‘রবীন্দ্র চিত্রকলা জগতের অভিনব সৃষ্টি- অনন্য সাধারণ। তাঁর চিত্রকলা একান্তরূপে তাঁর নিজস্ব, তাঁর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের দ্বারা চিহ্নিত। এ চিত্রকলার হুবহু অনুকরণ কারো পক্ষেই যেমন সম্ভবপর নয়, তেমনি মনের মতো করে সমুচিত ব্যাখ্যা দেওয়াও অসম্ভব। কোনো কলা সমালোচক যে একে কোনো বিশিষ্ট কলারীতির অন্তর্ভুক্ত করে দেখাবেন কিংবা তাঁর নিজস্ব কোনো ধরাবাধা তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে এর ব্যাখ্যা দেবেন তারও কোনো সম্ভাবনা নেই।’-(অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
Advertisement
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিতা-গান নিয়েই বেশি আলোচনা হয়। ছোটগল্প নিয়েও আলোচনা হয়। তাঁর প্রবন্ধ-উপন্যাস বা নাটক-ভ্রমণকাহিনি নিয়ে আলোচনা হয়। তবে কবির একটি সত্তা আছে, সেটা হচ্ছে শিল্পী বা ‘চিত্রকর’। এটা আড়ালেই থেকে যায়। আলোচনা খুব কমই হয়। কবি হিসাবে সমধিক পরিচিত হলেও সাহিত্যের সব বিষয়ে তিনি পা রেখেছেন। যেখানে তাঁর পদচারণা সেখানেই সোনা ফলেছে।
জীবনের শেষপ্রান্তে এসে কবিতার কাটাকুটি করতে গিয়ে আঁকা শুরু করলেন চিত্রকলা। ১৯২৪ থেকে ১৯৪১ সালে মৃত্যু অবধি প্রায় আড়াই হাজার ছবি এঁকে তিনি এক বিস্ময়কর শিল্প প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পুরোদস্তুর ছবি আঁকা শুরু করেন ১৯২৮ সাল থেকে। আজ আমরা ‘রবীন্দ্র চিত্রকলা’ বলতে যা বুঝি তা হলো- সেই সময় থেকে পরবর্তী দশ-বারো বছরে আঁকা তাঁর আড়াই হাজারের ওপর ছবি। নিজের আঁকা ছবি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ঐগুলি কেবল রেখাই নয়, ঐগুলি তার থেকেও কিছু বেশি। আমার চিত্রাঙ্কিত স্বপ্ন এক কাব্যিক কল্পনার দর্শন।’ জীবনের শেষলগ্নে (১৯২৪ থেকে ১৯৪১) বেশিরভাগ ছবিই এঁকেছেন। ছোটবেলার আঁকা-আঁকি শেখা পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে চিত্রশিল্প শিক্ষা প্রচলন- এগুলো তো ছিলই। এ ছাড়া পারিবারিকভাবে অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী- এঁরাও চিত্রচর্চা করতেন। ভ্রাতুষ্পুত্র গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের মতো আধুনিক ভারতীয় চিত্রশিল্পের পথিকৃতজনদের সার্বক্ষণিক সান্নিধ্য, আলাপ-আলোচনা এবং শিল্প পরিবেশ ইত্যাদির মধ্যে তাঁর ছিল বসবাস। জোড়াসাঁকোয় ঠাকুর পরিবারে প্রিন্স দ্বারকানাথের পুত্র গিরীন্দ্রনাথ এবং তার পুত্র এবং রবীন্দ্রনাথের জ্ঞাতিভাই গুণেন্দ্রনাথ মূলত ছবিই আঁকতেন। আর গুণেন্দ্রনাথের তিন পুত্র গগনেন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ তো ভারতের চিত্রকলা জগতে দিকপাল। শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তাঁদের দুই বোন বিনয়িনী ও সুনয়ানী দেবীকেও বাদ রাখা যাবে না।
রবীন্দ্রনাথের ছবিকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন- ১. নর-নারীর মুখের ছবি ২. জীব-জন্তু ও প্রতিকৃতি ৩. প্রকৃতির পটভূমিকায় মানুষের রূপকচিত্র ৪. অলঙ্কারিক চিত্র ৫. প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। তাঁর আঁকা নর-নারীর মুখের ছবিতে যেমন বিশিষ্ট মনের আকৃতি, তেমনি প্রতিকৃতিতে পাওয়া যায় তাদের স্বভাবের বৈশিষ্ট্য। তাঁর চিত্রকলায় অপরূপকে সন্ধানের কোন আকুলতা নেই। আছে শুধু রূপকে অপরূপ করার সাধনা। তাঁর ছবিতে যে রহস্য, তা অরূপের রহস্য নয়, অপরূপের রহস্য। তাঁর কাব্যের এবং চিত্রকলার পার্থক্য এইখানে। সৃজনশীলতা প্রকাশের যতগুলো মাধ্যম রয়েছে, তার মধ্যে চিত্রকর্ম একটি অন্যতম মাধ্যম। বৈষয়িক জীবনে রবি ঠাকুরের মনে যে ভাবাবেগ, আবেগ, উদ্দীপনা, হৃদয়-বেদনা, শক্তির উপলব্ধি ও সৌন্দর্যবোধের উদয় হতো তা তার চিত্রে প্রতিফলিত হতো। চিত্রকলায় কবির প্রথাগত বা আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকলেও তিনি চিত্র অঙ্কনে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ‘পূরবী’ ছবিটি তাঁর আঁকা অন্যতম ছবি।
