বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র অস্ট্রেলিয়া। এই কারণে হোক বা অন্য যে কারণেই হোক মার্কিন নীতির সঙ্গে বেশ মিল আছে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট নীতির। সাদ্দাম হোসেনের হাতে রাসায়নিক অস্ত্র আছে- এই অজুহাতে ইরাকে আগ্রাসন চালান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। পরবর্তীতে ইরাকে রাসায়নিক অস্ত্রের কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি মার্কিনিরা। কিন্তু ততদিনে যা হবার হয়ে গেছে। মার্কিন আগ্রাসনে শিশু- নারীসহ মারা গেছে ইরাকের হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। পুরো দেশটা দাঁড়িয়ে ধ্বংসস্তুপের শেষ প্রান্তে। একইভাবে কোনো যাচাই বাছাইয়ের তোয়াক্কা না করে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশে ক্রিকেট সফর বাতিল করেছে অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপ বাছাইয়ের জন্য ফুটবলেও বাংলাদেশ সফর বাতিলের জন্য দৌড়ঝাপ কম করেনি তারা। কিন্তু সুবিধা করতে না পেরে এখন আবার বাংলাদেশে ফুটবল টিম পাঠানোর সম্মতি দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া।স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে বাংলাদেশ সফরে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা অনিরাপদ হলে অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলাররা কিভাবে নিরাপদ? বিপরীতক্রমে অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলাদের নিরাপত্তা ঝুঁকি না থাকলে তাদের ক্রিকেটাররা এখানে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে, এটা কিভাবে সম্ভব? এটাকে কি বলা যায়? কৌতুক! রসিকতা!ফুটবল সফর স্থগিতের চেষ্টার কোনো কমতি নাই অস্ট্রেলিয়ার। বাংলাদেশের ম্যাচটি যাতে কোনো নিরপেক্ষ দেশে অনুষ্ঠিত হয় এর জন্য এফসিতে এখনো দৌড়ঝাপ করে যাচ্ছে এফএফএ (অস্ট্রেলিয়া ফুটবল ফেডারেশন)। এত কিছু করলেও একটা ছোট বিষয়ের দিকে নজর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি তারা। আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আয়োজনে বাংলাদেশের সামর্থ্যকে রীতিমত অগ্রাহ্য করেছে দেশটি। সাম্প্রতিক সময়ে বিরামহীনভাবে আন্তর্জাতিক খেলাধুলার মেলা বসছে বাংলাদেশে। সম্প্রতি শেষ হয়েছে এশিয়া অনূর্ধ-১৯ বিশ্বকাপ বাছাই। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই আসরে স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও খেলেছে উজবেকিস্তান, ভুটান ও শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশ সফর করে গেছে পশ্চিম বাংলা অনূর্ধ-১৭ ক্রিকেট দল। দক্ষিণ এশিয়ার সেরা আট ক্লাব নিয়ে শেখ কামাল গোল্ড কাপ ট্রফির আসর প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই টুর্নামেন্টে কলকাতা তথা ভারতীয় ফুটবলের দুই কুলীন দল ইস্ট বেঙ্গল ও মোহামেডান ছাড়াও খেলছে পাকিস্তান, আফগান্তিান ও শ্রীলঙ্কার তিন লিগ বিজয়ী ফুটবল ক্লাব। বাংলাদেশে আয়োজিত এইসব টুর্নামেন্টগুলোতে মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে সামান্যতম কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটেনি। এদিকে বিপিএলের তৃতীয় আসরকে ঘিরে গোটা ক্রিকেট দুনিয়াতে সাজ সাজ রব। ক্রিকেট বিশ্বের সব প্রতিষ্ঠিত দলের বড় বড় তারকারা চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন ফ্রাঞ্চাইজগুলোর সঙ্গে। টি২০ ক্রিকেটের আইকন ক্রিস গেইল, রান মেশিন কুমার সাঙ্গাকারা, দক্ষিণ আফ্রিকার রবিন পিটারসন, ইংলিশ অলরাউন্ডার ক্রিস জর্ডানের মত ক্রিকেটাররা ছাড়াও বিপিএলে খেলার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার ব্র্যাড হজও। মোদ্দা কথা বিশ্ব সেরা ক্রীড়াবিদদের কাছে শান্তি ও স্বস্তির জায়গা বাংলাদেশ। স্বভাবতই বাংলাদেশ থেকে ফুটবল ম্যাচ সরিয়ে নিরপেক্ষ কোনো দেশে নেয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়ার যে দাবি তা ধোপে টিকছে না।