ড. মো. হাসিনুর রহমান খান
Advertisement
জনস্বাস্থ্যের অগ্রদূত, আধুনিক নার্সিং এর প্রবক্তা, সমাজ সংস্কারক ও সেবক, পরিসংখ্যানবিদ, নারী জাগরণের পথিকৃৎ, প্রসিদ্ধ উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপক সহ যেসব বিশেষণেই ডাকা হোক না কেন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল ছিলেন এ সবের অধিকাংশের চ্যাম্পিয়ন। চ্যাম্পিয়ন না হয়েও বর্তমান কালে উপরোক্ত গুণাবলী সমৃদ্ধ কোন মানুষ আছে এমনটির খোঁজ আমার জানা নেই । খোদ কারো কাছে নেই এটা প্রায় নিশ্চিত ভাবে বলা যায় এমনকি একক গুণাবলীর অধিকারী চ্যাম্পিয়নও কেউ আছে, সেটা খুঁজে বের করতেও অনেক বেগ পেতে হবে | তিনি এসব গুণাবলী নিকট অতীতে অর্জন করেছেন এমনটি নয় |
আজ থেকে দুইশত বছর আগে ১৮২০ সালের ১২ মে মহীয়সী এই নারীর জন্ম হয়েছিল ফ্রান্সের ফ্লোরেন্স শহরে | ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এর অসামান্য অবদানের জন্য এই দিনটি তাই বিশ্ব নার্সেস দিবস হিসেবে পরিচিত| পরের বছর নাইটিংগেল এর পরিবারকে চলে আসতে হয় ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারে নিজেদের বাড়িতে| তিনি ৯০ বছরেরও বেশি সময় বেঁচে ছিলেন এবং মধ্য বয়সের আগেই এই সব কীর্তি অর্জন করতে পেরেছিলেন | অবশেষে ১৯১০ সালের ১২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন ইংল্যান্ড | ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এর কারণেই আজ সবচেয়ে শৃঙ্খলিত ও সম্মানিত পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নার্সিং পেশা | এটি স্বীকার করেন সবাই এবং গভীরভাবে বিশ্বাস করেন সেবিকা পেশায় নিয়োজিত সকলেই| ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল সেবিকা হিসেবে নিজের পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন নির্দ্বিধায়| অথচ আর্থিক ও সামাজিক ভাবে অনেক উন্নত এক প্রভাবশালী ও সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশ পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল| যেখান থেকে এই পেশায় আসা একেবারেই অসম্ভব ছিল| ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন চরম মানব দরদী বা লোকহিতৈষী| বাবার জমিদারি এলাকার গরিব দুঃখী ও অসুস্থ মানুষদের সেবায় এগিয়ে আসতেন সবসময়|
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানব সেবার পরম হিতকর কাজে বেশি বেশি করে জড়িয়ে পড়েছিলেন| তাইতো ১৬ বছর বয়সেই বাবা-মাকে বলতে পেরেছিলেন যে তিনি একজন সেবিকা হতে চান| বাবা মা মোটেও রাজি ছিলেন না তাতে এবং তাকে সেবিকা হতে বিরত রাখার সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন| এমনকি ১৭ বছর বয়সে বিয়ে দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন| কেননা সেই সময় রানী ভিক্টোরিয়ার যুগে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এর বাবার পরিবারের মর্যাদা যে স্তরে ছিল সে অনুযায়ী বাবা হিসেবে মেয়েকে একজন উপযুক্ত বরের সাথে বিয়ে দেওয়াই ছিল সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য উত্তম কাজ! পিতা মাতার চরম বাধা উপেক্ষা করে অবশেষে ২৪ বছর বয়সে জার্মানিতে নার্সিং এর একজন ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হন|
Advertisement
জার্মানিতে নার্সিং এর ওপর পড়াশোনা শেষ করে ১৯৫০ সালে লন্ডনে ফিরেই মিডলসেক্স হাসপাতালে সেবিকার চাকুরি নেন ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল| কাজের প্রতি প্রগাঢ় নিষ্ঠা ও দক্ষতার জন্য ঠিক পরের বছরেই সুপারিনডেন্ট পদে উন্নীত হন| সেই সময়ে কলেরা মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে নিজের মেধা, শ্রম, দক্ষতা ও সেবা দিয়ে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এর জন্য তা মোকাবেলার একটা দারুণ সুযোগ তৈরি হয়| স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রণয়ন ও এর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে হাসপাতালের মৃত্যুহার ব্যাপক ভাবে কমিয়ে আনতে সক্ষম হন| জনস্বাস্থ্যের বিষয়গুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এই কলেরা মহামারী মোকাবিলার অভিজ্ঞতা তাকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে| বিশেষ করে, ১৯৫৩সালে ক্রাইমিন যুদ্ধে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তার যে অবদান তা তার জীবনে অর্জিত সকল অবদান গুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে ধরা হয়| তার এই অবদান পরবর্তীতে জনস্বাস্থ্যের মৌলিক ভিত্তির কাঠামোকে তৈরি করে|
