আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে চা বাগান আর বন-বাদাড়ের মধ্যদিয়ে শিলিগুড়ি-দার্জিলিং পৃথিবীর সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ভ্রমণরুট। কলকাতা থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে শিলিগুড়ি। তারপর ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে সুকনা স্টেশন পেরোতেই চোখ জুড়িয়ে গেল সৌন্দর্যে। সুকনা স্টেশন থেকে বোঝা যায় ক্রমান্বয়ে উচ্চতায় ওঠে ট্রেন। বড় রকমের বাঁক শুরু হয় এ স্টেশন থেকে। মায়াময় চা বাগানের ভেতর দিয়ে টয় ট্রেন চলে আপন গতিতে। চা বাগানগুলো অসম্ভব সুন্দর, যেন সবুজের সিঁড়ি। যা মিশে গেছে আকাশে। আকাশ আর চা বাগানগুলো যেন মিলেমিশে একাকার! যতই পথ এগোয়; ততই মুগ্ধ হতে হয়।
Advertisement
পাইন বন আর চা বাগানের মধ্যদিয়ে যাওয়ার পথের বামদিকের অপূর্ব কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য আর চারিদিকের বিশেষত ডানদিকের ফেনিল ঝরনাধারা দারুণ রোমাঞ্চ জাগাবে। ক্রমান্বয়ে খাড়া হতে থাকা বন-বাদাড় আর পাহাড়ের গা বেয়ে থাকা বাড়ি, চা বাগান, নান্দনিক স্থাপত্য দার্জিলিংমুখী রাস্তা পাহাড়ের চূড়ায় উঠছে জেনে মেঘ ছুঁতে ছুঁতে মেঘের রাজ্য দিয়ে যেতে দেহমন শিহরিত হবেই। যেন স্বপ্নপুরীর মধ্যদিয়ে যাচ্ছি, স্বপ্নের রাজ্যে।
রান্টং স্টেশন বা এর নিকটবর্তী এলাকা থেকে কুর্শিয়াং স্টেশন। এখান থেকে কুর্শিয়াং পাহাড়ের অপূর্ব সৌন্দর্য বা চা বাগানের অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করা যায়। এ রুটেই ৭৪০৭ ফুট উচ্চতায় ‘ঘুম’ স্টেশন অবস্থিত। যা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় এবং সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থিত রেল স্টেশন।
শিলিগুড়ি-মহানন্দা-বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ-সুকনা-কার্শিয়ং-ঘুম-দার্জিলিং রুটে বন-বাদাড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যায় টয় ট্রেন। চা বাগান আর পাহাড়ের কাটা রোপ দিয়ে সবুজ পরিবেশ আর মায়াবী ঝরনার মধ্যদিয়ে ট্রেন ছুটে চলবে। ট্রেনে একটু সময় বেশিই লাগে। প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা। বলা যায়, উপভোগ একটু বেশিই করা যায় বিশ্বের অন্যতম রোমাঞ্চকর এ রেলপথ দিয়ে যেতে যেতে।
Advertisement
কয়েকটি রোমাঞ্চকর স্টেশন এ রুটের- সুকনা, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ স্টেশন, ঘুম, কার্শিয়ং। পাহাড়ের প্রায় পাদদেশের স্টেশন সুকনা। বাতাসিয়া লুপ বা বিশ্বের সর্বোচ্চ উচ্চতায় ‘ঘুম’ স্টেশন। আর শৈলশহর দার্জিলিংয়ের স্টেশন তো থাকলই। এ রুটের আঁকাবাঁকা পথ, বিপজ্জনক বাঁক (যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় ৬৯ ডিগ্রি পর্যন্ত) রোমাঞ্চকে আরও বাড়িয়ে দেয়। টাং, সোনাদা ইত্যাদি বেশ কয়েকটি স্টেশন বা বাজার এ রুটে অবস্থিত। এখান থেকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র ও তাদের জীবনধারা লক্ষ্য করা যায়। এ রুটের স্টেশন ছোট ছোট।
হিল কার্ট রোডের পাশাপাশি এ ‘টয় ট্রেন রুট’ (দার্জিলিং হিমালয়ান রেল), যা দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে সংক্ষেপে ডিএইচআর নামে পরিচিত। সুকনা, ঘুম বা দার্জিলিং স্টেশন সংলগ্ন মিউজিয়ামে ডিএইচআর’র ঐতিহ্য বা ইতিহাস, তথ্যাদি সংরক্ষিত আছে। ঘুম স্টেশনের আগে ‘জোড় বাংলা’তে সড়কপথ ও রেলপথ ক্রস করেছে। এখানকার বাতাসিয়ার বাগান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও দার্জিলিংয়ের অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়। সর্বশেষ স্টেশন হচ্ছে দার্জিলিং।
