আমি আর মিশু রিক্সায় চড়িয়া যাইতেছি। যেহেতু আজ নববর্ষ; সেহেতু রাস্তার আশেপাশে বাঙালী নারীদের পরিভ্রমণ আজ একটু বেশি লক্ষ্য করা যাইতেছে। আজ বাংলার ভূমিকে যেন পরীদের বাসস্থান মনে হইতেছে। কী মনোহরে বাঙালী নারীরা সাজিয়া তাহাদিগের সকল দোষ ঢাকিবার মিছিলে নামিয়াছে। মিশু কহিল—‘কাকু, নারীরা এত সাজে কেন?’ মিশুকে তৎক্ষণাৎ কী কহিব তাহা মাথায় আসিতেছিল না। পরক্ষণে কহিলাম—‘এ পুরুষ সমাজে নারীদের দোষ থাকিতে মানা তাই নারীরা বাধ্য হইয়া তাহাদিগের দোষ ঢাকিবার জন্য সাজগোছ করিয়া থাকে।’ আবার সে কহিল—‘কাকু—মহিলারা কেমনে যে শাড়ী পরিধান করিয়া থাকে! আমি হলে তা কখনো শাড়ী পরিধান করিতে পারিতাম না।’ প্রকৃতপক্ষে—নারীরাও শাড়ী পরিধান করিতে স্বাছন্দবোধ করে না। কিন্তু তাহারা যে উপায়হীন। কেননা শাড়ী পরিধান করিলে নারীর সব দোষ ঢাকা সহজ হয়ে যায়। সেটা বাহ্যিক বা মানসিকই হোক না কেন। আর সেজন্যই বুঝি বৈকৃতকাম পুরুষেরা বলে বাঙালী নারী—আহা, শাড়ীতে সুন্দরী।
Advertisement
মিশুর সাথে বকবক করিতে করিতে আমি দূর হইতে প্রচেতাদের গ্রামের বাড়িটি দেখিতে পাই। তখন আমি ভাবিতেছিলাম, কী করিয়া আমাদিগের রিক্সাটির চালককে বলিয়া আশেপাশে থামানো যায়, যাতে মিশু আমার প্রকৃত অভিসন্ধি না জানিতে পারে। মিশুর সাথে প্রচেতার ভ্রাতা সজলের সাথে বেশ সখ্যতা ছিল। তখন একটি বুদ্ধি মগজে নাড়া দিল। ‘মিশু ঐ দেখ! সজল দাদাকে দূরে দেখা যাইতেছে। শুনেছিলাম সজল দাদাদের গ্রামের বাড়িটি এখানে কোথাও হইবে। চল একটু সজল দাদার সাথে দেখা করিয়া যাই। আমাদের সাথে সাক্ষাৎ হইলে সজল দাদা প্রচণ্ড খুশি হইবে।’ আমি কহিলাম। আসলে দূর হইতে সজল দাদাকে দেখা যাইতেছিল না। অন্য কেউ একজন প্রচেতাদের বাড়ির সামনে দিয়া হাঁটিয়া যাইতেছিল। মিশু বলল—‘হ্যাঁ কাকু—দেখিতেছি। চলেন একবার সজল দাদার সাথে দেখা করিয়া যাই।’
অতঃপর—রিক্সাচালককে থামিতে বলিলাম। রিক্সা হইতে নামিয়া পদযান আরম্ভ করিলাম। সূর্যমামা ঠিক মাথার উপর মন খারাপ করিয়া এদিক ওদিক করিতেছে। ঠিক যেমনটি দাদামশাই ভোরবেলায় শৌচাগারের পাত্র ধরিয়া করিত। অখিলে তেমন কোন মেঘের খেলা ছিল না। কিন্তু একটু উপরের দিকে তাকাতেই আমার নয়নে একফোঁটা বৃষ্টি এসে মূর্ছিত হইল। বুঝিতে পারিলাম যে, বৃষ্টি আমার নয়ন ভিজাইল; তখন আমার দেহটি বা ভিজাইতে কতক্ষণ? মিশুকে দ্রুতবেগে হাঁটিতে কহিলাম। প্রচেতাদের গ্রামের বাড়ির সামনে উপনীত হইতেই প্রচেতাকে দূর হইতে দেখিতে পারিলাম। প্রচেতা আজ তেমন কোন সাজগোছ করিল না। তা দেখিয়া একটু অবাক হইলাম। তথাপি তেমন সাজগোছ না করিলেও তার রূপের আভায় যেন ধরিত্রী ধেই ধেই করিয়া নাচিতেছিল।