তুর্কি অটোম্যান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ফরাসিদের সাথে রাশিয়া সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ক্রাইমিন যুদ্ধ শুরু করে১৮৫৩ সালে| হাজার হাজার ব্রিটিশ সেনাকে সেখানে প্রেরণ করা হয়| যুদ্ধাহত হাজার হাজার সেনা যখন তুরস্কের সেলিমিয়ে ব্যারাকে ওষুধপত্রের অভাব, স্বাস্থ্যবিধির অজ্ঞতা, উচ্চ সংক্রমণের ঝুঁকি, পর্যাপ্ত স্যানিটারি ব্যবস্থার অভাব, রোগীর খাদ্য তৈরির সরঞ্জাম এর অভাব, ত্রুটিযুক্ত সুয়ারেজ ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেসন এর অভাব সহ নানা বিষয়ে যখন এক ভয়ংকর দুর্দশাগ্রস্ত সময় পার করছিল তখনই ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে ইংল্যান্ড থেকে সেখানে পাঠানো হয়| সঙ্গে পাঠানো হয় আরো ৩৮ জন স্বেচ্ছাসেবীকে, যাদের প্রত্যেককেই প্রশিক্ষণ দিয়ে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল তৈরি করেন একেকজন সেবিকা হিসেবে|
ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল প্রথমেই উপরোক্ত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য সম্ভাব্য উপায় গুলো উল্লেখপূর্বক দ্রুত পদক্ষেপ নিতে ব্রিটিশ সরকারকে আহ্বান জানান| এর মাধ্যমে একজন দক্ষ ব্যবস্থাপক হিসেবে তার প্রমাণ মিলে| প্রথমেই শত শত মেঝে ঘষার ব্রাশ কেনেন এবং তুলনামূলক সবল রোগীদেরকে তাদের থাকার জায়গার মেঝে হতে ছাদ পর্যন্ত পরিষ্কার করতে বলেন| যুদ্ধাহত সেনাদেরকে সেবা দিয়ে সুস্থ করার জন্য দিনরাত অনবরত পরিশ্রম করতে থাকেন ফ্লোরেন্স নাইটেংগেল ও তার টিম| এমনকি প্রতি রাতে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়তেন এবং চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসত, তখন ফ্লোরেন্স নাইটেংগেল বাতি হাতে নিয়ে একাই সব মুমূর্ষু রোগীদের দেখভাল করে আসতেন| তার এই মহানুভবতার জন্য তাকে পরবর্তীতে “দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প” নামে ডাকা হয়|
এভাবে শুরুর কয়েক মাসের মধ্যে সেনাদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা গিয়ে পৌঁছায় প্রায় ৪০৭৭| ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল লক্ষ্য করেন প্রকৃত যুদ্ধের কারণে যে কয় জন সেনা মৃত্যুবরণ করেন তার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি সেনা মৃত্যুবরণ করেন উপরোক্ত কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগবালাই জন্য যেমন, টাইফয়েড, কলেরা, ডিসেন্ট্রি বা টাইফস| এরইমধ্যে তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ব্রিটিশ সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে| স্যানিটাইজেশন, হাত ধোয়া, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, আলাদা কিচেনের ও লন্ড্রির ব্যবস্থাসহ সকল স্বাস্থ্যবিধি ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করেন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল| ফলশ্রুতিতে কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যুর হার দুই-তৃতীয়াংশে নেমে আসে| যেটিকে এক ধরনের চিত্রের মাধ্যমে সহজে তুলে ধরেন, যা ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল রোজ ডায়াগ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে| সেই সময় ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এর এই ধরনের মৌলিক ও সঠিক চিত্রের মাধ্যমে তথ্যকে চাক্ষুষভাবে উপস্থাপন করার যোগ্যতা আজও সব পরিসংখ্যানবিদদেরকে বিস্মিত করে তুলে|
Advertisement
