দেশজুড়ে

লকডাউনে লেবাননে আটকা, বিস্ফোরণে মৃত্যু

টানা ছয় বছর প্রবাস জীবন কাটানোর পর গত মার্চ মাসে দেশে ফেরার কথা ছিল লেবানন প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণ মেহেদী হাসান রনির (২৫)। দেশে ফেরার জন্য কেনাকাটাও করেছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। কাজ বন্ধ থাকায় বাড়িতেও টাকা পাঠাতে পারছিলেন না। গত ঈদে মাত্র ১ হাজার ৬০০ টাকা পাঠিয়েছিলেন।

Advertisement

কাজ না থাকায় কিছুটা হতাশাগ্রস্ত ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মাছিহাতা ইউনিয়নের ভাদেশ্বরা গ্রামের তাজুল ইসলামের ছেলে রনি। বুধবার (৫ আগস্ট) সকালে সেই রনিরই মৃত্যুর খবর আসে তার পরিবারের কাছে। মঙ্গলবার (৪ আগস্ট) লেবাননের রাজধানী বৈরুতে জোড়া বিস্ফোরণের ঘটনায় মারা গেছেন তিনি।

একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন বাবা তাজুল ইসলাম। মা ইনারা বেগম ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন।

রনির পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন রনি। গ্রামের একটি স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে পড়াশোনা বেশি দূর এগোয়নি। বাহরাইন প্রবাসী বাবা তাজুল ইসলাম প্রবাসে সুবিধা করতে না পারায় পরিবারের কথা ভেবে রনি বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর্থিক দৈন্যদশার কারণে সুদে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ২০১৪ সালের ৯ মার্চ লেবাননে পাড়ি জমান তিনি। এর মধ্যে রনির বাবা তাজুল ইসলামও বাহরাইন থেকে দেশে ফেরত আসেন। ফলে পরিবারের পুরো চাপ পড়ে রনির ওপর।

Advertisement

পরিবারের জন্য হাসি মুখেই কাজ করে যাচ্ছিলেন রনি। লেবাননের বৈরুতে একটি বিপণি-বিতানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতেন তিনি। মাসে ২০ হাজার টাকা পাঠাতে পারতেন বাড়ি। কিন্তু এতো অল্প বেতনের টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করতে পারছিলেন না। এখনও দুই লাখ টাকার মতো ঋণ পরিশোধ বাকি আছে।

লেবাননে আয়-রোজগার কম হওয়ায় অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন রনি। বাড়ির সবাইকে বলেছিলেন অনুমতি দেয়ার জন্য। কিন্তু ঋণের টাকা শোধ না হওয়ায় বাড়ি থেকে অনুমতি মেলেনি। অভিমান করে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে অন্য দেশে চলে যাওয়ার কথাও বলেছিলেন ছোট বোন জেসমিন আক্তার হ্যাপিকে। কিন্তু নিয়তি রনিকে নিয়ে গেছে দূর আকাশে, না ফেরার দেশে। অন্য দেশে যাওয়ার কথা বলে এতো দূরে যে চলে যাবেন সেটি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি কেউ।

বুধবার (৫ আগস্ট) দুপুরে রনিদের বাড়িতে গিয়ে দেখে গেছে, ছেলের ছবি হাতে নিয়ে নির্বাক হয়ে বসে আছেন বাবা তাজুল ইসলাম। মা ইনারা বেগম বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছেন বাড়ির উঠানে। প্রতিবেশীরা সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মা ইনারা বেগমের দুই অশ্রুসজল দুই চোখ বারবার ছেলে রনিকেই খুঁজছে। ছোট বোন হ্যাপিও বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন ভাইয়ের নানা স্মৃতির কথা মনে করে।

রনির বাবা তাজুল ইসলাম জানান, গতকাল দুপুরে সর্বশেষ ছেলে রনির সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়েছে তার। বাবার সঙ্গে কথা বলে মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন রনি। এরপর আর কোনো যোগাযোগ হয়নি তার সঙ্গে। রাতে রনির এক সহকর্মী ফোন করে জানান রনি অসুস্থ, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর বুধবার (৫ আগস্ট) ভোরে আবার ফোন করে জানান রনি মারা গেছেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা বাবা এখন ছেলের মরদেহ দেশে আনার দাবি জানিয়েছেন সরকারের কাছে।

Advertisement

রানির ছোট বোন জেসমিন আক্তার হ্যাপি বলেন, বিস্ফোরণের পর শুনেছি আমার ভাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি নামাজ পড়ে দোয়া করেছি আর আল্লাহর কাছে ভাইয়ের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছি। বলেছি, আল্লাহ্ তুমি আমার ভাইয়ের পা নাও, হাত নাও কিন্তু অন্তরটা নিও না। আজকে ভোরে শুনি আমার ভাই নাই।

তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন কাজে যাওয়ার আগে ভিডিও কল দিয়ে আমার দুই মেয়ের সঙ্গে কথা বলতো রনি ভাই। দেশে আসবে বলে দুই ভাগ্নির জন্য চকলেট ও খেলনা কিনে রেখেছিল। বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটা করেছিল। কিন্তু লকডাউনের কারণে দেশে ফিরতে পারছিল না। গত পহেলা বৈশাখে ভাইয়ের জন্মদিনে মা নিজ হাতে কেক বানিয়েছিল। ভিডিও কলে আমরা সেই কেক কেটেছিলাম। এখন আমার ভাইয়ের মরদেহটা চাই।

মাছিহাতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আল আমিনুল হক পাভেল বলেন, ঘটনার পর থেকেই আমি রনির পরিবারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। মরদেহ দেশে আনার জন্য কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। সেজন্য আমরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করছি। মরদেহ আনার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

আজিজুল সঞ্চয়/আরএআর/এমকেএইচ