ব্যক্তিগত উদ্যোগে পিছিয়ে পড়া শিশুদের পড়াশোনায় কাজ করছে একদল আলোকিত তরুণ। আর এই তরুণদের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় ‘আলোর বিদ্যানিকেতন’। বরগুনার আমতলী উপজেলার পায়রা নদী সংলগ্ন গরুর বাজার মাঠের পরিত্যক্ত ছাউনিঘরে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টিতে করোনাকালীন অবসরে শিক্ষার আলো বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে উদীয়মান তরুণরা। বিস্তারিত জানাচ্ছেন আবদুর রহমান সালেহ-
Advertisement
যেভাবে প্রতিষ্ঠা পেলো: করোনাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, পরবর্তীতে টেলিভিশন এবং সরকারের এটুআই ভিত্তিক বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে পাঠদান চলমান থাকলেও অ্যান্ড্রয়েড এবং ল্যাপটপ ডিভাইস না থাকায় পিছিয়ে পড়া শিশুরা সরকারের অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হতে পারছিল না। প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে আমতলীর উদীয়মান তরুণ ও সামাজিক সংগঠন আর্থকেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা জোসেফ মাহতাবের উদ্যোগে জুনের প্রথম সপ্তাহে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আলোর বিদ্যানিকেতন’ নামের বিদ্যালয়টি। শুরুটা পরিত্যক্ত ছাউনিতে বসে হলেও বর্তমানে স্থানীয়দের সহযোগিতায় একটি বাড়িতে বসে চলছে এ শিক্ষা কার্যক্রম। ব্যক্তি উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে জোসেফ মাহতাবের সাথে যুক্ত হয়েছেন ইমরান, মুক্তা, পূজাসহ কয়েকজন কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছোট্ট পরিসরে বিশজনের মত শিক্ষার্থী নিয়ে এ কার্যক্রম চললেও উদ্যোক্তাদের ভাবনা রয়েছে ধীরে ধীরে পরিসর বাড়ানোর।
পাঠদান পদ্ধতি: সপ্তাহের শুক্র-শনিবার বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সাধারণ জ্ঞান ও নৈতিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর ধারণা দেওয়া হয়। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি লেখালেখিতে উৎসাহ করা, উপস্থিত বক্তৃতার প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা থাকছে এ বিদ্যালয়ে। এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা জোসেফ মাহতাব বলেন, ‘পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরাও যাতে অন্যান্য স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীর মত শিখতে পারে। আমরা চেষ্টা করছি এমন লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার। সবার আন্তরিক সহযোগিতায় আমরা উৎসাহিত। আমাদের সর্বোচ্চ ইচ্ছে রয়েছে ভিন্নধর্মী এ প্রতিষ্ঠানকে নিকট ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত করার। আমরা এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেখিয়ে দিতে চাই, পিছিয়ে পড়া এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (অটিজম) শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে গাইডলাইন দিতে পারলে তারাও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া: বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী ওমর ইসলাম। মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার সুযোগবঞ্চিত শিশুটিকে নিয়ে সীমাহীন উদ্বেগ অভিভাবকদের। যখন-তখন কান্না জুড়ে দেওয়া এবং অস্বাভাবিক আচরণ করায় সহপাঠীসহ শিক্ষকদেরও অনাগ্রহ তাকে নিয়ে। যে কারণে ওমরকে নিয়ে অন্তহীন দুশ্চিন্তায় ওমরের পরিবার। আলোর বিদ্যানিকেতনের সদস্যরা যখন ওমর ইসলামের মত শিক্ষার্থীকে খুঁজে খুঁজে পাঠদানের উদ্যোগের বিষয়ে জানান; তখন কান্নাজড়িত কণ্ঠে ওমর ইসলামের মা জেসমিন আক্তার বলেন, ‘আমার পোলাডারে নিয়া অনেক চিন্তায় আছিলাম। আপনাগো লাইগ্যা অনেক দোয়া করি। অনেক চেষ্টা করতেছেন আপনারা এইসব পোলাপানগুলারে নিয়া।’ ওমর ইসলামের মা জেসমিন আক্তারের মত অন্যান্য বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর অভিভাবকরাও জানিয়েছেন স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি। প্রতিষ্ঠানটি যেন দীর্ঘমেয়াদে চলমান থাকে, বারবার এমন আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
Advertisement
ভবিষ্যৎ ভাবনা: শুরুতে অনেকটা শখের বশে শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে অনেকটাই আপন করে নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত সবাই। শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে পেরে আগ্রহ নিয়ে নিজের অনুভূতি জানান কলেজপড়ুয়া এবং প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক আল ইমরান। ইমরানের ভাষায়, ‘শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানোর মাঝে অন্যরকম আনন্দ পাওয়া যায়। যে অভিজ্ঞতা পূর্বে না থাকায় বর্তমানে খুবই উৎসাহিত হচ্ছি। শিক্ষার্থীদের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখতে পেরে অনেকটাই ভালো সময়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছি। অন্তত করোনাকালীন অবসরে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের কিছুটা হলেও পাঠদান করাতে পেরেছি, এ অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করবো এসব শিক্ষার্থী নিয়ে কাজ করার এবং এ প্রতিষ্ঠান যাতে দীর্ঘমেয়াদে পাঠদান চালু রাখতে পারে, সে লক্ষ্যেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’ ইমরানের মত দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখার প্রত্যয় অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সবার।
আলোর বিদ্যানিকেতন দীর্ঘমেয়াদে আলো ছড়াবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে। তারাও অবদান রাখবে মূলধারার শিক্ষার্থীদের মত করেই- এমন প্রত্যাশা সব শ্রেণিপেশার মানুষের।
এসইউ/এএ/এমকেএইচ
Advertisement