার নামের আগে। যেমন- দ্য রক, গন্ডার, গাত্তুসো, বুলডেজার এবং কোবরা। ২০০৭ সালে পেশাদার ফুটবলে মোহামেডান-আবাহনীর প্রথম সাক্ষাতে এনামুল হক শরীফ সাদা-কালো সমর্থকদের কাছ থেকে পান ‘টাইগার শরীফ’ উপাধি। এখন ‘টাইগার শরীফ’ বললেই সবাই বুঝে যান তিনি কে। ১৯ বছরের ক্যারিয়ারে ১০ বছরই খেলেছেন সাদা-কালো জার্সিতে। মোহামেডানের জার্সিতে ১২৭টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। তার আগে শেখ রাসেলে এবং সবশেষ শেখ জামালে।
এনামুল হক শরীফ কিভাবে ‘টাইগার শরীফ’ হলেন সে গল্পটা শোনা যাক মাঝমাঠের এই লড়াকু ফুটবলারের কাছ থেকেই, ‘২০০৭ সালে প্রথম পেশাদার লিগে আমি ছিলাম মোহামেডানে। আবাহনীর বিরুদ্ধে প্রথম লড়াইয়ে একাদশে ছিলাম না। আমরা ২-০ গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় ৭০ মিনিটের সময় আমাকে মাঠে নামানো হয়। তখন আরিফ খান জয় দাপটের সঙ্গে খেলছিলেন ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক ফুটবল। মাঠে নামার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই হলুদ কার্ড দেখেছিলাম। আরিফ খান জয়ের মাথার উপর দিয়ে বল নিতে গিয়ে ওর মাথায়ই হাঁটু লাগিয়ে দেই। রেফারি হলুদ কার্ড দেখান। সমর্থকরা তো মহা খুশি। খুশির ঠেলায় গালি দিয়ে সমর্থকরা বললেন, ‘.....পোলা তো বাঘের বাচ্চা। জয়ের মাথায় হাঁটু মেরে দিলো, কলিজা আছে। ও আমাদের টাইগার। ঐ ম্যাচে আর গোল হয়নি।’
Advertisement
ব্যস! সেদিন থেকে মোহামেডান সমর্থকরা তাকে বলতো ‘টাইগার শরীফ’। নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারের গল্প বলতে গিয়ে এনামুল হক শরীফ বলেন, ‘১৯ বছরে কতগুলো কার্ড খেয়েছি তার হিসেব নেই। ফেডারেশনে খোঁজ নিলে জানা যাবে। মনে হয় না বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে আমার চেয়ে বেশি কার্ড কেউ দেখেছেন। তিন ম্যাচ পরই আমি সাসপেন্ড থাকতাম। তবে সরাসরি লাল কার্ড বেশি দেখিনি। তিনটি লাল কার্ড পেয়েছি। তাও দুই হলুদ কার্ডে।’
কার্ড দেখলে তো খেলোয়াড়রা অনুতপ্ত হন। আপনি দেখছি কার্ড দেখার গল্পটা গৌরবের সঙ্গে বলছেন। কেন? ‘আসলে মাঠে কার্ড না দেখলে মনে হতো কি যেন পাইনি, কোথায় একটা অপূর্ণতা, অতৃপ্তি রয়ে গেছে। আরেকটা কথা আফ্রিকান ফুটবলার আমার সামনে আসলে আমার যেন মাথা গরম হয়ে যেতো। ইচ্ছে করেও প্রচুর কার্ড দেখেছি। বিশেষ করে তৃতীয় ম্যাচের কার্ড। পরের ম্যাচ কোন দলের বিপক্ষে সেটা হিসেব করে কার্ড দেখতাম’- বলছিলেন জাতীয় দলের সাবেক এ মিডফিল্ডার।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফুটবল ও ক্রিকেট দুই বিভাগেই পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কুমিল্লা সদর উপজেলার বাজঘুড়দা গ্রামের এনামুল হক শরীফ। ফুটবলে ভর্তি হয়ে তিন মাস পর বাড়িতে ফিরে আর যাননি বিকেএসপিতে। এলাকাতেই খেলতে থাকেন। সেখান থেকে চলে আসেন ঢাকার ফুটবলে।
মাদারটেকের হয়ে পাইওনিয়ার লিগে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলে ১৭ গোল করেন। তারপর কদমতলা একাদশের হয়ে তৃতীয় বিভাগে, তবে দ্বিতীয় বিভাগে খেলেননি। এলাকার বড় ভাই সৈয়দ গোলাম জিলানী তাকে নিয়ে আসেন প্রথম বিভাগের দল ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে।
Advertisement
৩৯ বছরের এনামুল হক শরীফ এখন কোচিং পেশায় যোগ দিয়েছেন। চলমান ‘সি’ লাইসেন্স কোর্স করছেন। সেই সঙ্গে কাজ করছেন নিজ উপজেলার বিবির বাজার ফুটবল একাডেমিতে। কুমিল্লা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার পূর্বে বিবির বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে বিভিন্ন গ্রুপের ৮০ জন ফুটবলার নিয়ে এনামুল হক শরীফের একাডেমি।
ঐ একাডেমি থেকে এক কিলোমিটারের মতো দুরে বাড়ীয় এনামুল শরীফ ও সৈয়দ গোলাম জিলানীদের। জাতীয় দলের সাবেক গোলরক্ষক নিজাম মজুমদার, ফজলে রাব্বি এবং বর্তমান জাতীয় দলের আরিফুর রহমানরা ঐ স্কুল মাঠে খেলেই ফুটবলার হয়েছেন।
নিজের ভবিষ্যত লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করে এনামুল হক শরীফ বলেন, ‘আমি ফুটবল থেকে অবসর নেয়ার পরই একাডেমিতে ফুল টাইম কাজ শুরু করি। একাডেমির খেলোয়াড়দের কাছ থেকে কোনো পারিশ্রমিক নেই না। এলাকার ছেলেদের মাদকের নেশা ও বিভিন্ন ধরনের অপরাধ থেকে ফিরিয়ে ফুটবলে নিয়ে আসাই আমার লক্ষ্য।’
ব্যারিস্টার সুমন একাডেমি শরীফকে শুভেচ্ছাদূত বানিয়েছে। সেখানে কিছু বল দিয়েছেন শরীফ। ২৪টি একাডেমিতে ১০টি করে বল দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কোচিং লাইসেন্স শুরু করছেন ভবিষ্যতে দেশের বড় কোনো ক্লাবের একাডেমিতে কাজ করার ইচ্ছে নিয়ে।
আরআই/এসএএস/এমএস