Advertisement
কবি কায়সুল হক রবীন্দ্রনাথের চিত্রাবলী শীর্ষক একটি কবিতায় তাঁর চিত্রমালা চর্চা সহজেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এভাবে- ‘দুঃখগুলো কি রবীন্দ্রনাথ/ভুলবার জন্যে/নাকি খুব সহজেই/বোঝা যাক তার দুঃখগুলো/তাই যত্নশীল হয়ে এঁকেছেন এই সব ছবি।/সেই সরোবর তাঁর রঙের রেখার/খেলা। আর দীপান্বিত মনের আকুতি।/হয়তো মনের সঙ্গে হয়ে গেছে মাখামাখি নানান রঙের সহজেই।’ তাঁর ছবির আর একটা বৈশিষ্ট্যময় পরিচয় হলো শিল্পজ্ঞানহীন-নির্মল নির্দোষ মনোভঙ্গির শিল্প চিত্রময়তা। এটি স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক ও প্রকৃতিময়তার সাবলীল ও স্বাভাবিক রূপ।
‘মা ও ছেলে’ শীর্ষক একটি ছবিতে দেখা যায়, একজন মধ্যবয়সী মা তার শিশু ছেলেকে কোলে নিয়ে আসীন। হালকা বাদামি শাড়ি পরিহিত মার কোলে পরিধেয় বিহীন শিশুর অবস্থান আর মায়ের দৃষ্টি যেন দারিদ্রের প্রকাশ। প্রাণি সদৃশ ছবিগুলো তৈরি করেছেন রবীন্দ্রনাথ, সেই তাঁর অনুজ্জ্বল রঙের মুন্সীয়ানা ব্যবহারে। গাঢ় কালো, বাদামি, লাল আর হলুদাভ রঙে তাঁর ক্যানভাস হয়ে উঠেছে মূর্ত। রঙের ব্যবহারে ছবিতে কখনো কখনো বিষাদ, ব্যাঙ্গ, আদিমতা আর রহস্যময়তার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর অঙ্কিত ফর্মগুলোতে নেই রঙের প্রচণ্ডতা। এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই তিনি প্রকৃতির বিচিত্র রূপ এঁকেছেন। তবে রং তাঁর ছবিতে প্রাণময়তা খুব আনেনি বরং হয়েছে বিষণ্নতার প্রতিমূর্তি।
নারী রবীন্দ্রনাথের অন্যতম বিষয় ছিল। কখনো যোগাসনে, কখনো যুগলে, কখনো সুশ্রীতায়, কখনো উপবেশনে নানা আসনে নারী উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর ক্যানভাসে। উজ্জ্বল লাল রং, সাদা কালো, ধূসর, কালচে বাদামি রঙে নানা বৈচিত্রে নারী রবীন্দ্র চিত্রকলার উপজীব্য হয়েছে। ‘নিসর্গ’ শীর্ষক তাঁর কাগজে কালি ও জলরংয়ে করা ছবিটি অনবদ্য হয়েছে। ঘন আঁধার, গাছপালার মাঝে কুটিরের আভাস, আর বন বনানীর ফাঁকে সাদা আকাশ সত্যিই নিসর্গের মাদকতা প্রকাশ করে। আবার কাগজে কালি ও পোস্টার কালারে লকলক করে বেড়ে ওঠা গাছপালা, হলুদ রঙের জলাশয়, দূরে আবছায়ে জনপদ কখনো বা শিশুতোষ চিত্রকলার কথা মনে করিয়ে দেয়।
Mother and Child– মা ও শিশু-চিত্রকর্ম। ‘রবীন্দ্র চিত্রকলায় আমার কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে তাঁর রমণী মুখাকৃতি, জলরঙে, কালি কলমে আঁকা বাঙালি রমণীর লালিত্য তাঁর ছবিতে আবিশ্বাস্য সৌন্দর্যে ধরা পড়েছে। অন্য কোনো শিল্পীর কাজে এমনটা দেখা যায়নি। মুখাবয়বগুলো অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের আশপাশের পরিচিত জনেরই ছায়া। এমন শ্যামল সুন্দর ছবি রবীন্দ্রনাথের সংগীতের মতোই চিরকালীন’-(কাইয়ূম চৌধুরী: রবিতীর্থে রবীন্দ্রনাথ)। রবীন্দ্রনাথ কাগজ ও কালিতে ছবিগুলোতে জীবন দান করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি একটি অন্তর্নিহিত ছন্দ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। নারীর অবয়ব সবচেয়ে ভালো ফুটিয়ে তুলেছেন তুলিতে। তারপরও প্রাকৃতিক দৃশ্যের অনেক ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ।
