গভীর আর্থিক সঙ্কটে পড়া নাভানা গ্রুপ যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারে সেজন্য এটিকে সুরক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি মন্দঋণের ভারে বন্ধ হতে থাকা গ্রুপটির ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালু রাখতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা চলতি মূলধন ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
Advertisement
পাশাপাশি নাভানা গ্রুপের আর্থিক সঙ্কট বিশেষ করে করোনায় অর্থনৈতিক অভিঘাত বিবেচনায় এনে অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সুদসহ ঋণসমূহ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, রূপালী ও জনতা ব্যাংক কর্তৃক অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা প্রদানের জন্য বলা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।
নাভানা গ্রুপকে সরকার ঘোষিত কোভিড-১৯ জনিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় চারটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক কর্তৃক চলতি মূলধন ঋণ সহায়তা প্রদান এবং নাভানা গ্রুপের বিদ্যমান অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) ঋণসমূহ অধিগ্রহণের উপায় নির্ধারণে সম্প্রতি জরুরি বৈঠক করে অর্থ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ বি এম রুহুল আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠকের কার্যপত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
সভায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম-সচিব মৃত্যুঞ্জয় সাহা, উপ-সচিব মোহাম্মদ আবদুল আওয়াল, চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনজন নির্বাহী পরিচালক এবং নাভানা গ্রুপের সিনিয়র ব্যবস্থাপক মোস্তফা জাহিদ আহমেদ ছাড়াও দু’জন পরিচালক অংশ নেন।
Advertisement
সভায় বিস্তারিত আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়, নাভানা গ্রুপের প্রস্তাবিত এক হাজার ২০০ কোটি টাকার চলতি মূলধন ঋণের মধ্যে বর্তমানে ব্যবসা পরিচালনার জন্য করপোরেট ও ব্যক্তিগত গ্যারান্টি প্রদানসাপেক্ষে জরুরিভিত্তিতে ৫০০ কোটি টাকা (৪০০ কোটি টাকা ফান্ডেড ও ১০০ কোটি টাকা নন-ফান্ডেড) প্রদান করা হবে। বাকি চলতি মূলধন ৭০০ কোটি টাকা দেয়ার আগে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার বিপরীতে বেসরকারি ব্যাংকে বন্ধকীকৃত সম্পত্তির ওপর প্যারি-প্যাসু চার্জ সৃষ্টি করতে হবে। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর পরিচালনাপর্ষদের সভা থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
এছাড়া সভায় সিদ্ধান্ত হয়, নাভানা গ্রুপের আর্থিক সঙ্কট বিবেচনায় এনে অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সুদসহ ঋণসমূহ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, রূপালী ও জনতা ব্যাংক কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে জানাতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম-সচিব মৃত্যুঞ্জয় সাহা জাগো নিউজকে বলেন, নাভানাকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা চলতি মূলধন ঋণের বিষয়ে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আইন কাঠামোর মধ্যে কী করা যায়, তা করতে বলা হয়েছে। এখনও বিষয়টি প্রসেসের মধ্যে রয়েছে।
অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সুদসহ ঋণসমূহ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংক কর্তৃক অধিগ্রহণ করা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আবু ফারাহ মো. নাসের জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খারাপ। তাই তাদের ঋণ যদি কেউ অধিগ্রহণ করতে চায় তাহলে এসব প্রতিষ্ঠান খুশি হবে। এক্ষেত্রে নতুন কোনো নীতিসহায়তার প্রয়োজন পড়বে না। তারপরও যদি আইনগত কোনো সমস্যা থাকে সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক দেখবে।
Advertisement
এদিকে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ বি এম রুহুল আজাদ বলেন, নাভানা গ্রুপ ২০১৮ সালে তাদের আর্থিক সঙ্কট সমাধানের লক্ষ্যে সকল দায়দেনাসমূহ চারটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক কর্তৃক অধিগ্রহণ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য নতুন করে চলতি মূলধন গ্রহণের প্রস্তাব দেয়। এ প্রস্তাবনা অনুযায়ী আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ হতে অগ্রণী ব্যাংককে লিড ব্যাংক মনোনীত করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। পরে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংক নাভানা গ্রুপের প্রস্তাবনা বিশদভাবে পর্যালোচনা করে এবং একাধিক সভার ভিত্তিতে একটি পরিকল্পনা দাখিল করে।
তিনি বলেন, ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিসহ বিস্তারিত আলোচনা হয়। পরে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের কারণে নাভানা গ্রুপের আর্থিক সঙ্কট আরও তীব্র আকার ধারণ করে। এ সঙ্কট হতে ঐতিহ্যবাহী ও স্বনামধন্য নাভানা গ্রুপকে রক্ষায় সহায়তা প্রদানের জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