বহুদিন পরে প্রচেতাকে দেখিতে পারিয়া আনন্দে আমার মনও নাচিতে লাগিল। কাজল ভরা চোখে সে একবার আমার দিকে তাকাইল আবার কী বুঝিয়া যেন চোখের পলকে লুকাইল। হঠাৎ প্রচেতার দিদি মার সাথে দেখা হইল। তিনি মুহূর্তেই আমাদের চিনিতে পারিলেন। হাসিমুখে তিনি কহিলেন, ‘কী রুদ্র, তোরা এখানে?’ আমি কহিলাম, ‘আমরা নববর্ষ উপলক্ষে একটু ঘুরিতে বাহির হইলাম। আসতে আসতে এতদূর চলে আসলাম। এরপর ভাবিলাম, সজল দাদার সাথে দেখা করিয়া যাই।’ তিনি আমাদের তাহাদিগের ঘরে প্রবেশ করিবার জন্য বলিলেন। উদ্দেশ্য যেহেতু এটাই ছিল তাই আর না বলিলাম না। এরপর দিদিমা আমাদের দ্বিপ্রহরের ভোজন করিবার জন্য কহিলেন। মিশু প্রথমে না করিল। আমি ভাবিলাম দ্বিপ্রহর ভোজন করিলে বেশ কিছুক্ষণ এখানে সময় ব্যয় করা যাবে এবং প্রচেতাকে এতদিন না দেখিবার ক্ষুধাও মিটানো সম্ভব হইবে। তাই মিশুকে আমি ইশারায় রাজী হইতে বলিলাম।
Advertisement
আমি ঘরে প্রবেশ করিয়া সামনের একটি খাটের উপর বসিয়া প্রচেতাকে প্রাণভরে দেখিতেছিলাম। সে একবার এদিক যাচ্ছে—আবার ওদিক যাচ্ছে। কেনই বা সে এদিক ওদিক যাচ্ছে তাতে আমার বিন্দুমাত্র খেয়াল ছিল না। আমি শুধু তাহার মোহিনী রূপের নিরবচ্ছিন্ন আস্বাদন করিতেছিলাম এবং নয়নের ক্ষুধা নিবারণ করিতে লাগিলাম। নয়নের এই ক্ষুধা কি আর সহজে মিটে? আমার নয়নে যে ছিল বিশাল এক রাক্ষসের ক্ষুধা। সেই ক্ষুধা যেন কভু মিটিতে চায় না। এদিকে—দিদিমার আপ্যায়নে দ্বিপ্রহরের ভোজন শেষ করিলাম। খাওয়া শেষ করিবার পর মিশু যাইবার জন্য অস্থির হইয়া পড়িল। এখনো প্রচেতার সাথে কোন কথা হইলো না। তাহার সাথে একটু কথা বলিবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সেটা সম্ভব হবে বলে মনে হইতেছিল না। মিশু কিছু একটা আন্দাজ করিতে পারিল। তাই বেশি জোর করিলাম না। দিদিমার কাছে থেকে বিদায় নিয়া শহরের উদ্দেশ্যে ফিরতি যাত্রা করিলাম।
সামনে আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। পড়াশুনায় কোন অভিনিবেশ নেই বললেই চলে। এদিকে আমাদিগের আমেরিকা যাবার ভিসার কার্যক্রম বেশ দ্রুত গতিতে চলিতেছে। প্রতিদিন তাই শঙ্কায় অতিবাহিত হইতেছিল। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কোনমতে অবসান করিলাম। পরীক্ষার ফলাফল ভালো হইবে না সেটা জানিতাম। তাই এবার পরীক্ষা সম্পন্ন হইবার পরে ঈশ্বরকে সাহায্য করিবার জন্য বিন্দুমাত্রও ডাকিলাম না। আমি জানিতাম যদি ঈশ্বরকে ডাকিয়া আমি পরীক্ষায় পাস করিতাম, তাহলে সেটা বেশ অন্যায় হইত। তাই আর ঈশ্বরকে ডাকিলাম না। কয়েক মাস পরে পরীক্ষার ফল প্রকাশ হইলো এবং জানিতে পারিলাম যে পদার্থ বিজ্ঞানে ফেল করিলাম। ফলে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করিলাম না। এই খবর শুনিয়া পিতামশাই রেগে-মেগে আগুন। আমেরিকাতে বসিয়া ফোনে নানা ধমক দিতে লাগিল। মনটা খুব ভালো যাইতেছে না। এদিকে প্রচেতা হয়ত এতক্ষণে জানিতে পারিল যে, আমি উচ্চ মাধ্যমিকে পাস করিনি। তাই হয়ত সে আমাকে গণ্ডমূর্খ ভাবিতে লাগিল। সব মিলিয়ে বেশ একটি দুঃসময় কাটাইতেছিলাম। ভাবিলাম আমার অসফল চেহারাটা আর প্রচেতাকে কোনদিন দেখাইবো না।
এভাবে বেশকিছু দিন অতিবাহিত হইল। একদিন সাজু তাহাদিগের বাড়িতে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাইবার জন্য আমাদের পরিবারের সবাইকে নিমন্ত্রণ করিল। বন্ধুর দেওয়া নিমন্ত্রণ বলে কথা—তাই যথাসময়ে তাহাদিগের বাড়িতে আমরা সবাই উপস্থিত হইলাম। সাজুদের অনুষ্ঠানে প্রায় একশত মানুষের সমাগম হইল। দ্বিপ্রহরে সবাই মিলে বাড়ির অঙ্গনে ভোজন করিতে বসিলাম। হঠাৎ প্রচেতার মাতা কান্তাদিদির কণ্ঠ শুনিতে পারিলাম। তিনি প্রচেতাকে কেন জানি শাসাইতেছেন। প্রচেতা এবং কান্তাদিদি একসাথে দ্বিপ্রহেরর ভোজন করিতেছিল। আমি ভোজন করিবার সময় একটি সিদ্ধান্ত নিলাম, আজকে যেভাবেই হোক না কেন প্রচেতাকে খোলাখুলি আমার মনে কথা কহিব। তাহার উত্তর আমাকে সামনাসামনি শুনিতে হইবে। প্রচেতা কি আসলেই আমাকে ভালোবাসে? সেটা আমাকে আজ জানিতে হইবে। আমার সিদ্ধান্তের কথা গোপনে সাজুকে বলিলাম। সাজু আমার কথায় সায় দিল। সাজু কহিল, ‘রুদ্র তুই তোর জ্যেষ্ঠ সহোদরা মিলিকে দিয়া প্রচেতাকে আমাদের পিছনের পুকুর পাড়ে নিয়ে আসতে বল। বাকীটা আমরা ঠিক করিবার চেষ্টা করিব।’ আমি সাথে সাথে মিলিকে আমাদের পরিকল্পনাটা জানাইলাম। মিলি দিদিও তাতে সায় দিল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি আর সাজু তাহদিগের বাড়ীর পিছনে পুকুর পাড়ে প্রচেতার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ পর মিলি দিদি প্রচেতাকে আমাদের সামনে নিয়া আসিল। ‘আপনি কেন আমাকে এখানে নিয়া আসিলেন?’ প্রচেতা মিলি দিদিকে কহিল। ‘রুদ্র, তোরে কিছু বলিবে।’ মিলি দিদি কহিল। প্রচেতা আমার সামনে উপস্থিত হইল। প্রচেতা হয়ত বুঝিতে পারিল যে, আমি তাহাকে কী বলিব। তাই সে একটু লজ্জা পাইল। এদিকে প্রচেতাকে দেখিবার পরই মম হৃদয়ে কম্পন শুরু হইল। কোন কথা বলিবার শক্তিটুকু আমার ছিল না। সাজু তা লক্ষ্য করিল। তাই সে আমার হইয়া প্রচেতাকে কহিল, ‘প্রচেতা, তোরে রুদ্র অনেক ভালোবাসে। তোরে ছাড়া সে বাঁচবো না। এখন আমরা তোর মুখ হইতে তোর উত্তর শুনিতে চাই।’ মিলি দিদিও বলিল, ‘হ্যাঁ প্রচেতা, তোর উত্তরটা বল।’ প্রচেতা একটু থমকে দাঁড়াল। পরে সে বলিল, ‘দেখেন, আমি এখন পড়াশুনা নিয়ে চিন্তা করিতেছি। প্রেম বা ভালোবাসা নিয়ে এখন ভাবিতেছি না। তাছাড়া আপনারা সবাই তো আমেরিকা চলে যাইতেছেন।’ মিলি দিদি কহিল, ‘আমেরিকা যাইলে কী হইবে। তোর সাথে আমাদের যোগাযোগ থাকিবে।’ এরমধ্যে কেউ একজন আমাদের দিকে পুকুরপাড়ে আসিতেছিল। প্রচেতা বলিল, ‘কেউ একজন এদিকে আসিতেছে। আমি এখন যাইতেছি।’ এই বলিয়া প্রচেতা চলিয়া গেল।
Advertisement
প্রচেতার মুখে ইতিবাচক সাড়া না পাইয়া মনটা ভীষণ খারাপ হইয়া গেল। সাজু আমাকে সান্ত্বনা দিতে লাগিল। সাজু কহিল, ‘প্রচেতা তো তোকে ভালোবাসে না, সেটা বলেনি। তুই শুধু শুধু কেন মন খারাপ করিতেছিস?’ সাজু অবশ্য মন্দ বলেনি। কিন্তু তারপরও প্রচেতার মুখে ভালোবাসি কথাটি শুনিতে পারিলে আমার এতদিনের কষ্টটি একটু হালকা হইত।
এভাবে বেশকিছু দিন চলিয়া যায়। আমি সাজুদের দোকানে আড্ডা দিবার সময় একটি ছেলেকে প্রায়ই দেখিতাম। ছেলেটার নাম সুমন। সে প্রতিদিন প্রচেতা যাইবার সময় তার দিকে কেমন করিয়া তাকিয়ে থাকিত। প্রথমে ভেবেছিলাম সে এই পাড়ায় নতুন আসিল। পরে জানিতে পারিলাম সে প্রচেতার সাথে একই স্কুলে পড়াশুনা করিতেছে। ছেলেটির খারাপ উদ্দেশ্য দেখিয়া ভাবিলাম একদিন ছেলেটাকে একটি উচিত শিক্ষা দিব। প্রয়োজনে তাকে মেরে মাটিতে শুইয়ে দিতে আমার হাত একটুও কাঁপিত না। তাই একদিন সাজুদের দোকানে বসিয়া ক্রিকেটের স্ট্যাম্প হাতে নিয়া ছেলেটির জন্য অপেক্ষা করিতেছিলাম। যথারীতি ছেলেটা সাজুদের দোকানের সামনে এসে হাজির। এদিকে প্রচেতা প্রাইভেট পড়া শেষ করিয়া তাহাদিগের বাসার সম্মুখে যাইতেছিল। ছেলেটিকে দেখিয়া আমার মেজাজটি বড্ড গরম হইয়া গেল। প্রচেতা যাইবার সময় সুমন তাহার দিকে তাকাইয়া একটি হাসি দিল। প্রচেতাও তা দেখিয়া একটি হাসি ফেরত দিল। তাহা দেখিয়া মনে ভীষণ আঘাত পেলাম। ভাবিলাম ছেলেটির বা দোষ কিসের। প্রচেতা হয়ত ছেলেটিকে পছন্দ করে। তাহা না হইলে অমন করিয়া ছেলেটির দিকে তাকাইয়া হাসি দিবে বা কেন? তাই ছেলেটির উপর রাগ মুহূর্তে চলিয়া গেল।
