আন্তর্জাতিক

করোনার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের লড়াইয়ের গল্প

করোনাভাইরাস মহামারিতে প্রায় থমকে যাওয়া বিশ্বে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের সঙ্কটের কথা উঠে আসছে। অনেকেই সেসব সঙ্কট জয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন একাই অথবা অন্যদের সহায়তায় সম্মিলিতভাবে। মহামারির এই কঠিন সময়ে সবাইকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা চলছে সর্বত্র। কিন্তু এই বাঁচার চেষ্টার আড়ালে থেকে যাচ্ছে না বলা অনেক কথা।

Advertisement

করোনাভাইরাসে ইউরোপে প্রথমদিকে যে কয়েকটি দেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল; তারমধ্যে অন্যতম যুক্তরাজ্য। এই দেশটিতে বসবাসরত এশিয়ান এবং কৃষ্ণাঙ্গ বংশোদ্ভূতরা করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর বেশি ঝুঁকিতে আছেন বলে ব্রিটেনের একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে। মহামারির শুরুর দিকে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদেরও অনেকেই আক্রান্ত কিংবা মারা গেছেন করোনায়। বিদেশের মাটিতে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে করোনা মোকাবিলায় সম্মিলিত চেষ্টা চালিয়েছেন ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা।

এমনই একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী শাজনীন আবেদিন। যিনি ওয়েলসের সোয়ানসি এলাকায় পরিবার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছেন। করোনা মহামারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সেখানকার বাংলাদেশিরা কীভাবে রয়েছেন, চলছেন সেই গল্প ব্রিটেনের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ওয়েলসঅনলাইনকে বলেছেন শাজনীন।

করোনাভাইরাস যখন ব্রিটেনে প্রথম ধরা পড়ে, তখন শাজনীন নতুন একটি কাজ শুরু করেন। প্রতিবেশিদের খোঁজ নেয়া, তাদের মাঝে খাবার, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের জন্য একটি সেবা চালু করেন তিনি। ওয়েলসের সোয়ানসি কাউন্সিলে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন। আত্মীয়-স্বজনদের জন্য নিজের বাসার দরজা খুলে দেন।

Advertisement

সোয়ানসিতে বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছে শাজ নামেই পরিচত শাজনীন। বাংলাদেশে বিয়ে করলেও শাজ দীর্ঘদিন ধরে সোয়ানসিতে থাকেন। এই এলাকায় অনেক বাংলাদেশির বসবাস।

এর আগে, দেশটিতে বসবাসরত কৃষ্ণাঙ্গ, এশিয়ান এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (বিএএমই) সদস্যরা কোভিড-১৯ এর তীব্র ঝুঁকিতে আছেন বলে গবেষণায় ওঠে আসে। ব্রিটেনে করোনার সংকট বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তিনি গবেষণার সেই তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে শুরু করেন। আসলে কি ঘটছে সেটি জানার জন্য তিনি বেশ কিছু গবেষণায় গভীরভাবে চোখ বুলাতে শুরু করেন।

শাজ বলেন, ‘আমার একজন চাচাত বোন আছেন; যিনি মরিসন হাসপাতালের জুনিয়র চিকিৎসক। তিনি বলেন, এটা (কোভিড-১৯) এমন কিছু, যা নিয়ে আমাদের অত্যন্ত সতর্ক হওয়া দরকার।’

তিনি বলেন, আমরা স্বাস্থ্যবার্তা এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম নিয়ে সবার দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করি। মসজিদসহ সব ধরনের উপাসনালয় সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেটি ছিল শুরুর দিকের প্রথম ক্ষতি। এটাই ছিল আতঙ্ক এবং আইসোলেশনের ধারণার প্রধান কেন্দ্র।

Advertisement

শাজ বলেন, আমি ফোনে আমার বন্ধুর মায়ের কাঁন্না শুনতে পাই। তিনি ফোনে কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করতেন। তিনি ব্যাখ্যা করতেন, কোরআনে মহামারি এবং সেটি মোকাবিলার উপায় সম্পর্কে বলা আছে।

এপ্রিলের শেষ থেকে মে মাসের শেষে পবিত্র রমজান মাসের সময়টা ছিল একেবারে অচেনা। শাজ বলেন, মসজিদে কোনও নামাজ হচ্ছে না, ইফতারির আয়োজন নেই এবং রমজানের শেষে কোনও উদযাপনও নেই।

সেই সময় সোয়ানসিতে বসবাসরত এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী এবং হোটেল মালিক কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার ছোট ভাইও করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এই ঘটনাটি পুরো কমিউনিটির মধ্যে নাড়া দেয়।