শুধু ক্রাইমিন যুদ্ধের ক্ষেত্রে নয়, পরবর্তীতে একই পদ্ধতিতে তৎকালীন ভারতবর্ষের ব্রিটিশ সেনাদের মধ্যে মহামারির কারণে ঘটিত মৃত্যুকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে নিয়ে আসেন| এভাবেই তিনি জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য সেবার উপায়, ব্যবস্থাপনার মৌলিক ভিত্তি রচনা করেন যা উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য রক্ষায় অন্যতম ভূমিকা পালন করে| দেড় বছর পর ব্রিটেনে ফিরলে তৎকালীন বৃটেনের রানী ভিক্টোরিয়া ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলকে ক্রাইমিন যুদ্ধে তার মহতি অবদানের জন্য আড়াই লক্ষ পাউন্ড পুরস্কার দেন| সেই অর্থ দিয়ে ১৮৬০ সালে নাইটেঙ্গেল লন্ডনে সেন্ট থমাস হসপিটাল ও সেবিকাদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেন| এভাবে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল পরিণত হন সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ও এক জীবন্ত মানবতাবাদী ও মহীয়সী কিংবদন্তি হিসেবে|
আমাদের দেশেও অসংখ্য ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীরা নিবেদিত প্রাণ হয়ে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এর মত কোভিট আক্রান্তদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, প্রাণ রক্ষা করছেন| নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে হলেও অনেকে তা করছেন| ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের মত আর্থিকভাবে পুরস্কৃত না হলেও কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পাচ্ছেন এই নির্ভীক সৈনিকেরা| এই পরম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার যে মুদ্রা তার অপর পিঠের চ্যাম্পিয়ন চরিত্রে অভিনয় কারীর সংখ্যাও নেহাত কম নয় আমাদের সমাজে| অমুক তমুকদের নির্লজ্জ কর্মকাণ্ডে জাতি হিসাবে আমাদের লজ্জা নিবারণের আজ কোন জায়গা নেই| এই দুর্যোগ ও সংকটকালীন সময়েও সুযোগসন্ধানী, দুর্বৃত্ত পরায়ণ, বাটপার, ভণ্ড স্বাস্থ্য সেবক, মানবিক মূল্যবোধের ঘাতকদের কর্মকাণ্ড থেমে নেই, ক্ষেত্রবিশেষে তা অনেক বেড়েছে| ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এর মত চরিত্রগুলি তাদেরকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, পৃষ্ঠপোষকেরা তাদের কর্মকাণ্ডে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে| তাই সময় এসেছে যারা আশেপাশে এখনো বিরাজ করছে এমন পৃষ্টপোষকসহ অমুক-তমুকদের মুখোশ উম্মোচন করা এবং যথাযথ বিচারের ব্যবস্থা করা|
ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এর গৃহীত জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য সেবার উপায়, ব্যবস্থাপনার মৌলিক উপাদানগুলোকে ঠিক রেখে রাষ্ট্রকে আরো আগ্রাসী হতে হবে করোনা দ্রুত মোকাবেলার ক্ষেত্রে| ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল যেমন সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারী হয়েও অন্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীদের বিশেষ করে যারা চাকচিক্যময় জীবন যাপন করতেন, তাদের দিকে চোখ তুলে তাকাতেন না, তার সদা দৃষ্টি থাকতো গরিব দুঃখী অসুস্থ মানুষের সেবায়| তার স্থির লক্ষ, দৃঢ়চিত্ত ও নিষ্ঠা যেভাবে তাকে সাফল্যমন্ডিত করেছে, একই রকম ভাবে আমাদের দেশে করোনা মহামারি মোকাবেলায় ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন স্তরে যারা রয়েছেন তারাসহ সরকারের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় বেশি বেশি জনহিতৈষী ও জনবান্ধবমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে |
প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক নেতৃত্ব, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, কর্ম সম্পাদনে দক্ষতা, আদর্শ সমন্বয়ের ব্যবস্থা, বৈজ্ঞানিক উপায়ে সমস্যা সমাধানের পন্থা, প্রযুক্তি ও ডিজিটালাইজেশনের সুবিধা, সঠিক তথ্য সংরক্ষণ ও যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থা নিতে হবে| সর্বোপরি এসব ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তের দুর্বৃত্তপনা ও তাদের অনুঘটকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে হবে| কেবলমাত্র তাহলেই আশা করা যায় বাংলাদেশ করোনা মোকাবেলায় বিশ্বসমাজে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে|
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান, আই এস আর টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এমকেএইচ