খুব নাটকীয় কোনো পরিস্থিতি তৈরি না হলে আগামী ১৪ নভেম্বর ঢাকায় এসে পৌঁছানোর কথা সকারু তথা অস্ট্রেলিয়া ফুটবল দলের। অনেকটা নিরুপায় হয়েই বাংলাদেশ সফরে সম্মতি দিতে হয়েছে তাদেরকে। অন্তত ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপ ক্রিকেটের দিকে তাকালে এটা আমরা বলতেই পারি। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপ ক্রিকেটে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ বর্জন করেছিল অস্ট্রেলিয়া। ওই আসরে নক আউট পর্বে খেলেছিল আটটি দল। যার অর্থ হচ্ছে, গ্রুপ পর্বে গোটা তিনেক ম্যাচ হারলেও কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নেয়াটা কঠিন কিছু ছিল না প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর জন্য । তাই লঙ্কায় ম্যাচ বর্জনের পথে হেঁটেছিল দলটি। কিন্তু এবারে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে সকারুরা। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে জর্ডানের কাছে হেরেছে তারা। অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে ৪ পয়েন্ট বেশি নিয়ে গ্রুপ পর্বে শীর্ষস্থানে আছে দলটি। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে ওয়াক ওভার দিলে সকারুদের বিশ্বকাপ মূলপর্বে খেলার আশা এক রকম শেষই হয়ে যাবে। যদি দ্বিতীয় সেরা দলের চেয়ে ৪ পয়েন্ট বেশি নিয়ে গ্রুপ পর্বের শীর্ষে থাকত তাহলে বাংলাদেশ সফর যে সকারুরা বর্জন করত তা বলাই বাহুল্য। এখান থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, বাস্তবতার চাপে পড়ে ফুটবলে তাদের সেই মহার্ঘ নিরাপত্তা কার্ডটা খেলার দুঃসাহস দেখাতে পারছে না অস্ট্রেলিয়া।বাংলাদেশ সফর বাতিল করা নিয়ে খোদ নিজের দেশেই সমালোচিত অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট। একই ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ না হয়ে ভারত হলে, এই সফর অস্ট্রেলিয়া বাতিল করতে পারত না- এমন কথা বলেছেন কিংবদন্তীর অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেল। হারের ভয়ে নিরপত্তাকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করে বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছে অস্ট্রেলিয়া, এই অভিমত সে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে বিবেচিত ডিন জোন্স-এর। চ্যাপেলের কথার মর্মার্থ করলে দাঁড়ায়, নিরাপত্তা শুধু অজুহাত, টাকা ও প্রভাবই ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় সত্যি। জোন্সের কথা অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের যে নিন্মগামী দশা তাতে ইনফর্ম বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের পেরে ওঠাটা কঠিন।সাম্প্রতিক সময়ে, দুর্দান্ত খেলছে বাংলাদেশ। ঘরের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েছে টাইগাররা। তারপরও বাংলাদেশের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়াকেই ফেভারিট মানে এদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া পরাশক্তি এই শ্রদ্ধার জায়গাটিতে ১৬ কোটি মানুষের কোনো সংশয় নাই। আর তাই আক্ষেপটাও বেশি। বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টাইগাররা কতখানি পাল্লা দিতে পারে এটাকেই বড় করে দেখেছে এদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলাটাকেই অনেক বড় গৌরবের বলে মনে করে বাংলাদেশের মানুষ।রাসায়নিক অস্ত্রের সন্ধান করতে গিয়ে মার্কিন আগ্রাসনের কারণে ইরাকে মারা গেছে হাজারো মানুষ। পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে কত মানুষকে তার কোনো হিসাব নাই। অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা কার্ড খেলার কারণে বাংলাদেশে সরাসরি মানুষ হত কিংবা আহত হয়নি এটা সত্য। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের স্বপ্ন তথা ক্রীড়া আয়োজনে বাংলাদেশের যে সুনাম তাকে হত্যা করার দায় কিভাবে এড়াবে অস্ট্রেলিয়া। দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফর বাতিল করতে পারে, অতি বড় বাংলাদেশবিরোধীর পক্ষেও সম্ভব ছিল না এমনটা ভাবা। এভাবেই অস্ট্রেলিয়ার নির্মম রসিকতার খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।এইচআর/আরআইপি
Advertisement