সেদিন বুঝিতে পারিলাম, কেন প্রচেতা এতদিন আমার ডাকে সাড়া দেয়নি। বহু কষ্টে আমার বুক যেন ফাটিয়া যাইতেছিল। সেদিন সাজুদের দোকান থেকে একটি সিগারেট কিনিয়া ধরাইলাম। জীবনের প্রথম সিগারেট এবং পরপর তিন বা চারটা সিগারেট ধরাইলাম। কিছুতেই যেন কষ্ট দূর হইতেছে না। সাজু আমাকে অনেক বুঝাইল। অনেক সময় ধরে সাজু আমাকে সান্ত্বনা দিতে লাগিল কিন্তু কিছুই যেন আমার মাথায় ডুকিতেছিল না। সব থাকার পরও যেন নিজেকে বড্ড একা মনে হইল। আপনা আপনি অশ্রুধারা বহিয়া যাচ্ছিল। সাজুর মন খারাপ হইয়া যায়।
কিছুদিন পর পিতাশ্রী সুদূর আমেরিকা হইতে আমাদের সাথে দেখা করিতে আসিল। মাত্র কিছুদিনের জন্য তিনি আমাদিগকে দেখিতে আসিলেন। তাছাড়া আমেরিকাতে যাবার সব কাজ প্রায় সম্পন্ন হইয়া গেল। এদিকে আমি উচ্চ মাধ্যমিকে পাস করিনি, সেটা তিনি কল্পনাও করিতে পারিতেছিলেন না। কিছুদিন পর তিনি কর্মকার বাবুর কাছ থেকে জানিতে পারিলেন যে, প্রচেতার সাথে আমার সম্পর্কের কারণেই আমি লেখাপড়ায় খারাপ হইয়া গেছি। কর্মকার বাবু বেশ ঈর্ষাপরায়ণ লোক ছিল। তাই তিনি আরও নানা-কথা পিতাশ্রীর কাছে ইচ্ছেমত কহিলেন। পিতাশ্রী তা শুনে রেগে-মেগে আগুন। তিনি বাসায় আসিয়া মাতাশ্রীকে বিস্তারিত কহিলেন। তারপর ঘরে আরম্ভ হইলো ভীষণ এক বাগযুদ্ধ। সে বাগযুদ্ধ শুনিয়া প্রতিবেশীর কয়েকজন প্রচেতার মাতা কান্তাদিদিকে বিস্তারিত কহিলেন। এদিকে কান্তাদিদিও রেগে-মেগে আরও আগুন। তিনিও থেমে থাকেননি। যাহা ইচ্ছে তিনি বলিয়া আমাদিগের বংশ উদ্ধার করিলেন। তাহা আবার প্রতিবেশীদের মাধ্যমে শুনিয়া মাতাশ্রী ক্ষিপ্ত হইলেন। এইভাবে বেশ কয়েকদিন ধরিয়া দুই পরিবারের মধ্যে ভীষণ বাগযুদ্ধ চলিতে লাগিল। বাগযুদ্ধ এমন এক পর্যায়ে চলে যায়, যাহা পাড়ার কেহ কল্পনাও করিতে পারেনি। এদিকে পাড়ার সবাই কেমন জানি ছি-ছি করিতেছে। পাড়ার সবাই একসময় আমাকে পাড়ার সবচেয়ে ভালো ছেলে এবং প্রচেতাকে পাড়ার সবচেয়ে ভালো মেয়ে বলিয়া জানিত। আর এখন সবাই আমাদিগের ইচ্ছেমত কুরুচিপূর্ণ সমালোচনা করিতে লাগিল। এসব শুনিয়া প্রচেতার মাতা প্রচেতাকে প্রচণ্ড শাসন করিল। এইভাবে আমাদিগের দুই পরিবারের সম্পর্ক কয়েকদিনে ভেঙ্গে চুরমার হইয়া গেল। রোমিও এবং জুলিয়েট পরিবারদ্বয়ের মধ্যে যেমন সম্পর্ক ছিল, ঠিক আমাদিগের পরিবারের মধ্যেও সেই রকম সম্পর্ক হইয়া গেল। দুই পরিবারের মধ্যে ভীষণ এক ঘৃণাপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি হইল।