Advertisement
‘রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকেন খাঁটি ইউরোপিয়ান ভঙ্গিতে...’। শিল্পী সমালোচক যামিনী রায়ের কথাটি ধরে আমরা একটু এগিয়ে যেতে পারি। আমরা জানি, পশ্চিমা শিল্পী বা সমালোচকরা জাপান ও চীন ছাড়া প্রাচ্যের কোনো শিল্পকে স্বীকৃতি দিতে চায় না, সেখানে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা অকুণ্ঠ প্রশংসিত হয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ একটি নতুন শৈলী সৃষ্টি করেছিলেন। শিল্পসুষমা ও রং প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি বিস্ময়কর উৎকর্ষতায় এগিয়ে ছিলেন। এসব কারণেই পশ্চিমারা তাঁর শিল্পকলাকে প্রশংসা করেছে। আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী করে সহায়তা করেছে। এটা বাংলা সাহিত্যের জন্য বিরাট পাওনা। রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ কাজ এখনো প্রকাশিত হয়নি। সব কাজ প্রকাশিত হলে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। হয়তো ভবিষ্যতে অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবেন। কারণ তাঁর এ দিকটিই এখন পর্যন্ত তেমন সুবিস্তৃতভাবে আলোচনায় আসেনি। তাঁর চিত্রশিল্পকর্ম নিয়ে আলোচনা দরকার। একত্র করে সংগ্রহ করার সময় পার হলেও এখনই এগিয়ে আসতে হবে।
শিলাইদহ বা শাহজাদপুরে কবির আঁকা চিত্রকর্ম দেখা যাবে। কলকাতার জোড়াসাঁকো বা শান্তিনিকেতনে এ শিল্পকর্ম লক্ষ্য করা যাবে। প্রতিকৃতি, নারীদৃশ্য, বৃক্ষরাজি, বিমূর্ত ইত্যাদি ছবি শাহজাদপুরের কাছারি বাড়িতে শোভা পাচ্ছে! শান্তিনিকেতনে কবির শিল্পকর্মের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন প্রদর্শনীতে তাঁর চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়। রবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে ভারত সরকার কবির চিত্রকর্ম নিয়ে বই প্রকাশ করেছে। তিনি গারো বাদামি এবং কালো রং বেশি ব্যবহার করতেন। তিনি খুব কম সময়েই লাল এবং সবুজ রং ব্যবহার করতেন। নারী ছবিগুলো বেশি জীবন্ত হয়েছে।
রবি ঠাকুর পেয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। আর্জেন্টিনার প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, সাহিত্য সমালোচক ও লাতিন আমেরিকার নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সহযোগিতায় ১৯৩০ সালে প্যারিস শহরের পিগ্যাল আর্ট গ্যালারিতে তার প্রথম শিল্প প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। পরে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে এ প্রদর্শনী চলে। প্রতিটি প্রদশর্নী সমসাময়িক চিত্র সমালোকদের আকৃষ্ট করেছে। ইউরোপীয় চিত্রামোদীরা ঠাকুরের ছবিতে ভারতীয় নয় বরং আধুনিক ইউরোপীয় অঙ্কনরীতির সাযুজ্য লক্ষ্য করে বিস্মিত হয়েছেন। বিশেষ করে বার্মিংহাম, লন্ডন, বার্লিন, মিউনিখ, কোপেনহেগেন, জেনেভা, মস্কো, বোস্টন, নিউ ইয়র্ক এবং সর্বশেষে ১৯৩১ সালের মে মাসে ফিলাডেলফিয়ায় এ প্রদর্শনী শেষ হয়। তাঁর ছবিগুলো বর্তমান সময়ের চিত্রগ্রাহক ও বোদ্ধাদের কাছে এক অনন্য আকর্ষণ। চিত্রকলার ইতিহাসে তার অঙ্কিত বৈচিত্রময় চিত্রকর্মগুলো যুগ যুগ ধরে চালিকাশক্তি ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
এসইউ/এএ/জেআইএম