‘দার্জিলিং হিমালয়ান রেল’ পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং শহরের মধ্যে চলাচলকারী একটি দু’ফুট ন্যারো গেজ রেল পরিষেবা। এ রেল টয় ট্রেন নামে সমধিক পরিচিত। ১৮৭৯ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত এ রেলপথের দৈর্ঘ্য ৮৬ কিলোমিটার। এর মাত্রা শিলিগুড়ি স্টেশন মাত্র ১০০ মিটার উচ্চতায় কিন্তু দার্জিলিং স্টেশন ২,২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। আজও এটি বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে চলে। ইংরেজদের অবকাশকালীন স্থান হিসাবে দার্জিলিং বা হিমালয় পাহাড়ের এলাকা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ রুটের টয় ট্রেন আজ পর্যন্ত সুন্দরতম পাহাড়িয়া ট্রেন যাত্রা বলে আধুনিক এ যুগেও স্বীকৃত। বিখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন ১৮৯৬ সালে ডিএইচআর’র টয় ট্রেনে একদিন ভ্রমণ করেছিলেন। সে দিনটিকে তার জীবনে কাটানো অন্যতম উপভোগ্য দিন বলে মন্তব্য করেন। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে টয় ট্রেনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। নিউ জলপাইগুড়ি বা এনজেপি স্টেশন সংলগ্ন টয় ট্রেনের রেপ্লিকা আছে। তাই এনজেপি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত টয় ট্রেনে ভ্রমণ করলে একদিন খুব মজা করে কাটানো যায়।
দর্শনীয় স্থান: দার্জিলিংজুড়ে ছোট-বড় মিলিয়ে বেড়ানোর জন্য বেশ আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে অপূর্ব সুন্দর সূর্যোদয় দেখা যায়। ছবির মতো অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ বাতাসিয়া লুপ। বিলুপ্তপ্রায় পাহাড়ি বাঘ লো লুপার্ড খ্যাত দার্জিলিং চিড়িয়াখানা, পাহাড়ে অভিযান শিক্ষাকেন্দ্র ‘হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট’, এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং-রকের স্মৃতিস্তম্ভ, ক্যাবল কারে প্রায় ১৬ কিলোমিটার এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ভ্রমণ।
Advertisement
দার্জিলিং গিয়ে দেখতে পাবেন ভারতের সবচেয়ে উঁচু রেলওয়ে স্টেশন ঘুম। স্টেশনটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। পৃথিবীর বিখ্যাত প্রার্থনা স্থান ঘুম মোনাস্ট্রি। দার্জিলিং থেকে অপূর্ব সূর্যোদয় দেখা যায়। খুব ভোরে ৮ হাজার ৩০০ ফুট উঁচু টাইগার হিল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় চূড়ায় সূর্যোদয়ের অসাধারণ দৃশ্য আপনার মনকে পবিত্র করে তুলবে।
দার্জিলিংয়ে আরও দেখতে পারেন যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থী কেন্দ্র তিব্বতিয়ান সেলফ হেল্প সেন্টার। প্রায় ৮০০ ফুট উঁচুতে দার্জিলিং গোরখা স্টেডিয়াম দেখেও মুগ্ধ হতে পারেন। এছাড়া এখানে আরও দেখতে পারবেন নেপালি জাতির স্বাক্ষরবহনকারী দার্জিলিং মিউজিয়াম। পৃথিবীর বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার জাপানিজ টেম্পল, ব্রিটিশ আমলের সরকারি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র কাউন্সিল হাউস, লালকুঠির অসাধারণ শৈল্পিক নিদর্শনখ্যাত আভা আর্ট গ্যালারি। শতবর্ষের প্রাচীন মন্দির দিরদাহাম টেম্পল। পাথর কেটে তৈরি রক গার্ডেন এবং গঙ্গামায়া পার্ক। আরো কত কী! হ্যাপি ভ্যালি টি গার্ডেনে বসে তাৎক্ষণিকভাবে পৃথিবীখ্যাত ব্ল্যাক টি পান করতে পারবেন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শিলিগুড়ি জেলার একটি শহর ও পৌর এলাকা দার্জিলিং। শহরটি নিম্নে হিমালয়ের মহাভারত শৈলশ্রেণিতে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৭ হাজার ১০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। কাঞ্চনজঙ্ঘার অনুপম সৌন্দর্য এবং টাইগার হিলের চিত্তাকর্ষক সূর্যোদয় দেখার জন্য প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে ভিড় করেন।
