লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় বন্দরের একটি অনিরাপদ গুদামে হাজার হাজার টন অত্যন্ত বিপজ্জনক দ্রব্যকে সম্ভাব্য উৎস হিসেবে দেখা হচ্ছে। যে বিস্ফোরণের ধাক্কা পুরো রাজধানী জুড়ে অনুভূত হয়েছে ভূমিকম্পের মতো। মঙ্গলবারের সন্ধ্যার এই বিস্ফোরণে দেশটিতে এখন পর্যন্ত শতাধিক মানুষের মৃত্যু এবং চার হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।
Advertisement
কিন্তু দেশটির রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রধান বন্দরের কাছে কীভাবে এই বিপজ্জনক দ্রব্য মজুদ করা হলো; ছয় বছর আগে জব্দ করা হলেও সেগুলো কেন ধ্বংস করা হয়নি, পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই ৪০ লাখ মানুষের বৈরুতের কেন্দ্রে কেন সেগুলো এতদিন থাকলো; এমন নানা প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বৈরুতের বাসিন্দারা বলেছেন, বিস্ফোরণে পুরো শহর কেঁপে উঠেছে। এতে শহরের ভবনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিস্ফোরণস্থল থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত ভবনের জানালা, দরজা উড়ে গেছে।
লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব বলেছেন, কোনও ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই নাগরিকদের জীবন হুমকিতে ফেলে বৈরুতের বন্দরের গুদামে ছয় বছর ধরে ২ হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুদ করে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
Advertisement
দেশটির গণমাধ্যমে এই বিস্ফোরণের জন্য বন্দরের কাছের একটি আতশবাজির কারখানায় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডকে দায়ী করা হচ্ছে। আতশবাজির কারখানার আগুন আশপাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়ায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুদের গুদামে মুহূর্তের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে।
প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াবের স্বীকারোক্তি সমর্থন করেছেন লেবাননের সাধারণ নিরাপত্তা প্রধান আব্বাস ইব্রাহীম। তিনিও বলেছেন, কয়েক বছর আগে জব্দকৃত উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন বিস্ফোরক দ্রব্য বৈরুতের বন্দরের কাছে গুদামে মজুদ করে রাখা হয়েছিল।
বৈরুতের ৪০ লাখ বাসিন্দা বুধবার ঘুম ভেঙে দেখেছেন ধ্বংসস্তপে পরিণত শহরের অলিগলি, চারদিকে শুনেছেন মানুষের প্রাণ বাঁচানোর আর্তনাদ। হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই হচ্ছে না আহতদের। চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বৈরুতের নার্সদের একটি সংগঠন বলেছে, বিস্ফোরণে শহরের তিনটি হাসপাতাল একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। এতে চিকিৎসক, নার্সসহ অনেকেই মারা গেছেন।
এখন বৈরুতের বাসিন্দারা প্রশ্ন তুলেছেন রাজধানীর মতো একটি শহরে এত বিশাল পরিমাণে অতি বিপজ্জনক রাসায়নিক কীভাবে যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই মজুদের অনুমতি দেয়া হলো। এ জন্য কারা দায়ী?
Advertisement
হতাহতের ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে, বাড়ছে স্বজন হারানোর শঙ্কাও। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশটির হাসপাতালগুলোতে ইতিমধ্যে ব্যাপক চাপ তৈরি হয়েছে। হাসপাতালে আহতদের আর্তনাদ দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত নানা ভিডিওতে। বৈরুতের এই বিস্ফোরণের প্রকৃত হতাহতের চিত্র পেতে কয়েকদিন পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে বলে দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, বিশাল ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধারে ব্যাপক তৎপরতা শুরু হয়েছে। এতে বাড়তে পারে হতাহতের সংখ্যা।
নিখোঁজদের স্বজনরা শহরের হাসপাতালগুলোতে প্রিয়জনের খোঁজে ছোটাছুটি করছেন। লেবাননের স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশটির সরকারি টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে বলেছেন, বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত চারটি হাসপাতালে সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
করোনাভাইরাস মহামারিতে লড়াইরত দেশটিতে বিস্ফোরণের ঘটনা এমন এক সময় ঘটলো যখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কট চরমে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, লেবাননে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৬২ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ৬৫ জন। মহামারি সংক্রান্ত বিধি-নিষেধের কারণে দেশটির অর্থনীতি গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে। গত কিছুদিন ধরে দেশটিতে ক্ষুধা এবং দারিদ্র ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ জনগণ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে আসছিলেন।
বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী দিয়াব। তিনি বলেন, বিস্ফোরণে দায়ীদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। দায়ীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের এটিএফ বিস্ফোরক তদন্তকারী সাবেক কর্মকর্তা অ্যান্থনি মে সিএনএনকে বলেন, বিস্ফোরণের ভিডিওতে যে গাঢ় লাল এবং উজ্জ্বল রঙয়ের ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা গেছে; তা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলি হলুদ বর্ণ ধারণ করবে। মে বলেন, আমি বলছি না যে, এই বিস্ফোরণের সঙ্গে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই। এটা থাকতে পারে। তবে সেখানে অন্য উপাদানও ছিল। বিস্ফোরণের মাত্রা এবং শহরজুড়ে প্রবল কম্পনের ব্যাপারে মে বলেন, এটা কিছুটা এক কিলোটন ওজনের পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মতো ছিল।
তিনি বলেন, এই বিস্ফোরণে পারমাণবিক কোনও পদার্থ ছিল না। কিন্তু সেখানে কম্পন তৈরি হয়েছে, বিস্ফোরণ ঘটেছে। এগুলো একটি ছোট আকারের পারমাণবিক ডিভাইসের সমতুল্য।
বিস্ফোরণের এই ঘটনায় দ্বন্দ্ব তৈরি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। লেবাননের জনগণের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানিয়ে সহায়তার ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি বিস্ফোরণের এই ঘটনাকে ‘ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। যদিও মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের তিনজন কর্মকর্তা ট্রাম্পের এই মন্তব্যের উল্টো মত প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, এই বিস্ফোরণে সন্ত্রাসী হামলার কোনও আলামত তারা পাননি।
এসআইএস/এমএস