শাজ এবার অন্যদের সহায়তার কথা চিন্তা করেন। যা বাড়িতে থেকে শুরু হয়। তার মা এবং স্বামীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনজনের সঙ্গে তার ননদ এবং ভাইও যোগ দেন। কিন্তু লকডাউনের কারণে তাদের পরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটে।

তিনি বলেন, আমাদের অনেক কিছু সমন্বয় করে নিতে হয়েছিল। সোয়ানসি মুসলিম কমিউনিটির অন্যান্য নারীদের নিয়ে তিনি একটি দল গঠন করেন। এই দলের মাধ্যমে সেখানকার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ শুরু করেন শাজ।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূদ এই ব্রিটিশ নারী বলেন, আমি পেছনে বসে থাকতে চাইনি। করোনাকে জয়ী হতে দিতে চাইনি। মার্চ, এপ্রিল এবং মে পর্যন্ত খাবার ডেলিভারি দেন শাজ। তার ননদ গর্ভবতী হওয়ায় পরে বাড়িতে বসে কাজের তদারকি করেন তিনি।

শাজের এই প্রকল্প পরিচালনায় সহায়তা করে সোয়ানসি মসজিদ কর্তৃপক্ষ। এই মসজিদের নিজস্ব একটি ফুড ব্যাংক রয়েছে। শাজ বলেন, আমার মাথায় সেই সময় শুধু একটি বিষয়ই ঘুরপাক খাচ্ছিল। তার ননদের সন্তান জন্মদানের সময় ঘনিয়ে এসেছে। বাড়িতে তিনি একাই থাকেন। এছাড়া তার শারীরিক অন্যান্য সমস্যাও আছে। শাজ তিনটি ব্যাগে খাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভরে তার বাসায় যান। শাজ বলেন, ‘তিনি খুবই কৃতজ্ঞ ছিলেন। তিনি বলেন, এটা এমন একটা সময় যখন সব দরজা বন্ধ তখন একটি দরজা খুলে গেছে।’

শাজের সহকর্মী আয়শা রায়হানা আমির এক বৃদ্ধের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। তিনি দেখছিলেন, ওই প্রতিবেশি অন্যান্য স্বাভাবিক সময়ের মতো দরজা নাড়লে সাড়া দেন না। সেই সময় তিনি আতঙ্কিত হয়ে পুলিশকে টেলিফোনে ওই বৃদ্ধের সম্পর্কে জানান।

পুলিশের কর্মকর্তারা ওই বাড়িতে পৌঁছে দেখেন- তিনি স্ট্রোক করেছেন। পরে সেখান থেকে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। সোয়ানসি কাউন্সিলের প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন শাজ।

তিনি বলেন, একজন ম্যানেজার হিসেবে আমাকে এটা নিশ্চিত করতে হয়েছিল যে, কর্মীরা নিরাপদ আছেন। সোয়ানসির কিছ পিছিয়ে পড়া এলাকায় কাজ করেন শাজ। বিশেষ এই এলাকায় যখন কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, তখন তার অফিসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানতে চেয়েছিলেন, মারা যাওয়ার ইচ্ছে আছে কিনা।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শাজ বলেন, আমি এই এলাকায় আসার পর কোনও ধরনের জাতিগত বিদ্বেষ কিংবা বৈষম্যের শিকার হইনি। শাজ নিজেকে একজন ব্রিটিশ ওয়েলস মুসলিম মনে করেন; যিনি তার বাংলাদেশি পরিচয়ের জন্য গর্ব বোধ করেন।

ওয়েলসের সরকারি তথ্য বলছে, সোয়ানসি এলাকায় কৃষ্ণাঙ্গ, এশিয়ান এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় ২৬ হাজার ৪০০ মানুষের বসবাস। যা ওয়েলসের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১ শতাংশ। করোনা মহামারি মোকাবিলায় ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশিরা এভাবে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে প্রাণ বাঁচানোর লড়াই জারি রেখেছেন। মহামারির এই প্রবল সঙ্কটপূর্ণ সময় একদিন ফুরিয়ে যাবে সেই আশা করছেন সবাই।

রয়টার্সের পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১ কোটি ৮১ লাখের বেশি মানুষ এবং মারা গেছেন ৬ লাখ ৮৮ হাজারের বেশি। কিছু দেশ করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি কেটে উঠছে বলে মনে হলেও বর্তমানে সেসব দেশে এই ভাইরাসের পুনরুত্থান দেখা গেছে।

ব্রিটেনে এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ১৩ হাজার ৪৮৩ জন এবং মারা গেছেন ৪৬ হাজার ২০০ জনের বেশি।

এসআইএস/পিআর