প্রবাস

বৈরুত বিস্ফোরণ : ১২ বছর ছেলেকে দেখেননি মেহেদীর বাবা

‘বাসা থেকে বিস্ফোরণের স্থান তিন কিলোমিটার হবে। ওই সময় আমি কাজে যাচ্ছিলাম। আমার রুমমেট তখন কর্মস্থলে ছিলেন। আমি হেঁটেই যাচ্ছিলাম। সন্ধ্যা ছয়টার একটু বেশি হবে। ঠিক তখনই বিকট শব্দ। দূরে ধোঁয়া আর আগুনের শিখা। আমার চারপাশের ভবনের কাঁচ, জানালা সব ভেঙে পড়ছিল। আমি দ্রুত একটি গাছের নিচে আশ্রয় নেই’।

Advertisement

কথাগুলো বলছিলেন মেহেদীর সঙ্গে এক বিল্ডিংয়ে থাকা প্রবাসী সুজন হোসেন। তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণের শব্দ থেমে গেলে আমি শোরুমে যায়। গিয়ে দেখি শোরুমটি ধংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। কিছুক্ষণ পর রুমমেট মেহেদীর আহত হওয়া ও হাসপাতালে নেয়ার খবর পায়। একটু পরেই শুনি ছেলেটি মারা গেছে। আমার অফিস থেকে মেহেদীর অফিস দুই মিনিটের হাঁটা পথ। ওই ভবনে আরও অনেকে ছিলেন। তাদের অধিকাংশ বের হতে পারলেও মেহেদী বের হতে পারেনি। সম্ভবত কাঁচ ভেঙে পড়ায় আঘাতে সে মারা যায়’।

এক প্রবাসী বলেন, ‘লেবাননে বাংলাদেশি ২০ হাজার টাকার মতো আয় ছিল মেহেদীর। তা থেকে থাকা খাওয়ার খরচও চালিয়ে দেশে টাকা পাঠাতে কষ্ট হত তার। গত ৭-৮ মাস ডলারে দাম বেড়ে যাওয়াও কষ্ট আরও বাড়ে। তারপরও কয়েক মাস পরপর ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পাঠাতেন পরিবারের জন্য’

লেবাননপ্রবাসী বাংলাদেশি মেহেদী হাসান। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে সবার বড় ছিলেন। তারপরই ছিলেন বোন জিয়াসমিন আক্তার (২২)। আর বাকি দুই ভাইয়ের বয়স ১৩ ও ৫ বছর। বাবা তাজুল ইসলামও ছিলেন প্রবাসী, থাকতেন বাহরাইনে।

Advertisement

মেহেদীর বয়স যখন ১২ বছর, তখন বাবা তাজুল ইসলাম বাহরাইনে যান। ছয় বছর পর একেবারে দেশে চলে আসেন তাজুল ইসলাম। কিন্তু এর আগে মেহেদী লেবাননে পাড়ি জমান। ছেলের সঙ্গে ১২ বছর ধরে তার বাবা তাজুলের দেখা নেই। কে জানত, ১২ বছর আগের সেই সাক্ষাৎ ছিল বাবা-ছেলের শেষ সাক্ষাৎ। বৈরুত বিস্ফোরণের ঘটনায় মেহেদী না ফেরার দেশে চলে গেলেন।

মঙ্গলবার লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বন্দর এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি রয়েছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেহেদী তাদের একজন। সদর উপজেলার মাছিহাতা ইউনিয়নের ভাদেশ্বরা গ্রামে রাস্তার পাশেই মেহেদীর বাড়ি।

মেহেদি হাসান বৈরুতের আশরাফিয়া এলাকার একটি আটতলা ভবনের নিচ তলায় থাকতেন। কাজ করতেন স্পেনিস সুপার শপে। তার সঙ্গে থাকতেন আরেক বাংলাদেশি সুজন হোসেন। তিনিও ওই এলাকার একটি জুস কারখানার শোরুমে কাজ করেন।

মেহেদীর পরিবার জানিয়েছে, ২০১৪ সালে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ করে লেবাননে পাড়ি জমান ছেলেটি। সেখানে একটি বিপণীবিতানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতেন। এরপর আর দেশে আসা হয়নি। ঋণের পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে সুদসহ তিন লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। তার বাড়িতে এখন শুধুই শোকের মাতম।

Advertisement

কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবা তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বাহরাইনে যাওয়ার সময় মেহেদী বিদায় জানিয়েছিল। ১২ বছর আগে সেটাই ছিল শেষ দেখা। এরপর প্রায় ১২ বছর ধরেই ছেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ নেই’।

তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন জিয়াসমিন আক্তার। দূরপরবাসে থাকায় মেহেদী নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন প্রিয় বোনের সঙ্গে। ফোনে জিয়াসমিন বলেন, প্রতিদিন কাজে যাওয়ার আগে ভাই আমাকে ভিডিও কল দিতেন। কথা বলতেন। এখন ১১টা বাজলেই ভাইয়ের কথা মনে পড়বে। ১১টা বাজলেও আর ভাইয়ের ফোন আসবে না। ছয় বছর ধরে ভাইকে দেখি না। ভাইয়ের মরদেহটাও দেখতে পারব কিনা জানি না’?

এমআরএম/জেআইএম