বেশ কয়েকদিন আমি আমাদের ঘর হইতে বাহির হইতাম না। কাউকে এই মুখ দেখাইবার ইচ্ছেও জাগিল না। একদিকে প্রচেতার সুমনকে ভালো লাগা, অন্যদিকে আমাদিগের দুই পরিবারের মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্ক তৈরি হওয়া। এ যেন খারাপ সময়ের বন্যা আমার মাথার উপর দিয়া বইতেছিল। যতবার সুমনের কথা স্মরণ হইত, প্রচেতার উপর ভালোবাসার প্রভাব তত কম হইত। একদিন পিতাশ্রী মাতাকে কহিলেন, ‘রুদ্রের জন্য একটি পাত্রী ঠিক করিলাম। পরশু আমরা সবাই গিয়ে তাহারে দেখিয়া আসিব।’ বয়স কিন্তু আমার বেশি হয়নি। মাত্র পনেরো বছর হইল। বিয়ের মানে কি তাহা বুঝিতাম না। কিন্তু অন্তরের ভিতর যে আগুন জ্বলিতেছিল তাহার কারণে পিতা-মাতার সিদ্ধান্তে আমি আর কোন সাড়াশব্দ করিলাম না। এক পাত্রী দেখিতে পিতাশ্রী আমাদিগকে ঢাকা শহরের একটি বাসায় নিয়া যাইলেন। কিন্তু কোন এক কারণে পিতাশ্রীর সে পাত্রীকে পছন্দ হইল না। কিছুদিন পরে পিতাশ্রী আমাদিগকে চট্টগ্রাম শহরে আরেকটি পাত্রী দেখিবার জন্য নিয়া যাইলেন। সেই পাত্রীও পিতাশ্রীর কোন এক অজ্ঞাত কারণে পছন্দ হইল না। অবশেষে তিনি হতাশ হইয়া গেলেন। এদিকে পিতাশ্রীর আমেরিকাতে ফিরিয়া যাইবার সময় আসিয়া গেল। যাইবার পূর্বে তিনি আমাদিগকে এই শহর ছাড়িয়া সীতাকুণ্ডে মাসির বাসায় স্থানান্তরিত করিবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি চাননি যে, আমার সাথে প্রচেতার কোন সম্পর্ক থাকুক। মাতাশ্রী চাননি যে, প্রচেতাদের পরিবারের সাথে কোন সম্পর্ক হোক। তাই তিনি পিতার কথায় সাথে সাথে রাজী হইলেন।
পরের সপ্তাহে পিতাশ্রী আমেরিকাতে ফিরিয়া গেলেন। এর কিছুদিন পর আমরা সবাই সীতাকুণ্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হইলাম। শহরের বাসস্ট্যান্ডে আমি মাতাশ্রী এবং দুই বোন আসিলাম। একটি বাসে উঠিয়া আমরা সবাই বাসটি ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করিতেছিলাম। হঠাৎ সুমনের সাথে দেখা হইল। ‘আপনাকে অনেক খুঁজিতেছিলাম। শুনিলাম আপনি বাস স্টেশনে, তাই তাড়াহুড়ো করে চলিয়া আসলাম।’ সুমন কহিলেন। আমি কিছুই বললাম না। ‘আমি প্রচেতাকে পছন্দ করি এবং অনেকদিন ধরেই তাকে পছন্দ করি। কিন্তু আপনি ওরে…।’ এবার আমি কহিলাম, ‘এসব আমাকে বলিবেন না। আমি এইখান হইতে চলিয়া যাইতেছি। এখন আপনার যা খুশী, তা-ই করেন।’ সুমন আমার মেজাজ গরম দেখিয়া বাস হইতে নামিয়া গেল।
চলবে...
এসইউ/এএ/এমএস