এর প্রেক্ষাপট বর্ণনায় নাভানা গ্রুপের পক্ষ হতে পরিচালক মো. আনসার আলী খান সভাকে জানান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং তৎপরবর্তীকালে ইসলাম গ্রুপের ধারাবাহিকতায় নাভানা গ্রুপের প্রধান কর্ণধার মরহুম জহুরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত বর্তমানে ১৭টি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গ্রুপটি প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশে নাভানা গ্রুপই প্রথম ও একমাত্র জাপানি ব্র্যান্ড নিউ টয়োটা গাড়ি ও হিনো বাস বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান।
গ্রুপের উল্লেখযোগ্য ব্যবসাসমূহ আবাসন, প্রকৌশল ও জ্বালানি খাতে বিস্তৃত। নাভানা গ্রুপ ১৯৬৪ সাল থেকে দেশে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। এ দীর্ঘ সময়ে নাভানা গ্রুপ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রেখে আসছে। এর আগে নাভানা গ্রুপ কখনও ঋণখেলাপি হয়নি এবং কোনো ঋণ ও সুদ মওকুফের জন্য কোনো আবেদন করেনি। নাভানা গ্রুপে বর্তমানে প্রায় আট হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছেন। যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লক্ষাধিক লোক নির্ভরশীল। সার্বিক দিক বিবেচনা করে নাভানা গ্রুপকে এই আর্থিক সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য জরুরিভিত্তিতে চলতি মূলধন ঋণ সহায়তা প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নাভানা গ্রুপের চেয়ারম্যান শফিউল ইসলাম কামাল ২০১৮ সালে অসুস্থ হওয়ার পর তার ছেলেরা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেন। তারপর থেকেই আর্থিক সঙ্কটে পড়ে গ্রুপটি। ওই সময়ই দুটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়ে পড়ে। চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে গ্রুপটির অর্থসঙ্কট আরও চরম আকার ধারণ করে। এখন পরিস্থিতি এতোই খারাপ যে, ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, অর্থসঙ্কটে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন দেয়া এবং প্রতিষ্ঠান সচল রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
নাভানা গ্রুপের ১৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে ৩১ ব্যাংক ও ১৯টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণের পরিমাণ পাঁচ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকঋণের পরিমাণ চার হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ৫৫৪ কোটি টাকা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ মে আর্থিক সঙ্কটের কথা উল্লেখ করে ৩০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা চলতি মূলধন ঋণ চেয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলামের কাছে আবেদন করে নাভানা গ্রুপ। আবেদনে গ্রুপটির আট হাজার শ্রমিকের বেতন-ভাতা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন গ্রুপের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে মোট এক লাখ তিন হাজার ১১৭ কোটি টাকার বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়, যা দেশের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ৩ দশমিক ০৭ শতাংশ। সরকারের নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রণোদনা প্যাকেজসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত ৬৬টি সার্কুলার জারি হয়েছে।
এর মধ্যে রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, ক্ষতিগ্রস্ত এসএমই খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা, রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) জন্য ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিমের আওতায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা এবং উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানার জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ সুবিধা বা চলতি মূলধন ঋণের আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে।
এছাড়া কৃষি খাতে ভর্তুকি বাবদ সাড়ে নয় হাজার কোটি টাকা, কৃষি খাতে চলতি মূলধন সরবরাহের উদ্দেশ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম ঘোষণা করা হয়েছে। প্রি-সঞ্চয় ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের জন্য দুই হাজার কোটি টাকার তহবিল, বাণিজ্যিক ব্যাংকের স্থগিত সুদের ভর্তুকির জন্য দুই হাজার কোটি টাকা এবং নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, কৃষক ও ক্ষুদ্র/প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের জন্য তিন বছর মেয়াদী তিন হাজার কোটি টাকার আবর্তনশীল পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এ প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থের সংস্থান হবে দেশের ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে। এসব প্যাকেজের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা ৪ থেকে ৫ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন। কিন্তু ব্যাংকগুলো এত কম সুদে ঋণ দিয়ে ব্যবসা করতে পারবে না। তাই ব্যাংকগুলোকে সরকার এসব ঋণে আরও ৪ থেকে ৫ শতাংশ সুদ ভর্তুকি হিসাবে দেবে। সেজন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা।
এমইউএইচ/এইচএ/এমএআর/এমকেএইচ