ভয়াবহ বিস্ফোরণে শতাধিক প্রাণহানির পরেই লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বন্দরে বিপুল পরিমাণ বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুতের বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। বন্দরটিতে ২ হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট রাখা ছিল বলে জানা গেছে। এটি মূলত বোমা ও সার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ধারণা করা হচ্ছে, এ রাসায়নিক থেকে বিস্ফোরণেই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে বৈরুতের অর্ধেকটা।
Advertisement
দুর্ঘটনার পর থেকেই চলছে নানা হিসাব-নিকাশ, কে দায়ী, কার দোষে ঘটল এমন মর্মান্তিক ঘটনা? অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া সরকারি নথির ছবি থেকে জানা গেছে, অন্তত ছয় বছর ধরে লেবানিজ কর্মকর্তারা বন্দরে এমন বিপদের আশঙ্কার কথা জানতেন।
কোথা থেকে এলো এ বিস্ফোরক?মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানিয়েছে, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে লেবানন পৌঁছায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটভর্তি একটি জাহাজ। রাশিয়ার মালিকানাধীন জাহাজটি ওই সময় মলডোভার পতাকা বহন করছিল। জাহাজের গতিবিধি শনাক্তকারী ওয়েবসাইট ফ্লিটমোনের তথ্যমতে, জাহাজটি তখন জর্জিয়া থেকে মোজাম্বিক যাচ্ছিল।
জাহাজের ক্রুদের পক্ষের আইনজীবীর ভাষ্যমতে, যাত্রাপথে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বৈরুত বন্দরে নোঙ্গর করতে বাধ্য হয় জাহাজটি। কিন্তু লেবানিজ কর্মকর্তারা সেটিকে ফের যাত্রা করতে বাধা দেন এবং ঘটনাক্রমে জাহাজটি মালিক ও ক্রু উভয়ের কাছেই পরিত্যক্ত হয়।
Advertisement
এরপর জাহাজটির বিপজ্জনক মালামাল বৈরুত বন্দরের ১২ নম্বর হ্যাঙ্গারের একটি ভবনে নামিয়ে রাখা হয়। এর কয়েকমাস পর ২০১৪ সালের ২৭ জুন একজন বেনামি ‘জরুরি ঘটনা বিষয়ক বিচারক’-এর কাছে কার্গো সমস্যার সমাধান চেয়ে চিঠি পাঠান তৎকালীন লেবানিজ কাস্টমসের পরিচালক শফিক মেরহি। পরের তিন বছরে আরও পাঁচবার চিঠি পাঠিয়েছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা- ২০১৪ সালের ৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ সালের ৬ মে, ২০১৬ সালের ২০ মে, ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর এবং ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর। ২০১৬ সালের একটি চিঠিতে আগের অনুরোধগুলোতে বিচারকরা কোনও সাড়া দেননি বলে উল্লেখ ছিল। চিঠিতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তিনটি উপায় জানিয়েছিল- বাজেয়াপ্ত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট রপ্তানি করা, লেবানিজ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা অথবা লেবাননের বেসরকারি বিস্ফোরক কোম্পানিগুলোর কাছে তা বিক্রি করা।
কিন্তু, এরপরও কোনও জবাব আসেনি। এর একবছর পর নতুন লেবানিজ কাস্টমস পরিচালক বাদ্রি দাহির বিচারকদের কাছে আবারও চিঠি লেখেন। ২০১৭ সালের ওই চিঠিতে বিচারকদের কাছে মালামালগুলো যেখানে রাখা হয়েছে সেই জায়গা ও সেখানকার কর্মীদের বিপদের কথা চিন্তা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন কাস্টমস পরিচালক।
অথচ এরও প্রায় তিন বছর পর বিপজ্জনক অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বন্দরের ওই হ্যাঙ্গারেই রাখা ছিল।
মঙ্গলবার লেবানিজ প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব বন্দরে বিস্ফোরণের ঘটনাকে জাতীয় বিপর্যয় বলে ঘোষণা দিয়েছেন এবং প্রতিজ্ঞা করেছেন, দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই মূল্য চুকাতে হবে।
Advertisement
লেবানিজ প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলেছেন এবং এতে দোষীদের কঠোর শাস্তির ওয়াদা করেছেন। ঘটনা তদন্তে ইতোমধ্যেই একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, আগামী পাঁচদিনে মধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সমস্যা এখানেই শেষ নয় শুধু বিস্ফোরণ ট্রাজেডিই বৈরুতের একমাত্র সমস্যা নয়। কয়েক দশক ধরেই বন্দরে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ চুরির অভিযোগ রয়েছে। সেখানে অনিয়ম এতটাই বেশি যে স্থানীয়ভাবে এলাকাটি ‘আলীবাবা ও ৪০ চোরের গুহা’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
বৈরুত বন্দরে আমদানি মূল্যে দুর্নীতির কারণে শত শত কোটি ডলার রাজস্ব কখনোই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে পৌঁছাচ্ছিল না, শুল্ককর এড়াতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যাপক ঘুষেরও অভিযোগ রয়েছে।
রিমা মাজেদ নামে লেবাননের এক রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজবিজ্ঞানী টুইটারে বলেছেন, ‘বৈরুত শেষ এবং বিগত দশক ধরে যারা এই দেশ শাসন করেছেন তারা এর দায় এড়াতে পারেন না। তারা অপরাধী এবং সম্ভবত এটাই তাদের এযাবৎকালের (অসংখ্য অপরাধের মধ্যে) সবচেয়ে বড় অপরাধ।’
কেএএ/এমএস