কিছুদিন থেকে ঐতিহ্যের টয় ট্রেন সন্ধ্যা বেলায়ও চলছে। দার্জিলিংয়ে আগত পর্যটকদের গোধূলিবেলার অপরূপ পাহাড়ের দৃশ্য উপভোগ করতে এ সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। যাতে বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট হয়। দৃশ্য দেখার জন্য দারুণ এক রুট এটি। পাহাড়-পর্বত, গিরিখাদ আর বন-বাদাড়-চা বাগান কিংবা ছবির মতো সুন্দর সুন্দর গ্রামের মধ্যদিয়ে ছুটে চলে এ ট্রেন। এনজেপি স্টেশন থেকে বা শিলিগুড়ি থেকে টিকিট কেটে নিতে হবে। বগি সংখ্যা একেবারেই (মাত্র ২-৩টি) কম। কিন্তু চাহিদা বেশি বলে টিকিট সঙ্কট হয়। এ ছাড়া বর্ষাকালে পাহাড় ধসের সময় এ রুটের ট্রেন বন্ধ থাকে বা আংশিক চলাচল করে থাকে।
দার্জিলিংয়ে কেনাকাটা: শিলিগুড়ি শহর সংলগ্ন হংকং মার্কেট থেকে বিদেশি জিনিস কিনতে পারেন। তাছাড়া দার্জিলিং, এনজেপি বা শিলিগুড়ি থেকেও বিভিন্ন সামগ্রী (ফল-খাবারসহ) কিনতে পারবেন। দার্জিলিং শহরের লাডেন-লা রোডের মার্কেটে ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে শীতের পোশাক, নেপালি শাল এবং শাড়ি, গিফট আইটেম, লেদার স্যু, সানগ্লাস কেনাকাটা করা যায়। তবে ভ্রাম্যমাণ ফেরি থেকে শাল, শাড়ি না কেনা ভালো।
কীভাবে যাবেন: আমার নিজ জেলা চুয়াডাঙ্গা হওয়ায় আর কলকাতায় কাজ থাকায় দর্শনা বর্ডার হয়ে কলকাতা-শিলিগুড়ি-দার্জিলিং গেছি। কলকাতায় আগে ট্যুর করতে চাইলে তাহলে দর্শনা বা বেনাপোল হয়ে কলকাতা যাওয়া সহজ। কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশন থেকে নিউ জলপাইগুড়ি ৫৮৬ কিলোমিটার। নিউ জলপাইগুড়ি এনজেপি নামেই পরিচিত। এনজেপি থেকে শিলিগুড়ি। তারপর ‘হিমালয়ান ট্রয় ট্রেন’ রুটে টয় ট্রেনে দার্জিলিং। সময় লাগবে ৭-৮ ঘণ্টা। শিয়ালদহ বা হাওড়া থেকে এনজেপি বা গোয়াহাটিগামী যেকোনো ট্রেনে চেপে যাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস, পদাতিক বা সর্বাধিক পরিচিত ‘দার্জিলিং মেল’এ নিউ জলপাইগুড়ি।
আর শুধু শিলিগুড়ি-দার্জিলিং বা গ্যাংটক (সিকিম) যেতে হলে লালমনিরহাটের বুড়িমারী দিয়ে গেলে কাছে হবে শিলিগুড়ি। বুড়িমারী অতিক্রম করে ওপারে চ্যাংড়াবান্দা সীমান্তে পৌঁছে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নিন। চ্যাংড়াবান্দা থেকে সরাসরি ময়নাগুড়ির বাস ধরে দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন শিলিগুড়ি। ভাড়া জনপ্রতি ভারতীয় ৭০ রুপি। আর সেখান থেকেই ঝটপট ১২০ রুপির বিনিময়ে সংগ্রহ করে নিন।
কোথায় থাকবেন: এনজেপি, শিলিগুড়ি বা দার্জিলিংয়ে থাকার ও খাওয়ার জন্য বিভিন্ন মানের হোটেল রয়েছে। এসব শহরে রয়েছে অসংখ্য আবাসিক হোটেল। এসব হোটেলে প্রতিদিনের থাকা এবং খাওয়াসহ জনপ্রতি ভাড়া পড়বে প্রায় ৮০০-১২০০ রুপি। প্রায় প্রতিটি হোটেলেই রয়েছে দর্শনীয় স্থানসমূহ, ঘুরে বেড়ানোর জন্য আকর্ষণীয় জিপ, সার্বক্ষণিক গরম পানির ব্যবস্থা, ঠান্ডা প্রতিরোধের ওষুধসহ যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো সমস্যার তাৎক্ষণিক সেবা। গরমকালেও দার্জিলিংয়ে শীত পড়ে। তাই শীতের পোশাক নিতে হবে। আর সময়ে-অসময়ে বৃষ্টিপাত হয়, তাই ছাতা নিতে হবে।
খাবার-দাবার: ট্যুরিস্টদের জন্য হোটেলগুলোতে রয়েছে সব ধরনের খাবারের ব্যবস্থা। ফলে পুষ্টিকর ও রুচিসম্মত খাবার নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অসংখ্য ট্যুরিস্টের আগমনের ফলে একেবারে বাঙালি রুচিসম্মত খাবার-দাবারের জোগান দেন হোটেল মালিকরা। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং ডিনার ছাড়াও ভোরবেলায় বেড-টি এবং ডিনারের আগে ইভিনিং টির ব্যবস্থাও রয়েছে।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
এসইউ/এএ/জেআইএম